ধীমান ব্রহ্মচারী
শতাব্দীর যুদ্ধ। দেশের ক্ষয়। একরাশ যন্ত্রণা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেশের জনগণ। এই সময়ের আমাদের বহু আলোচিত বই, কবি বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এর পতাকার বদলে দিগন্ত। যেভাবে আমরা আজ রং নিয়ে নয়, একরাশ আশা-প্রত্যাশা, ভালোবাসা আর বিশ্বাস নিয়ে খেলছি লাল হয়ে পুড়ে যাওয়া ঘাস বেছানো মাঠে। সেই কথায় কবি বিনায়ক বলেন আমাদের। যে কবিতা দিয়ে লেখা হয় আর্তি,হিসেব গাঁথা হয় কাগজের ছেঁড়া পাতায়। কবি বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়,আমাদের পতনের মুখে দাঁড় করিয়ে প্রস্তুতি নিতে বলেন, ঘুরে দাঁড়ানোর। তাই তিনি লিখতে পারেন– পতাকার বদলে দিগন্ত ‘ কাব্য গ্রন্থ একটি স্ফুলিঙ্গের আলেয়া। বইটির একটি পর্ব ‘ যবনিকা পতনের পরেও হাজারবার ‘। কিছু কথা তুলে আনি —
“রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা মৃতের চুম্বন থেকে/
সংলাপ সরিয়ে নিয়ে যখনই রেখেছি হাসি/
তখনই দেখেছি ফের, উলটে রাখা আয়নায়/
বাঁকনো চাঁদের ফালি, অসহ্য সে বঙ্কিমতা…/”
আমাদের সামনেই আছে দীর্ঘ পথ। পিচ রাস্তায় আছে জটিল নিশানা। কেউ আমাদের চিনিয়ে দেবে না আমাদের পথ,আমাদের লক্ষ্য আমাদের হাতে। কবি তাই নিজের মুখের সংলাপ সরিয়ে হাসি ফোটান। নিজের চেহারা দেখেন উল্টে রাখা এক প্রতিবিম্বে। আসলে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে আমরাও একে অপরের থেকে সরে সরে আছি ; দূরত্ব মেপে স্থান নির্ণয় করে রেখেছি সবার অজ্ঞাতে এবং অজান্তে। আসলে একটা বিরাট ক্ষেত্র।এই ক্ষেত্র রাজনীতির। এই ক্ষেত্র রঙের। আর সবাই কেমন যেন আমরা রঙ ভুলে গেছি। আমরা নেমে পড়েছি সীমানা অধিকারের লড়াইয়ে। বইয়ের ৬০ নং পাতায় কবি তাঁর দ্বিতীয় পংক্তির প্রথম লাইন লেখেন –” গুটি গুটি পায়ে আমি ভিড়ব কি ওদের সঙ্গে ‘, এই ‘ ওদের ‘ শব্দটি কবির একটি প্রতিবাদ, এক বিপরীত স্থানাঙ্কে অবস্থান। আমরা কতবার নিজেদের এভাবে মারব? আমরা কতবার রাস্তায় লুটিয়ে পড়ব? কত শাঁখা সিঁদুর লেপে থাকবে মহাকালের রাস্তা? তাই যেন আমাদের হয়ে লিখছেন —
“কী হবে কি আত্মা দিয়ে? কোন গাব জ্বাল দেব?/আত্মার ভিতরে নেই ক্রমবিকাশের বীজ/
দু’পা এগোবার পর তিন’পা পেছোতে বলে/
সে কেবল। চাই না তাকে। বরং তোমার ওই/
মাটিরঙা গোলার্ধের টানে আমি ভেসে যাই/
একটা চটি ফেলে আসি সবকটা জাহান্নামে…/”
কী অভাবনীয় উচ্চারণ আত্মা দিয়ে কোন গান জ্বাল দেবে? এগিয়ে গিয়ে বার বার যেন পেছনের দিকে প্রত্যাবর্তন।
বিরাট একটা যুদ্ধ শেষে যেভাবে ক্লান্ত সৈন্যরা বাড়ি ফেরে,প্রখরে সারাদিন পাখিরা রোদ গায়ে মেখে যেভাবে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে, উন্মত্তা কেটে গেলে যেভাবে এক ভর চাপা মানুষের শরীর শান্ত হয়,আমাদের শিরায় প্রবাহিত রক্তের ফেলিল স্রোত যেভাবে ত্বকে উপশম দেয়,সেভাবেই কবি আমাদের প্রলেপ দেন আমাদের আত্মশ্লাঘার। পতাকার বদলে দিগন্ত ‘ কবি চেয়েছেন। তাই স্বীকার করেছেন পতাকার বদলে দেব দিগন্ত। রঙের বদলে দেব স্বচ্ছ জল, ঘুসের বদলে দেব প্রাপ্য সম্মান, মৃত্যুর বদলে দেব জীবন। তিনি লেখেন প্রতিবাদ,তিনি বলে স্পর্ধা। যেমন,
“আমায় মনের করিয়ো না কী কী হয়েছিল/
আমায় বলে দিও না কী কী হবে/
আমার জীবন ভয়াবহ দুর্ঘটনার ভিতর/
বেপরোয়া প্রতিভার খোঁজে বেরিয়েছে…./
যারা জিভ দিয়ে টেনে নেবে ঝঞ্ঝা/
পেরেকে গেঁথে নেবে শরীর/
আর যখন তেজে থেকে গঠিত হবে মুখশ্রী/’..
এই মুখোশের আড়ালে আমাদের আছে মুখশ্রী। ঝলসানো আশা আমাদের ক্ষত বিক্ষত করেছে এতদিন।আমরা ভেবে নিয়েছি স্পর্ধার ছবি। তাই তিনি একটু শব্দে বলেন,’ বেপরোয়া প্রতিভা ‘ , এইতো আমাদের কাজ। আমাদের আগামীর ললাট লিখবে না কোনো লাল,নীল,সবুজ,হলুদ জামার লোক। লিখবে কোনো রক্তাক্ত ইচ্ছে,যেখানে প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে উত্তাল জনতা দেখে নেবে ময়না তদন্তের রিপোর্ট।
আসলে আমরা কোথাও একটা হেরে গেছি লড়াই করতে করতে। ক্লান্ত চোখে জড়িয়ে ধরে ঘুম। কীভাবে যাচ্ছে এই দেশ? কীভাবে মাটির রঙ ফিকে হয়ে যাচ্ছে টাকা ধোয়া জলে। আসলে আমরা বুঝতে পারছি। সবটুকু কোথায় সঞ্চিত হতে হতে বারুদের স্তূপ হচ্ছে ক্রমশ। তাই একদিন,কবির ভাষায় ‘শান্তিতে ঘুমোনো সাপও নিজের কুণ্ডলী ছেড়ে…’।
ফেলে আসা শস্য কণা,রাতে অন্ধকারে ধান গাছের ওপর পড়ছে চাঁদের আলো। চক চক করছে ধানের শিস। আমরা সবাই হাঁটছি আমাদের গ্রামে ঢুকব বলে। আমারতো সবাই নিজের মতো করে যেন বেঁচে আছি। জলে, রোদে,হাওয়ায় আছি সমাজ স্রোতে। তিনি লেখেন —
” ওই ছাঁটের মুখে জানলা বন্ধ করব না/
আমি হৃৎপিন্ডে ছুরি বসিয়ে/
হেসে উঠব আরও একবার/
এককোটিবার হত্যা করব নীরবতাকে/
নীরবতা একবার মাত্র খুন করবে আমাদের/
সেই রহস্যের কিনারা হবে না কখনও/
গেলাস ভেঙে গড়িয়ে যাওয়া মদ/
কিছুতেই ফিরে আসবে না নেশার কাছে/
ফুলের ভিতর অন্ধকার জেগে উঠলেই/
ঘুমিয়ে পড়বে আলো..’
সবকিছুই অনিবার্যভাবে নস্যাৎ করেছেন যেন। একটি দেশ,একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। একটা সিস্টেমকে আঙুল তুলে বলা,এইকি সব নয়। আসলে আমরা সবাই অপেক্ষায় আছি। আমরা সেই সূর্যের তেজ গায়ে মেখে নেব। চামড়ায় মাটি জমে আসবে,ঘ্রাণ নেব সবুজ ফসলের। কারণ আমরা চাইনা হত্যা। তাই তিনি বলেন,’ ‘এককোটিবার হত্যা করব নীরবতাকে/
নীরবতা একবার মাত্র খুন করবে আমাদের/’.. আপেক্ষিকভাবে এই নিরবতায় কি আমাদের জেদ নয়? আমাদের শরশয্যা আমরা নিজেরাই বানিয়ে নেব নির্দ্বিধায়। তাই আমরা আসন নিয়ে শুরু করে দাঙ্গা। সিংহাসন নিয়ে গঠন করেছি নানা রঙের দল। তৈরি করেছি পতাকা। কিন্তু কবি এই পতাকা ফেলে দেখছেন দূরের রংহীন দিগন্ত।
পতাকার বদলে দিগন্ত – বিনয়ক বন্দ্যোপাধ্যায়/প্রকাশনা – এবং অধ্যায়/প্রচ্ছদ – সুপ্রসন্ন কুণ্ডু/মূল্য – ২০০.০০
Be First to Comment