ধীমান ব্রহ্মচারী
কবিতার ভাষা ও ছন্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো কোনো শিল্পীর যে অভাবনীয় ক্ষমতা থাকে এক একসময়,সেই উদাহরণ খুব সহজেই চোখে পড়বে পাঠকের,যখন একজন পাঠক নিবিড় ভাবে পাঠ করবেন একটা লাইব্রেরি ভর্তি বই নয়, একটি বই ভর্তি লাইব্রেরির কাঙ্ক্ষিত আত্মকথন। সম্ভবত এই ধরনের বই বাংলা কবিতায় ইতিপূর্বে লেখা হয়েছে কিনা সে বিষয়ে সন্দিহান আছে। যদিও আমরা যারা একটু সাহিত্য-নির্ভর জীবন যাপনে বাঁচি, একটু আধটু বই পড়তেই হয়, তাঁরা সকলেই জানেন, আমাদের সংবাদ প্রতিদিনের একটা গদ্যের বিনামূল্যে পাওয়া একটা ম্যাগাজিন, যেখানে সাহিত্যিক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় একটা ধারাবাহিক ‘ রোববারের লাইব্রেরি খোলা ‘। কী অদ্ভুতভাবে তিনি শুধুমাত্র বাংলা বই নয় বা ইংরাজি বই নয়, প্রায় বিশ্ব ইতিহাসের নানান বই নিয়ে লিখতেন। আর এই বইটা শুধুই লাইব্রেরি নিয়ে একক কবিতার বই। যার বিষয় সম্পর্কে বলতে গিয়ে কবি বলছেন — “নির্জন দুপুরে পাঠহীন জীবনে কখন যে এক লাইব্রেরি গজায়! আচমকা সমস্ত শরীর বই হয়ে যায়, তারপর নিজেকেই নিজের পড়ে চলার শুরু। একদিকে এ বই বন্ধ হয়ে যাওয়া লাইব্রেরির অন্ধকারে গুমরে মরা অমূল্য বইগুলির কথা বলে, অন্যদিকে যৌন প্রতিমার রূপকে পাঠক আর লাইব্রেরির পরাগসংযোগ ঘটাতে চায়। ‘আমাকে নেবে না লাইব্রেরি?’ এ আকুতি জন্মান্তর ঘটে যাওয়া পাঠকের।” সাধারণত এক একাগ্র বইপ্রেমীর ক্ষেত্রে ‘লাইব্রেরি ওয়ার্ক ‘ একটি বিশেষ কাজ। বিরাট বইয়ের ভাণ্ডার থেকে পাঠক নিবিড়ভাবে ও সার্বিকভাবে তাঁর বইয়ের রসাস্বাদন করেন। তাই লাইব্রেরির সঙ্গে একজন পাঠকের সম্পর্ক হয়ে ওঠে মধুর এবং বিশ্বাসযোগ্য বন্ধুত্বপূর্ণ। কিন্তু এক্ষেত্রে আমার একটি প্রশ্ন মাথায় আসছে,এতো ধরনের কবিতার বিষয় থাকতে এই ধরনের একটি বিষয় নিয়ে কবি কবিতা লিখতে গেলেন কি অভিপ্রায়ে। বইটির ‘ তাকে তাকে বই ‘ শীর্ষক একটি কবিতা —
‘বহুদিন ইচ্ছে ছিল একটা গোপন লাইব্রেরি,

তিরিশ বছর গেছে, এ আর এমনকি দেরি?
খুলল তো শেষ অব্দি, শরীরের তাকে তাকে বই!
করো আকণ্ঠ পাঠ, অক্ষর শব্দ সমস্তই!
আমার স্তনাগ্রে ধর্ম, সোনালি ত্রিভুজে দর্শন,
বাহুমূলে ইতিহাস, উরুস্তম্ভে জৈব রসায়ন,
হালকা চটুল পাঠ খেলা করে আঙুলে আঙুলে,
হে পাঠক, এসো নাও, বর্ণসব ঠোঁট দিয়ে তুলে।’
কবিতাটা নির্মাণ হয়েছে আট লাইনে। এক্ষেত্রে নির্মাণ শব্দটা ব্যবহার করলাম এই কারণে যে এই বইয়ের কবিতাগুলোকে কবি প্রথমে তাঁর মস্তিষ্কে একটু একটু রূপ দিয়েছেন,এবং পরবর্তীতে একটা কবিতার জন্ম দিয়েছেন। এবং এই কবিতায় দেখা যায় অন্ত মিলের একটা প্রবণতা এমনকি এটি কার্যকরও হয়েছে সু – নিপুণভাবে। অর্থাৎ অ+অ, আ+আ, ই+ই এবং ঈ+ঈ এই অন্তমিল কবিতার স্বাভাবিক মাত্রাকে করেছে বিশেষ পাঠযোগ্য। এবং এই কবিতায় একটা লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার সম্পূর্ণ নিজেই এক অস্তিত্ব। ফলে সেই লাইব্রেরি নিজের রূপ ও গঠনের সঙ্গে পাঠককে জানাচ্ছেন আহ্বান। ‘ খুলল তো শেষ অব্দি, শরীরের তাকে তাকে বই! ‘ একটা পরিত্যক্ত লাইব্রেরি দীর্ঘদিন বন্ধ হয়ে রয়েছে। আজ প্রায় তিরিশ বছর পর সেটা উন্মুক্ত হয়েছে,ফলে পাঠকের ভীষণ রকম প্রত্যাশী। তাই নিজের অতৃপ্তার স্বাদ পূরণের জন্য যেন পাঠককে একরকম কামনা করছে।
পরের লাইনের লিখছেন কবি –
‘আমার স্তনাগ্রে ধর্ম, সোনালি ত্রিভুজে দর্শন,
বাহুমূলে ইতিহাস, উরুস্তম্ভে জৈব রসায়ন, –
