উৎপলেন্দু মণ্ডল
সুন্দরবনে আদর্শ গ্রাম আর খুঁজে পাওয়া যায় না। জয়বাংলা হওয়ার আগে সুন্দরবন ছিল গ্রাম। খুলনা ও জশরের বহু লোক তখন এপারে। যুদ্ধের পর আমাদের কলুনপাড়ার বাসাবেড়ে সুরেন জয়বাংলার উদ্দেশে যাত্রা করে, তার কাঁধে বাঁক। পাকা বাঁশের বাঁকে দু’পাশে ঝুলানো সংসারের তাবড় জিনিস, চৈত্রের দুপুরে বউ আর মেয়ে নিয়ে সুরেন বেরিয়েছিল। এসময় ছায়ারা ছোট হয়। সুরেনের মেয়ে আমাদের সঙ্গে খেলত। ওর মা প্রায়শই আমাদের বাড়িতে কাজ করত সে কারণে মেয়েটিও আমাদের বাড়িতে আসত। ওর ঠাকুমা মাঝে মাঝে আসত মেয়ের খোঁজে। সে বুড়ি আর শ্বশুরের ভিটেতে যেতে পারেনি। আমাদের কলুনপাড়ায় তার ইন্তেকাল হয়েছিল।
এসময় পূর্ব-পাকিস্তানের লোকরা এসেই নবিন চর দখল করত। আমার ঠাকুরদাও এসেছিল স্বাধীনতার আগে কালিন্দির এপারে। তার হাফডজন ছেলেদের নিয়ে জমিদারের তাড়ায় এপারে এসেছিল। বেশকিছু জমি ওপারে নিয়েছিল কিন্তু রাখতে পারেনি। নদীর বাধ রাখতে পারত না কালিন্দির জোয়ারের সব ভাসিয়ে নিয়ে যত। বাপকাকাদের কথায় আলো হয়ে যেত। এক জনপদ ছেড়ে আর এক জনপদ, সেখানেও শান্তি নেই। সামান্য কিছু জমি মনে হয় ভাগে করত তারপর আবার আবাদের খোঁজে।

গোসাবা থানার অর্তগত অন্যতম থানা ছিল সন্দেশখালি। এই গ্রাম তখন জঙ্গল আবৃত, আমার ঠাকুরদা ২০০ বিঘে জমি আবাদ করেছিল। দুই খালের মাঝে বিশাল অরণ্য। শান্তিখালের পাসে মাচা করে থাকা। বাবা-কাকারা পালা করে আসত-যেত । তখনও মেয়েরা মানে জেঠিমারা আসেনি। মা গল্প করত শান্তিখালের ওপাশে তখন উলুবন। সেজ জ্যাঠা মাঝে মাঝে ঠাকুরদার উপর রাগ করে উলুবনে শুয়ে থাকত। সেই উলুবন এখন নেই। শান্তিখালের সঙ্গে নদীর একসময় ঘোরতর যোগছিল। সংযোগস্থলে প্রায়ই -বাঁধ ভেঙে যেত। এখন আমাদের বাড়ির সামনে বিশাল চর। আমি ছোটবেলায় দেখেছি সারি সারি বান গাছ। তার মাথায় কাকের বাসা। আমরা তুতো ভাইবোনেরা শুকনো চরে- বানগাছের মাথায় উঠে কাকের বাসা থেকে ডিম নিয়ে আসত।
ঠাকুরদা দেখেছিল- তার ২০০ বিঘে জমির মধ্যে ১০০ বিঘে জমি, জমিদারের নায়ব – টাকা নিয়ে অন্যদের দিয়ে ছিল। হ্যামিল্টন সাহেব তখন এসে গেছে। সাতজেলের শংকর মোড়লের সঙ্গে সাহেবের গন্ডগোল। বাধ্য হয়ে সাতজেলে ছাড়তে হ’ল। তারপর আমাদের জমিতে আক্রমণ। ঠাকুরদা তার ছেলেদের শান্তিখালের পাশে বসিয়ে দিয়ে আমাদের পুরাতন বাড়ি পারঘুমটে – অদুরে কালিন্দী যে ভিটে বাড়িতে একসময় বাবাকাকা থাকত- সেই ভিটেতে চলে এল।
আবাদকৃত জমি ছেড়ে আসার সময় বলে এসেছিল – এক জায়গায় তো থাকতে পারবি না – শান্তিখালের পাস দিয়ে সারি সারি বাড়ি করবে। ঠাকুরদা বেশি দিন বাঁচেনি- সেই ভাদ্রেই ইহজগত ছেড়ে চলে যায়। ছোটবেলায় গল্প শুনেছি আমাদের পাশে যে সদানন্দ সে মোটেই সদাশয় নয় – তাদের সঙ্গে গন্ডগোল হয়। একবার চাষের সময় লেঠেল নিয়ে এসেছিল। লেঠেলদের ভয়ঙ্কর গল্প বইয়ে পড়েছিলাম।
সেই কথা আমার মা উক্ষন কথার মতো করে আমাদের বলত কিন্তু বাপকাকাদের সঙ্গে পারবে কেন-আমাদের দাদারা তখন নিতান্তই বালক। মা-জ্যেঠিমাদের কাছে শুনতাম – আবাদ করার সময়ের গল্প। আমার মা বলত, তোর বাপকাকারা যখন বনের মধ্যে সেঁধিয়ে যেত তখন দু’পাশের গাছ দুহাত দিয়ে ঠেলে এগিয়ে যেত – তারপর আবার বন মিশে যেত। তখনই বুকের মধ্যে সাৎ করে উঠত – যদি কিছু হয়ে যায়। শোনা যায় শান্তিখালের ওপারে কুমিররা না কি শুয়ে থাকত। বাঘ যে একেবারে ছিল না তা তো নয়। ঠাকুমা বলত আচাল বাদা – তোর ঠাকুরদা আগে আগে যেত – খুব সাহসী লোক ছিল। তেমনি কাজ করতে পারত। তোর মা খুব ভয় পেত- একহাত ঘোমটা দিয়ে তোর ঠাকুরদাকে ভাত দিচ্ছে। রাগি লোক রান্না ঘরে আমি বলে- তোর মাকে পাঠিয়েছি। তোর মা কিছু দেখতে পাচ্ছে না। কলাই করা থালা পায়ের উপর তুলে দিচ্ছে। মেজবউ কোথা থেকে দেখতে পেয়ে ছুটে আসে।
বেঁটে কালো লোকটা, বাইসেফ, ট্রাইসেফ নিয়ে কত জায়গা আবাদ করেছিল। আসলে বনপ্রেমিক। এখনকার মতো জমি হাঙর কি?




Be First to Comment