উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায় : সুন্দরবনে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষে নতুন রেললাইন বসানোর কাজ শুরু হয়েও বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। আপাতত বন্ধই সুন্দরবনে রেললাইন সম্প্রসারণের কাজ। মাতলা নদীর উপরে কয়েকখানি কংক্রিটের খুঁটি তৈরি ছাড়া কিছুই হয়নি। এর পরে মাতলা নদীতে অনেক জোয়ার-ভাটা খেলেছে। কিন্তু এই ৪২ কিমি রেলপথ সম্প্রসারণের কাজ আর এগোয়নি।
প্রায় ১৫ বছর আগে সুন্দরবনে রেললাইন সম্প্রসারণের দাবি তুলেছিলেন প্রত্যন্ত সুন্দরবনএলাকার মানুষজন। তৎকালীন লোকসভার অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে গণ স্বাক্ষর করে দাবিপত্র পাঠানো হয়। সেই দাবিকে মান্যতা দিয়ে ২০০৯ সালে রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্যানিং থেকে ঝড়খালি পর্যন্ত রেললাইনের শিলান্যাস করেছিলেন। শুরু হয়েছিল কাজ। মাতলা নদীর উপরে রেলসেতু নির্মাণের জন্য ২১টি কংক্রিটের স্তম্ভও তৈরি হয়।
কিন্তু ওই পর্যন্তই। বছরের পর বছর কেটে গেলেও কাজের অগ্রগতি হয়নি। রেল বাজেটে বার বার বঞ্চিত থেকেছে সুন্দরবনের এই রেলপথ সম্প্রসারণের প্রকল্প। সম্প্রতি রেলের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, রেলপথ সম্প্রসারণের জন্য পর্যাপ্ত জমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় এবং বন ও পরিবেশ দফতরের ছাড়পত্র না মেলায় আপাতত এই প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।সুন্দরবনবাসীদের দাবি মাথায় রেখে প্রথমে ক্যানিং থেকে ভাঙনখালি পর্যন্ত ৪.৮৪ কিমি ও পরে আরও দু’দফায় ভাঙনখালি থেকে সোনাখালি পর্যন্ত ১৪.০৩ কিমি, সোনাখালি থেকে ঝড়খালি পর্যন্ত ২৩ কিমি রেলপথ সম্প্রসারণের কথা ঘোষণা করেছিল রেল। ২০০৯ সালের ১৪ নভেম্বর ক্যানিংয়ে এর শিলান্যাস অনুষ্ঠান হয়। শুরু হয়ে যায় রেলপথ সম্প্রসারণের কাজ। প্রায় দেড়শো কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হয় মাতলা নদীর উপরে এই রেল সেতু তৈরির জন্য।
কিন্তু সেই টাকায় মাতলা নদীর উপরে কয়েকখানি কংক্রিটের খুঁটি তৈরি ছাড়া আর কিছুই হয়নি। এরপরে মাতলা নদীতে অনেক জোয়ার-ভাটা খেলেছে। কিন্তু ৪২ কিমি রেলপথ সম্প্রসারণের কাজ আর এগোয়নি। প্রতিবার রেল বাজেটের আগে আশায় বুক বাঁধেন সুন্দরবনের মানুষ আর নিরাশ হন।রেলপথের দাবিতে নাগরিক মঞ্চ গঠন করে নাগরিক কনভেনশন করেছেন সুন্দরবনবাসী। নাগরিক মঞ্চের অন্যতম সদস্য তথা সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদের প্রাক্তন সদস্য লোকমান মোল্লা তৎকালীন রেল প্রতিমন্ত্রী অধীররঞ্জন চৌধুরী থেকে শুরু করে বিজেপি সরকারের রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু, পীযূষ গোয়েল, এমনকী বর্তমান রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈভবের সঙ্গে ও এ বিষয়ে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু লাভ কিছু হয় নি।
এ বিষয়ে লোকমান মোল্লা বলেন, ‘‘সুন্দরবনবাসীর যন্ত্রণার কথা কেউ শোনে না। বার বার আশ্বাস দেওয়া হলেও আজ পর্যন্ত এই রেলপথ নিয়ে কোনও সদর্থক ভূমিকা কেউ পালন করলেন না।আমরা চাই দ্রুত রেল দফতর সুন্দরবনের দিকে নজর দিক।সুন্দরবনের মানুষ চিরকাল অবহেলিত রয়ে গেল ।’’ঝড়খালি পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণ হলে একদিকে যেমন দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা সরাসরি সুন্দরবনে আসতে পারতেন, তেমনই সুন্দরবনের লক্ষ লক্ষ মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মানোন্নয়ন ঘটতো বলে মনে করেন অনেকেই।রেল দফতর সূত্রের খবর,দেশের প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নির্দেশে রেলের তরফে ক্যানিং-ঝড়খালি রেলপথ সার্ভের কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। জমি অধিগ্রহণের জন্য দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, রেলসেতুর কাজ ফের শুরু করা হয়েছে বলে লোকমানকে ইতিমধ্যে চিঠিতে জানিয়েছে রেল। কিন্তু রাজ্য সরকারকে জমি অধিগ্রহণ করার আবেদন জানানো হলেও সে বিষয়ে তেমন উদ্যোগ দেখানো হয়নি বলে অভিযোগ দিল্লির।সে কারণেই এই রেলপথ সম্প্রসারণের কাজ আর এগোয়নি।
গত বছর বিষয়টি লোকমান মোল্লা ত্রিপুরা থেকে নির্বাচিত রাজ্যসভার সিপিএম সাংসদ ঝর্না দাস বৈদ্যের নজরে আনেন। সাংসদ সুন্দরবনবাসীদের আবেদনপত্র-সহ বর্তমান রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবকে চিঠি দেন। সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি রেল জানিয়েছে, ক্যানিং থেকে ভাঙনখালি, সোনাখালি হয়ে ঝড়খালি পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণের জন্য পর্যাপ্ত জমি পাওয়া যাচ্ছে না। তা ছাড়া, এই প্রকল্পের জন্য পরিবেশ ও বনদফতরের ছাড়পত্রও মেলেনি। সে কারণেই আপাতত এই রেল সম্প্রসারণের কাজ বন্ধ রাখা হচ্ছে।লোকমান মোল্লা এ ও বলেন, “এই রেলপথ সম্প্রসারণ হলে সুন্দরবনের হতদরিদ্র বেকার যুবক-যুবতী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রছাত্রী থেকে সর্বস্তরের মানুষ শহর ও শহরতলির সঙ্গে সহজে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে জীবিকার উন্নয়ন করতে পারতেন। কিন্তু প্রকল্প থমকে যাওয়ায় সুন্দরবনবাসীর সেই স্বপ্ন অধরা থেকে যাবে।”
জমি অধিগ্রহণের জটিলতা নিয়ে মুখ খুলতে চাননি দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের আধিকারিকেরা। এ বিষয়ে জেলাশাসক সুমিত গুপ্তা জানান, “রেল এ বিষয়ে সঠিক কী বলেছে আমার সে বিষয়ে জানা নেই। তবে এ সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে তবেই বলতে পারব।”অন্য দিকে, এই প্রকল্পের বিষয়ে সেভাবে মুখ খুলতে চাননি সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী বঙ্কিম চন্দ্র হাজরাও। তিনি বলেন, ‘‘বাংলার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকা কালীন এই প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। কাজও শুরু হয়েছিল। কিন্তু সঠিক কী কারণে কাজ বর্তমানে বন্ধ, তা বলতে পারব না।তবে সুন্দরবনের উন্নয়নে এই রেলপথের প্রয়োজন আছে।”
Be First to Comment