Press "Enter" to skip to content

এক পক্ষ কাল ব্যাপী জয়নগরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী জয়চণ্ডী মায়ের রূপ পরিবর্তন উৎসব চলছে

উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায়,জয়নগর : জয়নগরের ধন্বন্তরী কালীমায়ের এক পক্ষকাল ব্যাপী রূপ পরিবর্তন ও মেলা শেষ হওয়ার পরে জয়নগরের আরেক অধিষ্ঠাত্রী দেবী জয়চণ্ডী মায়ের এক পক্ষ কাল ব্যাপী রূপ পরিবর্তন উৎসব শুরু হয়েছে গত শুক্রবার থেকে।এই দেবীর নাম অনুসারে এই জয়নগরের নামকরণ হয়েছে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়,দেবী স্বপ্নাদেশে বলেন,”আমি দেবী জয়চণ্ডী! এই স্থানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী , তুই আমাকে এখানে প্রতিষ্ঠা কর ,তোর মঙ্গল হবে।” জয়নগরের প্রসিদ্ধ মতিলাল বংশের আদি পুরুষ গুনানন্দ মতিলাল। তাঁর প্রতিষ্ঠিত দেবী জয়চণ্ডী ,যে নামের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ” জয়নগর ” শহরের নাম। যশোর জেলার বিক্রমপুর থেকে সপরিবারে গঙ্গাসাগর সঙ্গমে স্নান করার উদ্দেশ্যে আদিগঙ্গা পথে গুনানন্দ মতিলাল যাত্রা শুরু করেছিলেন। গুনানন্দ মতিলাল প্রখ্যাত মতিলাল বংশের আদি পুরুষ । আদি গঙ্গা পথে যখন সন্ধ্যাকালে গঙ্গার পশ্চিম কুলে নৌকা নোঙ্গর করেন ,যে স্থানটি ” রাজার গঙ্গা “( যা বর্তমানে মতিলাল গঙ্গা ) নামে পরিচিত ছিল । সন্ধ্যে হয়ে যাওয়ায় বিশ্রামের উদ্দেশ্যে ক্লান্ত হয়ে গুনানন্দের চোখ ঘুমে বুজে আসে । হঠাৎ তিনি দেখতে পান গভীর জঙ্গলের মধ্যে আলো- আঁধারিতে যেন এক অপরূপা সুন্দরী সুশ্রী বালিকা কলসী করে জল কাঁখে নিয়ে বনপথে চলেছে আপন ছন্দে । গুনানন্দ অধীর আগ্রহে নৌকা থেকে তড়িঘড়ি করে নেমে বনের মধ্যে অনুসরণ করতে লাগলেন কিন্তু ব্যর্থ মনোরথে ফিরে এলেন । স্বাভাবিক ভাবে মনের মধ্যে কৌতুহল নাড়াচাড়া দিচ্ছিল ক্রমাগত । মনে মনে প্রশ্ন হচ্ছিল , তাহলে কি আমি কিছু ভুল দেখলাম ,নাকি আমার মনের ভূল —- ঘুম ভাঙ্গা চোখে । এই চিন্তা করতে করতেই ক্লান্ত শরীরে নিবিড় ঘুম নেমে এল তাঁর চোখে । গভীর ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে তিনি দেখলেন ,সন্ধ্যায় যে সুশ্রী বালিকাটিকে গভীর জঙ্গলে চোখে দেখে ছিলেন ,তিনি তাঁকে বলছেন — ” আমি দেবী জয়চণ্ডী! এই স্থানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী , তুই আমাকে এখানে প্রতিষ্ঠা কর , তোর মঙ্গল হবে। “

গভীর জঙ্গলের মধ্যে একটি বকুল গাছের তলায় তাঁর মূলের নিচে প্রত্যাদেশ মতো খনন করতেই দেবী মায়ের পাষাণ ময়ী মুর্তি এবং একটি প্রস্তর খণ্ড ঐ বকুল গাছের কাঠ দিয়ে মা জয় চণ্ডীর দারুমুর্তিটি নির্মাণ করেন বলেই জনশ্রুতি ,যা উচ্চতায় প্রায় চার ফুট। জাগ্রত মা জয়চণ্ডীকে প্রতিষ্ঠা করে কাছা কাছি স্থানে জঙ্গল সাফাই করে গুনানন্দ মতিলাল সপরিবারে বসবাস করতে শুরু করেন। মায়ের শান্ত অপরূপ মুর্তি আজও বিরাজ মান, যে রূপ দর্শণে মন ভরে যায় যেন এক জীবন্ত অন্নপূর্ণা।

