আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদ। ছবি: রাজীব বসু
জয়ন্ত মণ্ডল
সুচারু ভাবে খেপিয়ে তোলা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সরকার এবং সরকারি দমনশক্তি বা আরও স্পষ্ট করে বললে পুলিশের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তোলার কাজ চলছে। সোশ্যাল মিডিয়া অথবা একাংশের নিউজ মিডিয়ায় গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। নিশানায় যখন শাসক দল, তখন নেপথ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাই চর্চায় উঠে আসছে। আরজি কর কাণ্ড নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে যে সমস্ত ঘটনা ঘটে চলেছে, তার বিশ্লেষণে এমন একটা মতের আবির্ভাব অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু, গুজবের দোহাই দিয়ে রাজ্যের সমসাময়িক উত্তাল পরিস্থিতিকে এড়িয়ে যাওয়া মোটেই সময়োচিত মূল্যায়ন হতে পারে কি?

আদি অনন্তকাল ধরে গুজব সমাজ জীবনের অঙ্গ। খুব পিছনে না গিয়েও এই সরকারের আগের জমানায় নজর বুলিয়ে নেওয়া যেতে পারে। হলদি নদীতে শয়ে শয়ে লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে অথবা রাইটার্স বিল্ডিংয়ের নীচ দিয়ে দমদম বিমানবন্দর পর্যন্ত জ্যোতি বসুর পালানোর জন্য সুড়ঙ্গ তৈরির গুজবও তো মানুষ খেয়েছিল। কজনকে পুলিশের নোটিস পাঠানো হয়েছিল সেসময়। বাম সরকারের এক প্রাক্তন আমলা নিয়মিত বিপ্লবী এক সংবাদপত্রে তারিখ ধরে আধা-গুজব ছড়াতেন। একেবারে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, তাঁকে কোনওদিন নোটিস পাঠাতে দেখা যায়নি। কিন্তু সেই তিনি যখন সরকার বদলের পর মুখ খুললেন, তাঁকে ব্যান করা হয়।
তখন গুজব উড়ত বাতাসে, এখন দোসর ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়া। এগুলোর সৌজন্যে মানুষ এখন অনেক দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে পারছে। ইন্টারনেটের সহায়ে মানুষের এখন মেগা মস্তিষ্ক। কখন যে কি খেলে দেবে, আগাম আঁচ পাওয়া মুশকিল। মুরুব্বীরা বলতেন, যা রটে তার কিছুটা তো ঘটে। তাই বলে কি গুজবকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে হবে? অনেক সময় এই প্রশ্নের উত্তরও বিচার-বিশ্লেষণ পরোয়া করে না।
নতুন করে বলার নয়, মহা পরাক্রমশালী সিপিএমের বিরুদ্ধে একটানা ফাইট দিয়েছেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই ফাইটকে কখনোই ছোট করা যাবে না। কলকাতার বামেদের কথা বাদ দিন, জেলায় তাকান। তখন বলিউডে যেমন নাদিম-শ্রাবণ, এখানে তেমন তপন-শুকুর! এক জুটি সুরের, আরেক জুটি যেন অসুরের। তপন ঘোষ আর শুকুর আলিকে অনেকেই চিনতে নাই পারেন, তপন-শুকুর জুটির কথা অনেকেরই মনে থাকতে পারে। তাঁদের নিয়ে কম গুজব রটেনি। মাস্টার মানে পেশায় শিক্ষক হলেও মজিদ মাস্টারকে নিয়ে এমন সব খবর হতো, লোকটা ঠিক যেন মুম্বইয়ের কোনো ছবির গ্যাংস্টার মাস্টারের মতই। খুঁজলে এমন আরও কিছু নাম পাওয়া যাবে, যাঁরা বাম আমলে নিয়মিত গুজবে থাকতেন। এঁদের মধ্যে কে কতটা ধোয়া তুলসী পাতা আর কে আহার-পরবর্তী কলা পাতা, সে আর শুনছে কে? কিন্তু তখন সেগুলোকে গুজব বলে মনে হয়নি। আর সেই জন্যেই হয়তো পায়ে হাওয়াই চটি পরা পুলিশ যতটা ধিক্কার পেয়েছে, মুখে গামছা জড়িয়ে মাওবাদী সাজারা ততটাই সমর্থন। সরকার সমর্থিত অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো মানুষই ক্ষমতায় এনেছে মমতাকে। কিন্তু আজ পট পরিবর্তন ঘটেছে সময়ের তাগিদেই। মিল কি নেই? হুবহু, কাল যা বলত বিরোধীরা, আজও সে কথাই বলছে বিরোধীরা। কোন রাজনৈতিক দল কতটা ফায়দা তুলবে, সে অঙ্ক কষার দায় নয় মানুষের।
পাওলো কয়েলহর একটা বিখ্যাত উক্তি, আমরা প্রত্যেকেই জানি অন্যের কী করা উচিত, কিন্তু নিজে কী করব সেটাই স্পষ্ট নয়। এই উক্তি বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু অ্যাভারেজ তো বটেই। বিশেষ করে, কোনো সংকটকালীন সময়ে এই সমস্যা বেশ প্রকট হয়। অন্যের সংকটে তার কী করা উচিত, সে ব্যাপারে বিশদ পরামর্শ দেওয়া সহজ হলেও নিজের সঙ্কটকালে দিশেহারা পরিস্থিতির স্বীকার হতে হয়। যে যত বড় ব্যক্তিত্বের অধিকারীই হোক না কেন, বুদ্ধিনাশে সর্বনাশ ডেকে আনে। তখন নিজের নির্মম পরিণতির জন্য এতে-ওতে, এর ঘাড়ে-ওর ঘাড়ে দোষ চাপানোটাই অতিসহজ পন্থা।
এই এখন যেমনটা চলছে। বলা হচ্ছে, সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তোলা হচ্ছে। মানুষ কি খেপবে না? মানুষ কেন খেপবে না? মানুষ মাত্রেই ক্ষোভ থাকবে, বিক্ষোভ দেখানোটা সময় ঠিক করে দেয়। কতদিন মানুষ ক্ষোভ চেপে থাকবে আর কখন মানুষ বিক্ষোভ দেখাবে, এর কোনো পাটিগাণিতিক হিসেব নেই। বিরোধী রাজনৈতিক দল তো নিজের কৌশলে সেই ক্ষোভ ঝুলিতে ভরতে চাইবে। আর শাসক দল যখন বুদ্ধিনাশের চক্করে পড়ে নিজের জন্যে একের পর এক সর্বনাশকে আহ্বান জানায়, তখনই তো একটা ২০১১ ঘটে যায়।
(লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত। শিরোনাম পরিবর্তিত)




Be First to Comment