উৎপল মণ্ডল
গত শতকে পিতৃ-তর্পণ বলে কিছু দেখিনি। পিতৃদেবরা তাদের পিতামহদের জায়গা ছেড়ে চলে এসেছে। তার উপর দু-মুখো সময়। মানে অভাব! নিদারুণ অভাব। মাঠে সবে ধানের থোঁড় এসেছে। উচ্চফলনশীল ধান আরও দূরে। গেঁতি ধান বলে এক রকম ধান ছিল সবার আগে। এই ধান পাকত। আমরা ছাত্রবন্ধু নিয়ে পাকাধান পাহারা দিতাম। বালুই পাখি সব ধান খেযে নিত। এ সময়ে ঘরে চাল বাড়ন্ত। তারপরে ঘরে ঘরে ‘দেশের ভাব’ (ডায়ারিয়া) কারণ পানীয় জলের বিশুদ্ধতা। তখন গ্রামে সার্ফ এক্সেল ঢোকেনি, বহুজাতিক সানলাইট ও শহরের সাবান।
এইরকম সময় আকাশে মেঘেরা ঘুরে বেড়াত। মহালয়ার ভোরের আগে রাত দুপুরে কলার কাঁধি থেকে কলা কাটত। মা-কাকিমারা বলত কলাকাটা অমাবস্যা। ঢাকের আওয়াজে ঘুম ভাঙত। বাইরে ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে দেবী আসছেন। ভোর হলেই রেডিওতে বীরেনভদ্র। আমাদের গ্রামের পচা ঠাকুর প্রায়ই বীরেনভদ্র’র নকল করে দুর্গাপুজো করত।

গ্রামে একটা-দুটো মাইক। পুজোর সময় মাইকের বায়না হবে বলে মহালয়ার দিন থেকে মাইক বাজাত। কলকাতা তখন অনেক দূরে। সপ্তায় একবার করে লঞ্চ আসত। সেই লঞ্চের পিছনে লেখা থাকত ক্যালকাটা, আমাদের কলকাতা ওইটুকুই। গাঙভেড়ীতে দাঁড়িযে সবাই লঞ্চ দেখত। কলকাতা দেখত। ঘরে তখন আটাঘোঁটা। না হলে মাইলোর জাউ। সে খেযে পেট ছিড়ে দিত। সকাল হলেই কলুনপাড়া থেকে আসত পান্তার জল নিতে। গ্রামে তখন সবারই একই অবস্থা। একমাত্র যাদের বেশি ধানের জমি তারাই এসমযে ধান বিক্রি করত। এসময় ধানের দাম বাড়ত।
সকালবেলা উঠে দেখতাম চকচকে ভাতের হাঁড়ি নিযে ৱু সর্দার পাড়ার মেযো ধান ক্ষেতে ঢুকত। শামুক, গুগলি ছাড়াও বড় আকর্ষণ শালুক। দিনের পর দিন তারা শালুক সেদ্ধ খেযে দিন কাটিয়ে দিয়েছে। ওরাই বন কেটেছিল। জমিও পেয়েছিল। সে জমি রাখতে পারেনি। এর আরও কয়েক বছর পরে জমির সিলিং বেঁধে দিল সরকার। অনেকের জমি খাস হয়ে গেল। পরবর্তী সময়ে নেতারা সেই জমি নিয়ে গরিব লোকদের মধ্যে বিলি করে দেয়।
তবু অভাব ঘোচে না। পুজোর আগে মৌসুমী বায়ু প্রত্যাগমনের সময়-আশ্বিনের ঝড় আসত। তাতে ফলন্ত ধানের সর্বনাশ। এই সর্বনাশের সঙ্গে আসত পুজো। আমরা বাচ্চারা কিছু ৱুঝতাম না। বাড়ির লোকের সঙ্গে নৌকায় করে পুজো দেখতাম। দশমীর পরের দিন নৌকায় করে ঠাকুর বিসর্জন হত। ঘাটে ঘাটে নৌকা আসত। সেই একচালা ঠাকুর আর দেখা যায় না। পচা ঠাকুর তখনও রায়মঙ্গলের ওপারে পুজো করতে যেত আমরা বলতাম–
ঠাকুর ঠাকুর ডয়রাকলা
ঠাকুর নাচে দুপুর বেলা।
পচা ঠাকুর নেই। তার ছেলেরা আছে। তারা এখন সরকারি টাকা। এদিক ওদিক করে বড়ো লোক। শহরে বাড়ি করেছে। তবে আমাদের গ্রামও কিন্তু শহর হয়ে আসছিল। উচ্চফলনশীল ধান চলে এসেছে। গোসাবা থেকে বিডিও সাহেব লোক পাঠিয়েছে। আমরা বলতাম ওভার শিয়ার। সেই প্রথম সাইকেল দেখলাম।
এখন গোসাবা সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার। দ্বার পণ্ডিতরা বসে আছে। খেয়াঘাট থেকে আলোর কারুকাজ। আগে বাজারের পাসে একটাই দুর্গাপুজো, এখন অনেক। তখন লঞ্চ চলত। দুপুর দেড়টায় আসত খবরের কাগজ। এখন কাগজ আসে না। এখন লোক আসে। ভিনরাজ্য থেকে লোকরা বাড়ি আসছে। ধামাখালি চুনোখালি, গোসাবার ঘাটে ঘাটে লোক। সবাই বাড়ি চলে যাচ্ছে। মায়ের ডাকে বাড়ি আসছে। গ্রামে কাজ নেই। পয়সা আছে। তিন বিঘে জমি থাকলে বছরে দুবার করে টাকা। যারা শহরে চাকরি করতে এসেছিল তাদের আর দেশের বাড়ি নেই। রায়মঙ্গলের ওপারে বাংলাদেশের পাশের দ্বীপময় উত্তর ২৪ পরগনাতেও জৌলুষ কম নেই। পুজোর আগে বিডিও অফিসে এত লোক দেখা যেত না। এখন ধান্দায়, কাজে-অকাজে চলে আসছে। এখানেই টাকার উৎস।
যারা একদিন আবাদ করেছিল। তারা কেউ নেই। তাদের পরবর্তী প্রজন্মরা অনেকেই ভিটেমাটি ছাড়া। এখন সমযে অপেক্ষা। তবু ভাঙা ঘরে ভোরবেলা বীরেনভদ্র জেগে উঠেন। গ্রাম এখন নিরঙ্কুশ অন্ধকারে ঢেকে নেই। ঘরে ঘরে আলো। বৈদ্যুতিক অপব্যবহারে দু-একজন মারা যায়। তবু তো আলো কেউ গান গায় না। এত আলো জ্বালিযে… কিন্তু এই আলো আঁধারের অধিক। তবু মহালয়া আসে। পুজো আসে। চারপাশে মেঘমুল্লুকের নীচে ধানক্ষেত ভোরের প্রকৃতিরা শোনে বীরেনভদ্র। আকাশে-বাতাসে গান গায় বিদ্যাধরী মাতলা- সে গান পূর্বশ্রমের লোকরা শুনতে পায়।



Be First to Comment