অন্য মত অনুসারে, গুনানন্দের জয়নগরে আসার শতাধিক বছর আগে তাঁরই পরিবারের পূর্ব পুরুষগন (নীলকণ্ঠ মতিলাল) জয়নগরে আসেন । এ সময় জয়নগর সমৃদ্ধশালী জনপদ ছিল । তারপর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে গভীর জঙ্গল ও অরন্যে পরিনত হয়। আদি জয়নগর এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কবলে পড়ে ১৫৮৫ সালে জল প্লাবনের ফলে জনমানব শূন্য ঘন জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে পরিনত হয় , সেই সমযেও আদিগঙ্গার প্রবাহ বজায় ছিল । সুন্দরবনে সেই সময় জলোচ্ছ্বাস ও বন্যায় জয়নগরের আদি সভ্যতা লুপ্ত হয়ে যায় । এই জলোচ্ছ্বাসের কিছু আগে রাজা নীলকন্ঠ মতিলাল পাঠানদের সঙ্গে যুদ্ধে রনক্ষেত্রে দেহ রাখেন । বড় ভাই নীলকন্ঠ মতিলালের মৃত্যুর পর ছোট ভাই ভবানীনাথ মতিলাল পর্তুগীজ জলদস্যু গঞ্জলোর কাছে জলযুদ্ধ ও রনপথ নির্মাণ শেখেন ।পরে রায়নগরের রাজা বিভূতি শেখর ও তাঁর ছেলে রঙ্গিলা রায়ের নৌ সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত হন ।১৫৯৪ সালে সুন্দরবন জল প্লাবিত হলে রায়নগর প্রভৃতি স্থান জনশূন্য হয়ে যায়। ঐ সময় গুনানন্দের পূর্ব পুরুষগন জয়চণ্ডীকে প্রতিষ্ঠা করেন বলে জানা যায় । তার ১০০ বছর পরে ষোড়শ শতাব্দীর শেষে জঙ্গলাকীর্ণ সুন্দরবন তথা জয়নগরে নৌকা যোগে আসার সময় স্বপ্নাদেশে মায়ের কৃপালাভ করে গভীর অরন্য মধ্য থেকে গুনানন্দ কুলদেবী মা জয়চণ্ডীকে উদ্ধার করেন এবং গুনানন্দের প্রতিষ্ঠিত দেবী জয়চণ্ডী তখন মাটির ঘরে ছিলেন । সেই সময় যশোর থেকে মায়ের সেবার কাজ করার জন্য পণ্ডিত পরিবারকে নিয়ে আসেন । বংশ পরম্পরায় আজও সেই পণ্ডিত পরিবার মায়ের সেবার কাজ করে যাচ্ছেন । দেবী জয়চণ্ডীর মন্দিরকে পাকা মন্দির নির্মাণ করে দেন তৎকালীন কোলকাতার নামকরা তিমানী বংশীয় এক ব্যক্তি ।

পরবর্তী পর্যায়ে মন্দির সংস্কার , মন্দির সম্মুখস্থ চাঁদনী নির্মাণের কাজ প্রয়াত জ্ঞানেন্দ্র নাথ মিত্র মহাশয় শুরু করেন এবং তারও বেশ কয়েক বছর বাদে অসম্পূর্ণ কাজটি সম্পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে স্বর্গীয় নিত্যহরি মতিলালের অর্থানুকল্যে স্বর্গীয় শ্যামাদাস ঘটকের তত্ত্বাবধানে কাজ শেষ হয় বলে জানা যায়। বর্তমানে মন্দিরের বহু সস্কার হয়েছে । মন্দিরের চূড়া থেকে সমস্ত দালান , দেওয়াল পাথরে মুড়ে দিয়ে মন্দিরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে আরও । শান্ত পরিবেশে মায়ের মন্দিরে বসে থাকতে ও মন কাড়বে ভক্তদের , মন্দির কর্তৃপক্ষ রীতিমত দক্ষতার সাথে পরিচালনার কাজ করছেন । মায়ের অপরূপ মুর্তির সাথে সম্পূর্ণ মন্দির পরিবেশ বাস্তবিকই মন টানে ।মন্দিরের বর্তমান সেবায়তরা জানালেন,কোন সুদূর অতীতে এক পূণ্য জ্যৈষ্ঠের পূর্ণিমা তিথিতে প্রত্যাদেশ অনুসারে দেবীকে স্থাপন করা হয় । সেই থেকে প্রতি বছরই জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা প্রতিপদ থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত এক পক্ষ কাল ব্যাপী প্রতি সন্ধ্যায় বিভিন্ন সাজে ও বিচিত্র ভাব -ভঙ্গিমায় মায়ের রূপ পরিবর্তন অনুষ্ঠান হয় । দেশ দেশান্তরের ভক্ত সন্তান সন্ততিগন শক্তি রূপিনী মায়ের নিত্য নতুন রূপ স্বচক্ষে দর্শণ করে জীবন ধন্য ও সার্থক করেন ।‌

প্রতি বছরই জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমাতে দেবীর আবির্ভাব উৎসব অনুষ্ঠিত হয় ।‌ বহু মানুষের সমাগম ঘটে ।তবে আগে একপক্ষ কাল ধরে জমজমাট মেলা বসতো মন্দির চত্বরে। বর্তমানে জাঁক জমক পূর্ণ ভাবে রুপ পরিবর্তন হয়। যা বহু দূর দূরান্তে মানুষ দেখতে আসলে এখন আর কোনো মেলা বসে না এখানে।হাতে গোনা ২-৪ টি দোকান ছাড়া আর কোনো দোকানপাট বসে না এখানে।

এ ব্যাপারে মন্দির কমিটির সদস্য মলয় চক্রবর্তী বলেন, “জয়নগরের নামকরন যে দেবীর নামে সেই দেবীর রুপ পরিবর্তনে আরও মানুষ আসুক আমরা চাই সেটা।আমরা এখানে মেলায় দোকান দেবার জন্য কোনো মূল্য নিই না।তাই চাইব এই মেলায় আর ও অনেক দোকানদার আসুক।আরো অনেক মানুষ আসুক। এবং জমজমাটি মেলা হোক আগের মতন।”

More from জেলায় জেলায়More posts in জেলায় জেলায় »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *