উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায়, দক্ষিণ ২৪ পরগনা:
আদি গঙ্গার পাড়ে, শ্মশান লাগোয়া এক প্রাচীন জনপদ—দক্ষিণ বিষ্ণুপুর। এখানেই প্রতিষ্ঠিত মা করুণাময়ী কালী, যাঁর পেছনে রয়েছে ১০৮ নরমুণ্ডের মালা। আজও প্রতিদিন ভক্তদের ঢল নামে এই তিনশো বছরের প্রাচীন মন্দিরে।
স্থানীয়দের কথায়, একসময় এই শ্মশান ছিল তান্ত্রিক ও সাধকদের সাধনক্ষেত্র। শবসাধনা, নরমুণ্ড উৎসর্গ—এসবই ছিল এখানকার পরিচিত দৃশ্য। প্রায় ৩০০ বছর আগে তান্ত্রিক মণিলাল চক্রবর্তী স্বপ্নাদেশে এখানে দেবীর পুজো শুরু করেন। প্রথমে টালির চালের ছোট মন্দিরে বার্ষিক পুজো হত। পরে মা কালী স্বপ্নে নিত্যপুজোর ইচ্ছা প্রকাশ করলে স্থায়ী মন্দির গড়ে ওঠে। সেই সময়ই ১০৮ নরমুণ্ড উৎসর্গ করে পঞ্চমুণ্ড আসনের সামনে প্রতিষ্ঠিত হয় দেবী করুণাময়ী।
এখনও মন্দিরে ঢুকলে দেখা যায় সেই ১০৮ নরমুণ্ডের সারি। প্রতি কালীপুজোয় গঙ্গাস্নান করে ভক্তরা ১০৮টি জবাফুল নিবেদন করেন। তন্ত্র মতে পুজো হয় এখানে। তবে একসময় বলিপ্রথা থাকলেও এখন তা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কালীপুজোর রাতে দেবীকে নিবেদন করা হয় কাঁচা মাংস, ছোলা, মদ এবং ‘শিয়াল ভোগ’। স্থানীয়দের বিশ্বাস, সেই রাতে শ্মশান আজও জেগে ওঠে—শোনা যায় মন্ত্রোচ্চারণ, বাজে ঢাক-ঢোল, আর জ্বলে ওঠে দীপাবলির আলোয় তন্ত্রের রহস্যময় আবেশ।
প্রজন্ম পেরিয়ে আজ মণিলাল চক্রবর্তীর ছেলে শ্যামল চক্রবর্তী মন্দিরের প্রধান সেবায়েত। তাঁর হাতে এখনও টিকে আছে পরিবারের সেই তন্ত্রসাধনার ঐতিহ্য। পুজোর আগেই ব্যস্ততা তুঙ্গে—নতুন রঙে সেজে উঠছে দালান, ঝাড়পোছ চলছে নরমুণ্ডগুলির।
একসময় এই মন্দিরে ঢুকতেও ভয় পেতেন ভক্তরা। চারিদিকে অন্ধকার, জঙ্গলের ছায়া, গা ছমছমে পরিবেশ। এখন অবশ্য অনেকটাই বদলে গেছে ছবি—আলোকসজ্জা, বসার জায়গা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চত্বর।
কালীপুজোর রাতে আজও গোটা দক্ষিণ বিষ্ণুপুর জেগে থাকে মা করুণাময়ীর জাগরণে—অন্ধকার ও আলোর, মৃত্যু ও মাতৃশক্তির সেই চিরন্তন মিলনে।