অর্থাৎ বক্ষের স্তনের ওপর রয়েছে ধর্ম। এবং এখানে ধর্ম বলতে ‘পাঠ ‘। এমনকি বিজ্ঞান – কলা – থেকে ইতিহাস সবই কিন্তু একটা লাইব্রেরির শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। আরও একটা কবিতায় –
‘দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি,
আলো জ্বলছে,
দেখতে পাচ্ছি
তোমার চিবুক,
ডান ও বাম পাতা
পরম আদরে ধরে আছে,
দেখামাত্র জেনে গেছি ধর্ম কী তোমার,
জানলা ফুঁড়ে মাথা যার আকাশ ছুঁয়েছে,
সে তো পাঠক এক, আজন্ম, আগ্রাসী,
আলো দেখে পতঙ্গের মতো এগিয়েছি,
কালকেও দেখিনি যা, আজ তা স্পষ্ট হল মায়া-গোধূলিতে,
মহুয়াগাছের নীচে, বাঁশপাতি পাখির ছায়ায়,
তাহলে লাইব্রেরি খুলল শেষমেশ,এই পাঠরুদ্ধ পাড়াতেও।( পাড়ার লাইব্রেরি খুলল)
এখানে দেখুন কীভাবে একটা ঘটনা প্রত্যক্ষ করছেন কবি। সম্প্রতি আমাদের শহরের অনেক লাইব্রেরি গুলোর অবস্থা খুবই শোচনীয়। একের পর এক লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে গেছে,কিছু কিছু টিম টিম করে জ্বলছে। যার ফলে একটা সামগ্রিক লাইব্রেরির চেহারা আমাদের কাছে কেমন একটা বিভীষিকার মতো। আলমারি ভর্তি ভর্তি বই,সবই আছে,ঝিমিয়ে। একে অপরের গায়ে হেলে পড়েছে,কেউ ঘুমিয়েছে অনন্ত কাল ধরে। ‘আলো জ্বলছে,/দেখতে পাচ্ছি/তোমার চিবুক,- এতো আসলে সেই লাইব্রেরির নিজস্বতার একটা পরিচয়।এই লাইব্রেরির কথা আলোচনা করতে করতে আমার নিজের লাইব্রেরির কথা মনেপড়ে। বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ার সময়,প্রচুর বই পড়তে হবে। গল্প,উপন্যাস,নাটক। পেকেটের জোর থাকলে তো এতো বই কেনা যায়। তাই লাইব্রেরির মেম্বারশিপ নেওয়া গোলপার্ক লাইব্রেরি, ন্যাশানাল লাইব্রেরি,সেন্ট্রাল লাইব্রেরি। দিনের পর দিন পরে থাকতাম রিডিং রুমে। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ,শরৎ,মানিক, বিভূতি,তারাশঙ্কর থেকে শুরু করে একের পর এক বাংলা সাহিত্যের লেখকদের অনন্য সৃষ্টি পড়ছি। সেই সকাল এগারোটায় এসে যেতাম আর বেরতাম সেই রাত আটটা। এখানে ‘ আলো জ্বলছে’ বা ‘ তোমার চিবুক ‘ এই শব্দ গুলো অসাধারণ উপমায় ব্যবহার হয়েছে। একটা ঘর,অজস্র বই। কত গোপন কথা লুকিয়ে থাকে পাতার ভাঁজে। কত প্রেম,কত পরকীয়া,কত সংগ্রাম কালির পর কালি দিয়ে লেখা বইয়ের পাতায় পাতায়। তাছাড়া কবিতার বইটার মধ্যে আছে আরও কিছু কবিতা –
‘ এমনিতে আমার যে কোনো সমস্যা হচ্ছিল তা নয়, আমার কান দুটো একইরকম ছিল, ঝুলে পড়া,
আমার শিরদাঁড়া, রেশমি উলের,
চামড়া খুব মোটা, দুর্ভেদ্য
শুধু স্তনের নীচে একটি গোপন অশ্রুমতী নদী, কেউ জানতে পারেনি
সেই নদীর ধারে এক আশ্চর্য দুপুরে একটা লাইব্রেরি গজাল,
আমার সমস্ত শরীর বই,
আমি নিজেকেই নিজে পড়ছি, পড়ে চলছি অবিরাম…
অসাধারণভাবে কবিতার শব্দ দিয়ে নির্মাণ করছেন কবি। স্বাভাবিকভাবেই বই যখন নিজেই হয়ে ওঠে একটা প্রাণ -একটা জীবন -একটা প্রস্তাব -একটা আকুতি – একটা কামনা — এই পর্যায়ে এসেই কিন্তু বইয়ের কবিতা অনেকটা উত্তীর্ণ হয়েছে দুটো প্রাণের যৌন রূপে। পাঠকের প্রেম – বইয়ের সঙ্গে তাঁর সংযোগ এবং সঙ্গম এতো সর্বজনবিদিত। কবিতার মধ্যেই পেয়ে যায় দুটো রক্ত মাংসের মানুষ। যারা মনে প্রাণে চায় একে ওপরে সাথে সম্ভোগ। অসাধারণ বাঙ্ময়তায় কবি এই গ্রন্থ নির্মাণ করেছেন। কবিতা প্রেমী পাঠকের কাছে এই বই এক রসাস্বাদনের বিষয় হয়ে উঠতেই পারে।
লাইব্রেরি শার্ট খোলো – তৃষ্ণা বসাক/ প্রকাশনা – ধানসিড়ি / মূল্য ১৪০.০০




Be First to Comment