Press "Enter" to skip to content

গরানহাটির কীর্তনীয়া: কীর্তনের সুতোয় গাঁথা ঘটনাক্রম

সুদেষ্ণা গঙ্গোপাধ্যায়

যখন কোনো রোমান্টিক উপন্যাসের শুরু হয়, দুপুর বেলার শিল কাটাইওলা, মিশি বিক্রেতার হাঁক, কাঁসার বাসনওলার ট্যাং ট্যাং কাঁসরের আওয়াজ দিয়ে, পাঠকের মনের মধ্যে বাজতে থাকে এক নতুন তাল। উপন্যাসের ঘটনা ক্রম কেমন ভাবে উপস্থাপিত হতে চলেছে তার উত্তেজনায় স্নায়ু রাজ্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাপস রায়ের ‘গরানহাটির কীর্তনীয়া’ প্রকাশ হয়েছে ২০২৪-এর বইমেলায়। লালমাটি প্রকাশনার হাত ধরে।

বাংলার কীর্তন চিরকালের। জগত জোড়া তার নাম, আবেদন। আর সেই কীর্তন হয়ে উঠেছে তাপস রায়ের উপন্যাসের বিষয়। এই কীর্তনকে ঘিরে তৈরি হয়েছে বেশ কিছু ঘটনা, উপ-ঘটনা। উঠে এসেছে তৎকালীন সমাজ প্রেক্ষাপট। প্রেম, ষড়যন্ত্র, কম্যুনিস্ট আন্দোলন। আর এই প্রতিটি ঘটনা গাঁথা হয়েছে কীর্তনের সুতো দিয়ে।

উপন্যাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ঋষভ। সে বাঁশি বাজায়। তার বাবার থেকে তার বাঁশি শিক্ষার শুরু। নিয়ম ভাঙা এক রাখালীয়া সুর বেজে ওঠে তার বাঁশিতে। সে নির্লোভ, সহজ, সরল, একনিষ্ঠ, প্রতিভাশালী বাঁশি বাদক। সংসার জীবনে আর পাঁচটি পুরুষের মতো সে নিখুঁত নয়। তার বিধবা, নিঃসঙ্গ মায়ের দায়িত্ব সে নিতে অপারগ, কারণ সে নিজেই থাকে শ্বশুরের বাড়িতে, গলগ্রহ। মিলের কাজ হারিয়ে কোণঠাসা। কিন্তু মাটির সঙ্গে তার যোগ নিবিড়। শিলকাটাই ওলার চোখের ভাষা তাই সে বুঝতে পারে সহজেই। ওই অশিক্ষিত, গ্রাম্য শিল কাটাইওলা যখন বলে, “…. আমার ওই এক জেদ, বিশ্বকর্মার ইচ্ছেয় আমার বাপ-পিতামোর শেখা শিল্প আমি নষ্ট করি ফ্যালব।… . লোকে কতো ,আমার বাপ শিল কাটে না। পাথরের বুকি আলপনা দেয়।…প্যাডের খিদের জন্যি মনের খিদেরে মারি ফেলব!” এক অসাধারণ শিল্প পরম্পরার ছবি এঁকেছেন লেখক। আর বিনিসুতোয় গেঁথেছেন ঋষভ ও শিল কাটাইওলার শিল্পী মন। শিল কাটাইয়া হয়ে উঠেছে দার্শনিক।তার সহজ অথচ গভীর কথায় ঋষভের মনের কুয়াশা এক ঝটকায় সরে গেছে। সে তার বাবার দেওয়া শিক্ষাকে আবার আপন করে নিয়েছে।অন্তরের ব্যথায় ভেসে গেছে তার বাঁশির সুর।

উত্তর কলকাতার পটভূমিতে লেখা উপন্যাসটির মূল বিষয় কীর্তন। রেনেটি ঘরানা, গরানহাটি ঘরানা,কুমুর মিশ্রিত কীর্তন, শ্রীখণ্ডের কীর্তনীয়ারা একে একে উপস্থিত এক এক চরিত্রে। তেমনি এক চরিত্র গিরিরাজ আচার্য। সে একাধারে বিখ্যাত কীর্তনীয়া, কীর্তন সঙ্ঘের মাথা। আবার এক উঠতি প্রতিভাময়ী কীর্তন গায়িকার পিতা। যার মনে নিজের গান নিয়ে আছে প্রচণ্ড অহঙ্কার। কীর্তন দুনিয়ার এক চুল জায়গা ছেড়ে দেবার পাত্র নয় গিরিরাজ আচার্য। তার আসন পাকা জেনেও অনিশ্চয়তা সদা সর্বদা তাড়িয়ে নিয়ে বেরায় গিরিরাজ। সেই অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেতে ষড়যন্ত্র করতে পিছু পা হননি এই মানুষটি। আদিম ইচ্ছার প্রায় সবগুলি এই গিরিরাজ চরিত্রে আমরা দেখতে পাই। লেখক বড় যত্ন করে সাজিয়েছেন খল চরিত্রের গিরিরাজকে। কীর্তন দুনিয়ার গিরিরাজ হয়েও, তার চরিত্রে আত্মপ্রত্যয়ের অভাব দেখি। আর এই অভাব গিরিরাজে ফাটল ধরিয়েছে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে যত ধরনের অপরাধ করতে হয়, সবগুলো করেছেন গিরিরাজ। দল ভেঙেছেন, শিল্পী চুরি করেছেন, নিজের স্ত্রীর শিল্পী জীবন শেষ করে দিয়েছেন। নিজের মেয়ের বিরুদ্ধে ময়দানে নেমেছেন। শেষ করে দিতে চেয়েছেন মেয়ের শিল্পী জীবন ও জনপ্রিয়তা। খুন করাতে চেয়েছেন পুরোনো সহশিল্পী ভানু বোসকে। বড় নির্মম এই গিরিরাজ আচার্য। তারপরও এক অনন্য চরিত্র হয়ে উঠেছে এই গিরিরাজ, লেখকের কলমের মুন্সিয়ানা অনস্বীকার্য।

অপরাজিতা চরিত্রটিকে বেশ মর্ডান করে গড়া হয়েছে। উনিশ তেতাল্লিশ-চুয়াল্লিশের সমসময়িক কোনো অল্পবয়সী মেয়ের থেকে অপরাজিতা বেশ সাহসী,আত্মবিশ্বাসী। অনেক বেশি দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। এই সময়কালের কলেজে পড়া মেয়ে মানেই সে আধুনিকা। আর পুরোনো প্রেমিককে সে যখন শ্রীরামপুর ফেরি ঘাটে বড় রাস্তার ওপর চুমু খাওয়ার সাহস দেখায়, তখন সত্যিই মনে হয় অপরাজিতা সমকালের থেকে অন্ততঃ পঞ্চাশ বছর এগিয়ে আছে। উপন্যাস যত এগিয়েছে অপরাজিতার সাহসিকতার পরিচয় আমরা পেয়েছি। তার চরিত্রের দৃঢ়তার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। সাহসী তাই সে ডাকসাইটে কীর্তনীয়া গিরিরাজ আচার্যকে টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ঋষভ বিবাহিত, সন্তানের পিতা জেনেও সে তার ভালোবাসা নিবেদন করতে পিছপা হয়নি। অপরাজিতা যে সত্যিই অপরাজিতা তার অনেক উদাহরণ পাই সমগ্র উপন্যাস জুড়ে।

ভানু বোস চরিত্রটি এক ফ্যাক্টরীর ইউনিয়ন নেতার। কমিউনিজম কিভাবে স্বাধীনতার আগে বাংলার মাটিতে ছড়িয়ে পড়ছিল, খেটে খাওয়া মানুষের সংগ্রাম কিভাবে নিজেদের দাবি আদায় করছিল, তার পরিচয় রেখেছেন লেখক। ভানু বোস চরিত্রটি দরদী, সাহসী জননেতা ও অসাধারণ খোল বাদকের ।

একটি বিষয় এখানে অবশ্য উল্লেখ্য উপন্যাসটি লেখা হয়েছে জাম্প কাট থিওরি মেনে। অদ্ভুত মুন্সিয়ানায় এক দৃশ্য থেকে অন্য দৃশ্যে ঘটনাক্রম এগিয়ে গেছে। ঋষভ ও অপরাজিতার ঘনিষ্ঠ দৃশ্যের অসাধারণ বর্ণনায় পাঠক যখন ডুবে গেছে পবিত্র মিলন আবহে ,ঠিক সেই মুহূর্তে লেখক নিয়ে এসেছেন চরম বাস্তব ভানু বোসের গেম প্লান, মিলের মিটিং,নয়নতারার লড়াই- এর কথা। নয়নতারা চরিত্রের মাধ্যমে পাঠক পরিচিত হয় লড়াকু মহিলা চরিত্রের সঙ্গে। যে হাসতে হাসতে খুন করতে পারে তার স্বামীর অত্যাচারীকে।

একটি বিষয়ে লেখকের সীমাবদ্ধতা লক্ষনীয়। সেটি হল যে সব জায়গায় হিন্দি ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে হিন্দি ভাষী চরিত্রের মুখে,সেখানে ব্যাকরণগত ছোটো খাটো ত্রুটি আছে। আর একটি বিষয়ের ক্ষেত্রে পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, একটি জায়গায় লেখক উপন্যাসের সময়কাল অনুযায়ী সংলাপ লিখতে পারেননি। পঞ্চম পর্বে ঋষভের মেয়ে যেখানে অপরাজিতার ফোন ধরে বলছে, “বাবা তোমার ফোন। কেউ একজন আন্টি তোমার খোঁজ করছে”, এক্ষেত্রে লেখকের কাছে আমার বিনীত প্রশ্ন এই সময়কালে আন্টি সম্বোধন সচরাচর করা হত কি?

উপন্যাসের আরও অনেক চরিত্র এসেছে স্বাভাবিক নিয়মে এবং কোনো চরিত্র অন্য চরিত্রের ভিড়ে হারিয়ে যায়নি। প্রত্যেক চরিত্রের প্রতি লেখক যথাযোগ্য সুবিচার করেছেন।

লালমাটি প্রকাশনের মুদ্রণের কাজ অত্যন্ত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। আলাদা করে কিছু বলার নেই। তবে প্রচ্ছদ উপন্যাসের মান ছুঁতে পারেনি, আরও অনেক ভালো হওয়ার দাবি রাখে।

সবশেষে বলতে হয় এমন একটি অসাধারণ, পরিপূর্ণ ঐতিহাসিক পটভূমিকায় লেখা উপন্যাস বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে এক অসামান্য সংযোজন। লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা এমন একটি উপন্যাস পাঠকের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য।

গরানহাটির কীর্তনীয়া/ তাপস রায়/ লালমাটি/ দাম: ৩০০টাকা

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *