ছবির মধ্যেই প্রতিবাদ। রক্তের ভেতরে ক্রোধের সংক্রমণ। লিখলেন ধীমান ব্রহ্মচারী
‘..১ মে। প্যারিসের রাজপথে চলেছে মে-দিবসের কুচকাওয়াজ। পিকাসোর আভ্যন্তরিক উত্তেজনা ততক্ষণে পৌঁছে গেছে বিস্ফোরক আত্মপ্রকাশের একটা চূড়ান্ত বিন্দুতে। কী আঁকবেন নয় আর, কী তাঁকে আঁকতে হবে, পেয়ে গেছেন তার সুনিশ্চিত ইশারা। তাই একদিনের ৬খানা স্কেচ। আর প্রথম দিনের সেই প্রাথমিক ৬টি খসড়ার মধ্যে রোপিত হয়ে গেল তাঁর ‘গের্নিকা’ ম্যুরালের বীজ। পরের দিনগুলোতেও মেতে থাকবেন খসড়ায়। পরের দিনগুলোয় প্যারিসের বাতাসে মিশবে ফ্যাসিস্ট অপপ্রচাবের কালো ধোঁয়া। তারা প্রমাণ করতে চাইবে, গের্নিকার ধ্বংসের পিছনে কমিউনিস্টদেরই চক্রান্ত। কিন্তু পিকাসোর ততক্ষণে জানা হয়ে গেছে আসল সত্য। তিনি তখন সত্যবদ্ধ। তাই সংশয়হীনও। সত্যের উন্মোচনই তখন তাঁর প্রধানতম দায়।..’
ছবি যে সব সময় আমাদের দৃশ্যকে মননের মধ্যে রেখে চিন্তার উদ্রেক করে এমন নয়, ছবি অনেক সময় আমাদের না দেখা দৃশ্যের বা ঘটনা অথবা ইতিহাসের প্রবাহ দেখতে সহযোগিতা করে। সপ্তর্ষি প্রকাশনার একটি বই। পিকাসোর গের্নিকা – পূর্ণেন্দু পত্রী। আজকের বিশ্বের গনতান্ত্রিক সভ্যতায় ছবি অনেক সময় মূল আলোচনার বিষয় হয়ে উঠছে। ছবিও কোথাও বিস্ময় হয়ে উঠছে আমাদের অগোচরে। মোনালিসা আজও সমান ভাবেই প্রাসঙ্গিক। উত্তাল বিশ্বের রাজনীতি থেকে সমাজ। নগরায়ন থেকে উন্নয়ন। আর এখানেই শিল্পী নির্মাণ করছেন ছবির কথা। কত ছবির মধ্যে আছে সমাজ বাস্তবের রূপ, কোথাও আছে বিপ্লব, কোথাও প্রেম, কোথাওবা সভ্যতার ক্ষতচিহ্ন। আমরা ধুসর পৃথিবীর কথা জেনেছি জীবনানন্দের কবিতা থেকে। একটি কবিতা ‘পেঁচা’ এখানে একটু উল্লেখ করি —

..’কার যেন দুটো চোখে নাই এ ঘুমের
কোনো সাধ!
হলুদ পাতার ভিড়ে ব’সে,
শিশিরে পালক ঘ’ষে ঘ’ষে
পাখার ছায়ায় শাখা ঢেকে,
ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে দেখে
মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে
জাগে একা অঘ্রানের রাতে
সেই পাখি-
আজ মনে পড়ে
সেদিনও এমনই গেছে ঘরে
প্রথম ফসল;
মাঠে মাঠে ঝরে এই শিশিরের সুর-
কার্তিক কি অঘ্রানের রাত্রির দুপুর!-
হলুদ পাতার ভিড়ে ব’সে
শিশিরে পালক ঘ’ষে ঘ’ষে
পাখার ছায়ায় শাখা ঢেকে,
ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে দেখে,
মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে
জেগেছিল অঘ্রানের রাতে
এই পাখি!
নদীটির শ্বাসে
সে রাতেও হিম হয়ে আসে
বাঁশপাতা-মরা ঘাস-আকাশের তারা,
বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা!
ধানক্ষেতে-মাঠে
জমিছে ধোঁয়াটে
ধারালো কুয়াশা!
ঘরে গেছে চাষা;
ঝিমায়েছে এ পৃথিবী
তবু আমি পেয়েছি যে টের
কার যেন দুটো চোখে নাই এ ঘুমের
কোনো সাধ!..’
আর এভাবেই আমরা ধুলো ধূসরিত পৃথিবীর ছবি দেখি গ্রামের সূর্য ডোবার পালায়। আসলে বোধের মর্যাদা আমরা যে সব সময় দিতে পারি বা আদৌ দিতে পারব কিনা,সে সময় বলে। জীবনের ধূসর ক্যানভাস যখন রঙের ছটায় আন্দোলিত, তখন কেউ ভাবতে পারেন তাঁর চিন্তার সমর্থনকে এবং তারপর তিনি যা বিশ্বাস করেন, সেই বিশ্বাসেই গড়তে পারেন থিম বা চিন্তা বা প্রকাশ। আমরা এই বইয়ে দেখব কীভাবে যন্ত্র সভ্যতায় এই গের্নিকা এতো আলোড়ন ফেলেছে সমগ্র বিশ্বে। আলোচনা প্রসঙ্গে আমার বইটির কথামুখ পর্বে একটু যাই। যেখানে বলা হয়েছে –
“আলোচনার বিষয়বস্তু ‘গের্নিকা’। কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতে নতুন করে আবার ‘গের্নিকা’-কে নিয়ে আলোচনা কেন? কারণ এর প্রাসঙ্গিকতা। এখান থেকেই বইটির পরিকল্পনা। যেখানে পরতে পরতে বর্ণিত হয়েছে মানুষের হাহাকার আর আর্তনাদের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। সেই আদিম কাল থেকে আজও যা জাজ্বল্যমান।
‘মানুষের সুখ অথবা দুঃখ নির্ভর করে তার সামগ্রিক কার্যকলাপ বা কর্মকাণ্ডের উপরেই। আমরা যে বাঁচি সেটাও একটি নির্দিষ্ট কর্মকাণ্ড বা কার্যকলাপেরই সমষ্টি। চারিত্রিক গুণাবলী আমাদের দেয় সেই কার্যকলাপের এক সামগ্রিক পরিচিতি। জীবনে আমরা খুশি না অখুশি, সেই দোলাচলের, এক অমোঘ মূল্যায়ন। নাটকে যেমন অভিনেতারা কেবলমাত্র একটি চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার জন্যই অভিনয় করেন না। অভিনয় করেন নাটকের সামগ্রিক চরিত্রগুলির চরিত্রায়ন ও তাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডকে একত্রিত করার জন্য।’-অ্যারিস্টটলের পোয়েটিক্স
এ তো গেল অ্যারিস্টটলের কথা। কিন্তু (ষড়যন্ত্র করে) আমাকে যে ভয়ঙ্কর দোলাচলের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হল, এখন তার থেকে মুক্তির উপায় কি? আগে আন্দাজ করলে, কখনোই রাজি হতাম না। এক দিকে পুত্র হয়ে বাবার বই-এর ভূমিকা লেখা। অন্যদিকে, বইটা আবার যে-সে বই নয়, এক্কেবারে পিকাসোর ‘গের্নিকা’। অথচ এ-বইয়ের ভূমিকা লেখার জন্য কোনো, অনুরোধ নয়, এক্কেবারে হুকুম, ভূমিকা আমাকেই লিখতে হবে। এ যেন ছেলেখেলা। একই বিষয় নিয়ে দুটি ভিন্ন মতবাদের ভিত্তিতে লেখা, দুই ভিন্ন ব্যক্তির লেখা নিয়ে, একটাই বই। লিখতে হবে তারই ভূমিকা। একা রামে রক্ষা নেই, তায় আবার সুগ্রীব দোসর। পিকসোর ‘গের্নিকা’ আর লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা ‘মোনলিসা’-র, পক্ষে-বিপক্ষে পৃথিবী জুড়ে যে আলোচনা, তা আজও চলেছে সমান তালে। আজও এই দুটি পেইন্টিং নিয়ে মানুষের বিস্ময় ও জিজ্ঞাসার কোন শেষ নেই। হাজার হাজার লেখা প্রবন্ধ বা বই আজও প্রকাশিত হয়ে চলেছে এবং ভবিষ্যতেও প্রকাশিত হবে।” অর্থাৎ সমকালীন ধারণা বা সমকালীন ইতিহাস চিন্তা নিয়েই তৈরি ছবিটা। লেখক এক জায়গায় লিখছেন –
‘..১৯৩৭-এ প্যারিসে যে ‘ইন্টারন্যাশনাল এক্সপোজিশন, তার সরকারি নাম ছিল- ‘ইন্টারন্যাশনাল এক্সপোজিশন- আর্টস অ্যান্ড টেকনোলজি ইন মডার্ন লাইফ’। শিল্প আর বাণিজ্যের মিলেমিশে যাওয়া। তার ফলেই মেলাপ্রাঙ্গনে রঙে রঙে মাতাল এক উৎসব যেন। এরই মধ্যে এক গোপন যুদ্ধ, লোকচক্ষুর অজ্ঞাতসারে এক প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া আর নাৎসি জার্মানি, এই দুইয়ের প্যাভিলিয়ন একেবারে মুখোমুখি। হিটলারের প্রিয় স্থপতি অ্যালবার্ট স্পিয়ার তাঁর জীবনস্মৃতিতে পরে জানিয়ে দিয়েছেন যে, গোপনে রাশিয়ার স্থাপত্যের নক্শার আঁচ পেয়ে গিয়েছিলেন আগেই। সেখানে দেখেছিলেন একজোড়া ভাস্কর্য প্যাভিলিয়নের শিখরে এমন দৃপ্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে যেন, জার্মান-প্যাভিলিয়নটাই তাদের লক্ষ্য। স্পিয়ার তাই তাঁর নিজের নক্শাকে এমন একটা জাঁদরেল চেহারা দিলেন, যা প্রতিরোধ করতে পারে সোভিয়েত আগ্রাসন।
‘I therefore designed a cubic mass, also elevated on stout pillars, which seemed to checking the onslaught, while from the cornices of my tower and eagle with swastika in its claws looked down on Russian sculptures. I received a golden medal for the building; so did my Soviet colleague.’
তাহলে আমরা দেখছি না জানাচ্ছি বিংশ শতাব্দীর প্রায় উত্তর সময়, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ভয়াল পরিস্থিতি আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছি আমাদের প্রতিহিংসার রাজনীতি। নারী ও পুরুষের মধ্যে নেই আর কোনরকম ভেদা ভেদ। সার্বভৌম রাষ্ট্রের আধিপত্য, হিটলারি শাসন, নাৎসি বাহিনীর অভিযান সবকিছুই যেন সেই সময়ের পৃথিবীকে করেছে উত্তপ্ত। সারা বিশ্বে কমিউনিষ্ট পার্টির দিকে দিকে আগ্রাসন। এই প্রসঙ্গে একটা ছবির কথা বলি, ‘…রাশিয়ান প্যাভিলিয়নের চূড়ায় যে ভাস্কর্য, তাতে দেখা যায় এক জোড়া শ্রমিক যুবক-যুবতী প্রাণের উৎসাহে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়ার দিকে উন্মুখ। তাদের দু-জনের মুঠোয় রয়েছে নতুনতর সমাজ গঠনের দুটি প্রকরণ, কাস্তে আর হাতুড়ি। ভেরা মুখিনা-র সে ভাস্কর্যের আসল নাম ছিল ‘ইয়ং ওয়ার্কার অ্যান্ড কালেকটিভ-ফার্ম উয়োম্যান’। স্টেনলেস স্টিল দিয়ে বানানো।..’ এই প্রতীকী মূর্তিই তখন বিশ্বের তথাকথিত সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার কথা কি বলছে না ?
কি আছে ‘গের্নিকা’-তে যে আজও তাকে নিয়ে এই বিস্তর আলোচনা? তাহলে একটা ছোট্ট বর্ণনা দেওয়া যাক ছবিটির। ছবিটির একদম ডানদিকে, ওপরে উদ্বহু হয়ে আর্তনাদরত এক ব্যক্তি। তার ঠিক পরেই আলো হাতে এক নারী। তারপর, ছবির উপরিভাগে কিন্তু ক্যানভাসের মধ্যখানে উজ্জ্বলতম বিচ্ছুরিত আলো (যা বম্বার্ডমেন্টের প্রতীকও বলা যেতে পারে, যেন হাজার গুণ, লক্ষগুণ হয়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছে সেই আলো)। তার ঠিক নিচেই একটি ঘোড়ার বিকৃত মুখ, যেখানে আর্তচিৎকারে তার জিহ্বা ধারণ করেছে ধারাল ছুরির তীক্ষ্ণ আকার। ক্যানভাসের একদম বাঁ দিকে আরো একটি ঘোড়া, তার শরীরটাকে অস্বাভাবিক ভাবে, দুমড়ে মুচড়ে, তাকিয়ে আছে পিছনদিকে। তার নিচেই ক্রন্দনরত এক নারী ধরে আছে তার সন্তানের গলা পচা মৃতদেহ। তার নিচে, একটু ডানদিক ঘেঁসে মাটিতে পড়ে আছে আহত এক পুরুষ বা যোদ্ধা, যার একটি হাত খোলা, অন্য হাতটি মুষ্টিবদ্ধ, যাতে ধরা আছে একটি ভগ্ন অস্ত্র। এখন চলে যাওয়া যাক ক্যানভাসের নিচে, একদম ডানদিকে। এখানে অসহায়, উদ্বিগ্ন এক নারী ছুটে চলেছে দিকহারা উদ্দেশ্যে, দিকচিহ্নহীন কোথাও। এই হলো মোট চরিত্র চিত্রণ। তিনজন নারী, দুটি ঘোড়া, একটি মৃত শিশু আর একজন মৃত অথবা আহত যোদ্ধা ও উদ্বাহু আরেকজন পুরুষ। এ ছাড়া পশ্চাৎপট বা ব্যাকগ্রাউন্ডে, আবছা ভাবে দেখা যাচ্ছে কিছু ভাঙাচোরা বাড়ি ঘর, ভাঙা কাঠের আসবাবপত্র, এইসব। শুধুমাত্র সাদাকালো ছবি আর আবছায়া ধুসর কালি দিয়ে তৈরি নয়, আসলে জীবনের ক্রোধ ও বোধের দীপ্ততা এবং অতি সংশয় ও তারই সাথে সবুজ জীবনের এক অনাবিল সংকেত বয়ে নিয়ে আছে এই গের্নিকা। বইটির এক জায়গায় আলোচনা হয়েছে যে,এই গের্নিকা’র ম্যুরালে কেন এত নারী?
– এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয়েছে একবার আর্নহাইমের রচনায়। এই একই প্রশ্ন আবার, ওপলারেও। ‘গের্নিকা’-র দুই প্রান্তে দুই নারী। দুই জননী। একজন তার মৃত সন্তানকে নিয়ে আর্ত চিৎকারে শূন্যের দিকে উঁচু করে তুলেছে তার অসহায় আর্ত মুখ। অন্যজনও সেই একই রকমের অসহায়তার আগুনে দগ্ধ হতে হতে বাঁচার আকুতিতে অস্থির। দুই উত্তোলিত হাতে সাহায্যের জন্যে আবেদন। তৃতীয় নারীটি পালাতে চাইছেন প্রাণরক্ষার তাগিদে। আলো-বাড়ানো নারী আগেই আলোচিত। কারা এই নারী? ওপলার বলছেন, এরা চিরকালের নারী। এদেরই বইতে হয় সমস্ত পতনের দায়, সমস্ত রক্তক্ষরণের জ্বালা। ক্রুশবিদ্ধ যিশুকে কোলে নিয়ে যে মা, সেই আদি মাতৃপ্রতিমাই ইতিহাসের নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এখানে পৌঁছে গেছে এক প্রতিবাদী চরিত্রে, এক ‘প্রোটেস্ট ইমেজ’-এ। ‘গের্নিকা’-র আগেও আঁকা হয়েছে যত বিদ্রোহ-বিক্ষোভের ছবি, নারীচরিত্ররা সেখানেও প্রধান ভূমিকায়। গেইয়ার ‘রেকেজ অব ওয়্যার’ কিংবা ‘টুথ ইজ ডেড’ ছবিতে নারীই কেন্দ্রীয় চরিত্র। অথবা প্যারিসের প্রধান রাজপথ সাঁজালিজেয় রয়েছে যে ‘আর্ক দ্য ট্রায়াম্ফ’ নামে ভাস্কর্যময় তোরণ, তার শীর্ষদেশেও খোলা তলোয়ার হতে এক নারী, যোদ্ধা বাহিনীকে দেখিয়ে দিচ্ছে মুক্তির পথ। এর আরও বড়ো নিদর্শন দেলাক্রোয়ার ‘লিবার্টি’ লিডিং দি পিপল’। নারী আর লিবার্টি এখানে অঙ্গীভূত। নারী আর মুক্তির বাসনা সমার্থক। পিকাসোর বেলায় তাঁর অতিরিক্ত নারীপ্রীতি অবশ্য একটা বাড়তি প্রবণতা। তাঁর সারা জীবনের ছবিতে নারীই প্রধান উপকরণ। ‘গের্নিকা’-র নারীচরিত্রদের পিছনে কাজ করছে তাঁর স্বাভাবিক নারী-প্রবণতা, তা নিয়ে মাথা ঘামানো থামেনি এখনও সমালোচকদের। সেসব তাত্ত্বিক আলোচনার বাঁকা সড়ক থেকে সরে এসে আমরা অন্যভাবেও পৌঁছতে পারি তাঁর নারীচরিত্রের উৎসে। গের্নিকা ধ্বংসের খবর পাওয়ামাত্র পিকাসোর স্মৃতিতে ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল মালাগা-য় ১৮৬৪-র ভয়াবহ ভূমিকম্পের দৃশ্য। সে দৃশ্যের প্রধান চরিত্র তাঁর মা। তখন-‘My mother was wearing a kerchief on her head.’ মায়ের গর্ভে তখন বোন লোলা। গের্নিকা ম্যুরালের জন্যে প্রতিদিন এঁকে চলেছিলেন যেসব খসড়া, তার মধ্যেই একসময়ে এসে যাচ্ছিল শিশু-সন্তানকে আঁকড়ে এক পলায়নোদ্যত নারী, নানা ভঙ্গিমায়। গবেষকদের অনুমান, সে নারীর স্ফীত বক্ষ জানিয়ে দিচ্ছে, পূর্ণ গর্ভবতী। আর ম্যুরাল আঁকা হয়ে যাওয়ার পরও কান্নায় ভেঙে-পড়া বিকট যেসব নারীর মুখের ড্রয়িং বা এচিং বা তেলরঙের ছবি এঁকে চলেছিলেন তিনি একের পর এক, আর অগুনতি, সেখানে বারবারই ঘুরে আসছিল দুটো জিনিস- মাথা ঢাকার আর হাতে ধরার দু-রকমের রুমাল। রুমাল মুখে চেপেই আকাশ-ফাটানো কান্নার আকৃতি সব। এই সব রুমাল তাঁর মায়ের স্মৃতি থেকে পাওয়া। রুমাল ছাড়া দুটো-একটা ছবিতে যে অভিজাত টুপি, তা বান্ধবী ডোরা মারের।। ‘উইপিং উয়োম্যান’ বা ‘কান্নার নারী’ সিরিজের ছবিতে ডোরা মারই মডেল অনেক জায়গায়।…’ এরই সাথে আলোচনা হয়েছে, ‘… গের্নিকা’ প্রধানত সাদা-কালো ছবি, ধূসরতার প্রলেপ সহ। ব্লু পিরিয়ডের ছবিতে যেমন তাঁর পরীক্ষা ছিল একটা বিশেষ রঙের থেকে নিংড়ে নেওয়া যেতে পারে কত রকমের বর্ণস্তর, গের্নিকাতেও সেই একই অনুশীলন। স্প্যানিশ প্যাভিলিয়নে প্রদর্শনের পর থেকে এ ছবি সারা বিশ্বে মোটামুটি একরঙা ছবি হিসেবে স্বীকৃত হলেও, অনেক নাটকীয় ঘটনা ঘটে গেছে এর প্রস্তুতিপর্বে। একটা সময়ে রং নিয়ে পরীক্ষার পাগলামি চেপেছিল তাঁর মাথায়। ছবির ‘ফিকশন’কে ‘রিয়ালিটি’-র সঙ্গে মেলানো যেতে পারে কি না, ভাবছিলেন তখন সেই সমস্যার সমাধানের রাস্তা।
‘গের্নিকা’ ম্যুরাল যখন তার চতুর্থ পর্যায়ে, তখন দেখা গেল ছবির এক জায়গায় তিনি এঁটে দিয়েছেন রঙিন নক্শাদায় ওয়াল-পেপার। কিন্তু পঞ্চম পর্যায়ে তা উধাও। আবার ষষ্ঠ পর্যায়ে ফিরে এল তা। এবারে তিন জায়গায়, তিন রকমের রঙিন কাগজ। মৃতশিশু কোলে নারীর শরীরে। পলায়নপর নারীর কাঁধে। আগুনে-পুড়তে-থাকা নারীর কোমরের দিকে। আপাতবর্ণহীন অথবা একবর্ণের সংহতিতে আঁটোসাটো এই ছবির উপর রঙিন কাগজ এঁটে সত্যি সত্যিই ছবিতে রঙের ব্যবহারের কোনো দুঃসাহসিক পরীক্ষায় মাততে চেয়েছিলেন পিকাসো, ওপলার তা বিশ্বাস করতে নারাজ। কিন্তু তাঁর এই সংকলনেই রয়েছে ‘ভিজিটর্স টু দি স্টুডিয়ো, জুন ১৯৩৭’ নামের যে বিভাগ, সেখানে ওপলারই সংগ্রহ করে দিয়েছেন প্রতাক্ষদর্শীদের বিবরণ।..’
বিপরীতে প্রশ্নও ওঠে আবার অনেক আগে থেকেই, ‘…কেন এত নারীপ্রাধান্য তা নিয়ে শেষ নেই শিল্প-গবেষকদের অনুসন্ধানের। জন বার্জার-এও রয়েছে তার ফ্রয়েডীয় ব্যাখ্যা। এই আলোচনার অঙ্গীভূত দ্বিতীয় বই ওপলারের পিকাসোস গের্নিকা-তেও রয়েছে নানা সংগত অনুমান। সে কথা শোনা যাবে যথাসময়ে। আপাতত আর্নহাইমের যুক্তিটাই শোনা যাক শুধু। তিনি জানাচ্ছেন, আক্রমণের সময় গের্নিকায় নারী শিশু আর বৃদ্ধরাই ছিল প্রধান বাসিন্দা। পুরুষেরা যুদ্ধে, সেনাবাহিনীতে। সেই কারণেই নারী বা শিশু সহ মায়ের উপর এতটা গুরুত্ব।
স্পেনের গণতন্ত্রী সরকারের কাছ থেকে পিকাসো ম্যুরাল আঁকার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন জানুয়ারির গোড়ার দিকের কোনও একটা তারিখে। সম্মতি জানিয়েছিলেন ৮ জানুয়ারি। কিন্তু তখুনি কাজে হাত লাগাননি। মনোযোগ দেননি কোনও খসড়া রচনারও। তবে এপ্রিলের কয়েকটা দিন ঘুরে ঘুরে দেখেছেন স্প্যানিশ প্যাভিলিয়নের নির্মাণপর্ব।
গত বছরের জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বরে নিজের মাতৃভূমিতে ফ্যাসিস্ট ফ্রাংকোর উদ্ভব, নাৎসিবাদের ক্রমবিস্তার, গৃহযুদ্ধের শুরু, গারসিয়া লোরকার হত্যা, গণতন্ত্রী স্পেন-সরকারের ভ্যালেনসিয়াতে আশ্রয় নেওয়া মাদ্রিদ ছেড়ে, গণতন্ত্রী সরকারের সমর্থনে ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেডের জন্ম, এ সবই হানা দিয়ে চলেছিল তাঁর বোধে। কিন্তু তখনও ফ্রাংকোর অপশাসনের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ এচিং ছাড়া আর কোথাও ছাপ ফেলেনি তাঁর অবরুদ্ধ ক্ষোভ-বিক্ষোভ। মাতেন নি বৃহত্তর কোনো সৃজন-ভাবনায়। বৃহত্তর কোনো সৃজন-ভাবনায় তাঁর অস্তিত্ব অধিকৃত হয়ে থাকলে, গণতন্ত্রী সরকারের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ পাওয়ার অব্যবহিত পরেই তিনি নিশ্চয় ছকে ফেলতে পারতেন তাঁর অন্বিষ্ট ম্যুরালের খসড়া। কিন্তু ছকেন নি। ছকা-র শুরু মে মাসের ঐতিহাসিক প্রথম দিনটি থেকে। এপ্রিলে ফ্রাংকোর আর তার পৃষ্ঠপোষক হিটলার বাহিনীর বর্বরোচিত বিমান আক্রমণে গের্নিকার পতনের সংবাদ ফরাসি পত্রপত্রিকায় প্রথম বেরয় ২৮ এপ্রিল। পিকাসো পড়লেন ভস্মীভূত গের্নিকার ট্রাজেডি। দেখলেন অগ্নিদগ্ধ শহরের বিকট সব ফটোগ্রাফ। এই নিদারুণ বাস্তবতার বশীফলকে আক্রান্ত হওয়ার অল্প ক-দিনের মধ্যেই গের্নিকা ম্যুরালের খসড়ার শুরু। এখানে প্রশ্ন জাগে, এপ্রিলের শেষদিকে গের্নিকার পতন না ঘটলে কী আঁকতেন তিনি। কোন বিষয় আকৃতি পেত তাঁর ম্যুরাল? তাহলে কি এই সুযোগে এমনটাও ভাবা যেতে পারে যে, গের্নিকার ধ্বংসই বিষয়-অন্বেষণের জটিলতা থেকে মুক্তি দিয়ে অনেকখানি সহজ করে দিল তাঁর ম্যুরাল রচনার কাজ?
সহজ? সহজ, না কঠিন? কঠিন, না কঠিনতর? সহজের বিপরীত ভূমিতেই কি তিনি বেছে নেননি তাঁর অবস্থান? ভাবতে দ্বিধাগ্রস্ততা এলেও এটা তো বাস্তবে সত্যি যে ধ্বংসলীন গের্নিকাকে ম্যুরালের বিষয় হিসেবে বেছে নেওয়াটাই ছিল তাঁর দিক থেকে একটা দুর্দান্ত চ্যালেঞ্জ, দুঃসাধ্য সাধনের এক ব্রত।..’
তাই এভাবেই খসড়া নির্মাণ হয় যুগে যুগে। সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে শিল্পীর চোখ,শিল্পের প্রয়োগ পরিবর্তিত হয়েছে বার বার। তবুও শিল্পীর অনুমান ও সামাজিক অনুষঙ্গ কোথাও যেন অনেকটা এগিয়েছে শিল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে। ধনতান্ত্রিক সভ্যতার ক্রমশ অবলুপ্তি এবং বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মানুষের অধিকারের লড়াই,মানবজাতির ক্রমবর্ধমান বিকাশের পথে শিল্পীর দেখার দৃষ্টি ভঙ্গী যেভাবে আরও যেন মুক্ত হয়েছে। আসলে এই ছবিও কোথাও তাঁর প্রতিবাদ। বলা বাহুল্য – ‘ এদিকে ফ্রাঙ্কো আর তার পৃষ্ঠপোষক হিটলার বাহিনীর বর্বরোচিত বিমান আক্রমণে মানব সভ্যতা ধ্বংসের খবরাখবর প্রতিনিয়ত পৌঁছে যাচ্ছে তাঁর কাছে ঠিক ঠিক সময়ে। লেখক বলছেন ‘এই দোদুল্যমান সময়েই গের্নিকার উপর ফ্যাসিস্ট আক্রমণ। আক্রমণের দু-দিন পর ২৮-২৯ এপ্রিল প্যারিসের ‘লুমানিভে’-র পাতা পিকাসোর সামনে মেলে ধরল ছবিসহ সে আক্রমণের বিস্তৃত আর বীভৎস বর্ণনা। প্রথমে স্তম্ভিত। ক্রমে রক্তের ভিতরে ক্রোধের সংক্রমণ। অস্তিত্বের গোপন গহ্বর ঠেলে ঝাঁকুনি দিয়ে জেগে উঠল তাঁর বিদ্রোহী সত্ত্বা।’ গের্নিকার পতনের সংবাদ ফরাসি পত্রপত্রিকায় প্রথম পড়লেন পিকাসো। ভস্মীভূত গের্নিকার ট্র্যাজেডি, সেই সঙ্গে মৃত্যু মিছিল আর মানুষের আর্তনাদ। দেখলেন অগ্নিদগ্ধ শহরের বিকট সব ফটোগ্রাফ। এই নিদারুণ বাস্তবতায় আক্রান্ত হওয়ার অল্প ক-দিনের মধ্যেই আমাদের সকলের পরিচিত গের্নিকা ম্যুরালের খসড়ার শুরু।’…বাকিটা ইতিহাস।
পিকাসোর গের্নিকা / পূর্ণেন্দু পত্রী/ সপ্তর্ষি প্রকাশনা/ মূল্য -২০০.০০



Be First to Comment