Press "Enter" to skip to content

অনিল বিশ্বাসরা অতীত, একবিংশ শতাব্দীতে বঙ্গ-রাজনীতির ব্যতিক্রমী চরিত্র কুণাল ঘোষ

শোভন সাহা

কুণাল ঘোষ। কুণাল ঘোষ। কুণাল ঘোষ। বঙ্গ-রাজনীতির বাজারে এখন সবচেয়ে বেশি বিক্রিত রাজনৈতিক পণ্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আছে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারী আছে। কিন্তু কুণাল ঘোষ! সন্দেশখালি হোক বা শিলিগুড়ি, সর্বত্র কুণাল ঘোষের কদরই আলাদা। টিভি খুলুন কুণাল ঘোষ, খবরের কাগজে কুণাল ঘোষ, নিউজ পোর্টালে কুণাল ঘোষ, ফেসবুক-এক্স-ইউটিউবে কুণাল ঘোষ….। কী এমন আছে এই কুণাল ঘোষে, যে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ আর কিছুটা রাহুল গান্ধীর লোকসভা ভোটে এতটা জায়গা জুড়ে শুধুই কুণাল ঘোষ?

সত্যি কথা বলতে দ্বিধা নেই, সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক মন্দ কথা (খিস্তি) শোনেন কুণাল ঘোষ। নেটদুনিয়ার একাংশ তাঁকে ডাকে ‘চোর্কুণাল’ নামে। শেষ কয়েক বছরের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বলছে, সকাল-সন্ধে কুণাল ঘোষকে খেউর করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না অনেকের। কিন্তু সেই এক দিন কলকাতা পুলিশের প্রিজন ভ্যান চাপড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে বিষোদ্গার করা কুণালই যখন রাজ্য তৃণমূলের শীর্ষ এক পদে বসেন, তখন অবাক হতে বইকি!

কুণাল চোর, কুণাল চটিচাটা, কুণাল গিরগিটি থেকে শুরু করে ভাঁড় কুণাল, শিক্ষাগত যোগ্যতা ভাঁড়ানো কুণাল গোছের যত অপবাদই একাংশের তরফে দেওয়া হোক না কেন, কুণাল যে এই শতাব্দীতে বাংলার ব্যতিক্রমী এক চরিত্র, সেকথা আপনি না মানলেও কিচ্ছুটি যায়-আসে না ইতিহাসের। অন্তত একবিংশ শতাব্দীতে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে কুণাল ঘোষকে বাদ দিলে আপনি কী-ই বা আর পাবেন?

হ্যাঁ পাবেন, অনিল বিশ্বাস, বিমান বসু অথবা মুকুল রায়। যাঁরা সে অর্থে প্রশাসনিক বা সংসদীয় কোনো পদে না থেকেও রাজ্য-রাজনীতির নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করেছেন। দলের নীতি নির্ধারণে শেষ কথা হয়ে উঠেছেন। শুধু ‘কিং’ নয়, কখনও কখনও ‘কিংডম’ মেকারও হয়ে উঠেছেন। ভয়ানক অতীত ভুলে কুণালের সেই সারিতে উত্তরণের লড়াই মুখের কথা নয়। সে রকম কোনো রাজনৈতিক জনভিত্তি না থাকা সত্ত্বেও কুণালের প্রতিপক্ষকে আক্রমণ অথবা প্রতিপক্ষের আক্রমণ ঠেকানোর পদ্ধতি বঙ্গ-রাজনীতিতে বর্তমান সময়ে নিতান্তই বিরল। কুণাল যা বলেন, সেটা খবর হয়। কুণালকে নিয়ে যা বলা হয়, সেটাও খবর হয়। বর্তমান রাজনীতিতে যা কার্যত অভাবনীয়। কেন অভাবনীয়?

মমতা, অভিষেক, শুভেন্দু তো আছেনই, এর বাইরে দিলীপ ঘোষ, কিছুটা মীনাক্ষি মুখোপাধ্যায়কে বাদ দিলে রাজ্য-রাজনীতিতে সর্বজনআলোচ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বলতে কুণাল ঘোষ ছাড়া আর কে আছেন বলুন তো! তাঁর মতো ‘খোঁচা স্পেশালিস্ট’ এ মুহূর্তে বিরল। অনেক হাতড়াবেন, কিন্তু কুণাল ঘোষের রসায়ন এ মুহূর্তে দ্বিতীয় কারও মধ্যে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আগের দশকের প্রথম ভাগে বঙ্গ-রাজনীতির চাণক্য বিশেষণটা ব্যবহার হতো মুকুল রায়ের ক্ষেত্রে, আর এ দশকে সেটাই জুটে যাচ্ছে কুণালের!

কুণাল ঘোষ যেন একটা বৃহৎ রাজনৈতিক শিল্প। বিভিন্ন ধরনের কারখানা। অনেক রকমের মেশিন। যেসব মেশিনে বিরোধী দলকে কোণঠাসা করা থেকে নিজের দলের হাটে হাঁড়ি ভাঙার যাবতীয় উপকরণ তাৎক্ষণিক ভাবে মজুদ থাকে চব্বিশ ঘণ্টা। বিরোধী দলের নেতানেত্রীরা তাঁকে যেমন শত্রু মনে করতে পারেন, তেমনই তাঁর নিজের দলেও তিনি যে অজাতশত্রু, সেটাও নয়। মাঝেমধ্যেই তাঁর কথা শুনে ধন্ধে পড়ে যান নিচুতলার কর্মীরা। কুণাল আদতে কোন দলে আছেন, সেটাই বোঝা মুশকিল হয়ে যায় তাঁদের কাছে।

সারদায় জেলে গেছেন, এতটা টেনেই কুণালকে হালকা ভাবে নিয়ে নেন অনেকে। কিন্তু জেল থেকে বেরিয়ে তিনি কী ভাবে দীর্ঘ প্রায় ১৩ বছর রাজ্যের ক্ষমতায় থাকা একটি দলের ‘মুখ’ হয়ে দাঁড়ালেন, সেটা ধর্তব্যের মধ্যে আনেন না অনেকে। তাঁদের মতে, কুণাল ঘোষ ততদিনই যত দিন রাজ্যে তৃণমূল বা আরও স্পষ্ট করে বললে, যতদিন দিন তিনি অভিষেকের ভজনকীর্তন করছেন। ভুল। সাংবাদিক কুণাল ঘোষ নিজের অপমানকে কোনো দিন হজম করেননি, বরং বমি করিয়ে ছেড়েছেন বিরোধীপক্ষকে। রাজনীতিক কুণাল ঘোষের মধ্যেও তারই প্রতিফলন দেখেন অনেকে। তাঁর মধ্যে কাউকে শেষ করার ক্ষমতা কতটা আছে, তা মাপা না গেলেও তাঁকে শেষ করা যে চাট্টিখানি কথা নয়, সেটা তিনি একাধিক বার প্রমাণ করেছেন।

২০২১ বিধানসভা ভোটের পর থেকে তৃণমূলের রাজনৈতিক মূলধন ক্ষয় পেয়েছে অনেকটাই। স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিক কারণে দলের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে সরতে হয়েছে ময়দান থেকে। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মতো বর্ষীয়ান নেতার মৃত্যু একটা বিশেষ শূন্যস্থান তৈরি করে দিয়েছিল তৃণমূলে। এর পর একে একে রাজনীতির ময়দান থেকে কারাগারে ঠাঁই হয়েছে পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অনুব্রত মণ্ডল এবং জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের মতো নেতাদের। যাঁদের উপর মমতার ভরসা ছিল অনেকটাই। এমনকী, মদন মিত্রের মতো কারণে-অকারণে জমিয়ে রাখা নেতাও এখন আড়ালে। সেই জায়গায় কুণালের ছায়া আরও লম্বা থেকে লম্বা হতে শুরু করে।

তাই বলে বঙ্গ-রাজনীতিতে কুণাল আর কুণালের রাজনৈতিক কেরিয়ারকে এতটা স্বল্প পরিসরে গুছিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। সাংবাদিকতার পাশাপাশি শেষ কয়েক দশক ধরে নিজের রাজনৈতিক জমি চষেছেন। ফসল তুলেছেন। দলের সাংসদ হয়েছেন, জেলে গিয়েছেন,ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দলের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন, জেল থেকে ফিরে দলের এমন পদ পেয়েছেন, যা অন্য অনেক জাঁদরেল নেতার কাছেও বহুকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু সেইসব পদ ছাড়তে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি কুণাল। ঘরে-বাইরে চরম অপমানজনক কথা শুনতে হয়। কিন্তু কুণাল রয়েছেন কুণালেই। তাঁর কথায়, ‘আমার নেত্রী মমতা, সেনাপতি অভিষেক’। দু’দিকটাই শক্ত করে ধরে রাখতে জানেন কুণাল। আর যাঁরা তা পারেন না, তাঁরাই কখনও ‘অভিষেকের চামচা’ আবার কখনও ‘বিজেপির চর’ বলে দেগে দেন তাঁকে। তৃণমূলে অভিযেক-অধ্যায় শুরু হওয়ার পর থেকে দ্বি-মেরু তত্ত্ব নিয়ে কম চর্চা হয়নি। কালীঘাট আর ক্যামাক স্ট্রিটের ‘দূরত্ব’ মাপতে অধীর আগ্রহ দেখান অনেকেই। এখানেও সেই কুণাল, ব্যালেন্স কিং। এর জন্য পাবলিকের কাছে গালমন্দও কম জোটে না। কিন্তু স্থিতধী কুণাল কখনোই চটে যান না। ভয়ঙ্কর সময়ের মধ্যে দিয়ে গেছেন, ভেঙে পড়ে ফের উঠে দাঁড়িয়েছেন। নিজের ‘হিডেন পাওয়ার’ দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন ‘ডর কে আগে জিত হ্য়ায়’।

কুণালকে দেখে মনে হয়, নিজেও জানেন গলা অবধি জলে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, কিন্তু মাথাটা কী ভাবে ভাসিয়ে রাখতে হবে, সেটাও তাঁর অজানা নয়।

More from রাজ্যMore posts in রাজ্য »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *