Press "Enter" to skip to content

স্নিজার সঙ্গে জোড়াসাঁকোয় – অরুণাভ রাহা রায়

অনির্বাণ চৌধুরী

 “এইটুকুই লিখতে পারি, আমি খুব যুদ্ধে হারি/ পড়ে যাই গভীর খাদে, তুলে দাও আবছা চাঁদে/ যে চাঁদে দিব্যি জ্বলো, সে চাঁদে একলা চলো…”

কবিতা যদি জীবনের এক অঙ্গান্গী প্রতিরূপ হয় তাহলে সেই যুদ্ধে হেরে গেলেও যেটুকুই লিখতে পারা, সেটুকু বোঝেই একলা চলার মত পথ দেখায় গান ভাসানো চাঁদের শরীর। যে গানের সুর ছাদের তারে মেরে দিতে পারে কবিতা প্রচুর। গায়ক চাঁদ নেমে আসতে পারে কারোর হাতে অথবা ভিজে মাটিতে রাঙা হাওয়ায় দেখিয়ে দেয় প্রেমিকা নয়তো প্রেরণার প্রতিচ্ছবি। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন একলা চলার কথা। হরিনামের জগৎ মাতানোর বদলে গগন হড়করার সুর কে অস্ত্র করলেন সেই জ্যোৎস্না রাতের গানে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়ে যাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথেরই প্রেরণাকে এক অনন্ত প্রেম যাত্রার মধ্যে খুঁজে বেড়ালেন আর এক কবি, তরুণ অরুনাভ। অরুনাভ রাহা রায়ের কবিতার বোধ এবং বৈচিত্র ডবল বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে হেঁটে ঘুরে ফিরে ছাতিমতলা চীনে ভবনের পাশে এসে থেমে গেলেও থামলো না শান্তিনিকেতন থেকে জোড়াসাঁকোর, দুই মেরুর বাতাসেই।  ‘স্নিজার সঙ্গে জোড়াসাঁকোয়’ তার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ। মাত্র ১৮ বছর বয়সে ছাত্র অবস্থায় দেশ পত্রিকায় কবিতা প্রকাশ হয়েছিল যে তরুণের ইতিমধ্যেই পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ এবং দুটি  গদ্যগ্রন্থ সৃষ্টি হয়েছে যার হাতে সেই যুবক, অরুনাভ বর্তমানে বাংলা কবিতায় দেশভাগের প্রতিফলন নিয়ে গবেষণারত। ‘স্নিজার সঙ্গে জোড়াসাঁকোয়’ বইটি পড়তে পড়তে বারবার মনে হয়েছে, অনন্ত এক স্নানযাত্রায় বারবার ডুব দিয়েছেন তিনি তার আত্মা এবং প্রেরণার মাঝে স্তরবিন্যস্ত প্রেমের প্রাচুর্যময় অনন্ত এক গীতিমালায়। কবিতায় লেখেন – “মূলত নামের প্রেমে বারবার পড়ি।/ আগেও করেছি জানি আজ থেকে শুধু/ তোমার গলার স্বর শুনে নিতে চাই/ তুমি কি গীতবিতান ভরে রাখো ব্যাগে?/ তোমার নামের পাশে গানে গানে যাই…. দূর থেকে তাই…./ পথে পথে ভিজে তোমার জন্মদাগ/ চিনে নিতে চাই…”!(লিপি)

এই জন্মদাগের মালিক যিনি তিনি যদি কোন রূপক অথবা রক্তমাংসের মানবী হন, তাতে বিন্দুমাত্র লেশ পড়েনি, কবিতার স্বরলিপিতে। কেন যে হঠাৎ অফিস ফাঁকির মধ্যে দেখা হয়, লাজুক স্বভাবে গুনতে হয় বিকেলের প্রহর, সেই প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজে না পেলেও, ফাঁকি দিয়ে তাও খুঁজে চলি প্রেম, খুঁজে দেখি অপরাধ; কাব্য পাঠ আমাদের হয় না বাড়িতে কাব্য আনার মত। (স্বরলিপির কাব্য) আমাদের ভেক মিশে যায় হাতঘড়িতে। হৃদকমলে বাজতে থাকে কালাচাঁদ দরবেশ লোকাল অথবা এক্সপ্রেস ট্রেনে ভিক্ষা করা বাউল ফকিরের সময় ঘিরে এগিয়ে যাওয়া একতারা দোতারার উদাসীনতায়। প্রেক্ষাগৃহ ফাঁকা হয়ে গেলেও আলো নেভার একটু আগেই মোহর কুঞ্জে যাওয়ার কথা অথবা আচম্বিতে দেখা হওয়ার আগে যে অদেখা, সেই ব্যথার ঘোর বাজতেই থাকে অনবরত। অস্তরাগ শুধু আকাশেই নয় নেমে আসে অসাক্ষাতেও। (হৃদকমলে রাখব) এমন সুরের কাছে ঋণী হতেই হয় যীশুর আকাশের কাছে গিয়ে চেনায় নক্ষত্র ডাকে বৃষ্টি এবং পাঠায় গান নীললোহিতের কাছে সুদূর কোন শীতের দেশে। (মুর্শিদ) কবি খুঁজে পান শান্তিনিকেতনের ভেতর গোছানো এক জাপানি এপিটোম। যেখানে অনন্ত সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে নাগাসাকি, মায়াবী আলোয় কবিতা শুনতে শুনতে ঝিঁ ঝিঁ র শব্দে ভেসে আসে অরণ্যের গান, সুদূর ওসাকা থেকে উড়ে এসে যেন আড্ডায় বসে যান স্বয়ং মাজুকি! আরেক অভিযাত্রীর বাড়িয়ে দেওয়া ডায়েরিতে অগ্রজ কবির ছন্দে পিয়ানোর সুর যেন ভেসে ওঠে সমগ্র বাড়িটি জুড়ে। অরুণাভ সেই শান্তিনিকেতনের জাপানি সংস্করণের নাম রাখেন কোকোরো এবং সেই কবিতা সন্ধ্যায় আড্ডা থেকে কুড়িয়ে নেন, ডায়েরির সেই অবিন্যস্ত পাতাকে: “এই সন্দেহ আড্ডার একমাত্র জাপান যাত্রী নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। তার বাড়িয়ে দেওয়া ডায়েরিতে কবি সুভাষ সরকার লিখলেন: ‘জাপান আমি যাই বা না যাই/ এই বাড়িটা আমার চাই।“(কোকোরো কবিতাসন্ধ্যা)

তবে জাপান থেকে জোড়াlসাঁকো যেখানেই তিনি যান তার কবিতায় প্রতিফলিত হয় বারবার নিঃশর্ত প্রেমিকার অপেক্ষার উড়ন্ত গোধূলি রং। সেই জন্মদাগের মালকিন, যদি ধরে নেওয়া হয়, স্নিজা দাশগুপ্ত, তবে তার হাঁচির মত জলঙ্গী নদীতে কবিতার ফুল ফুটিয়ে তোলেন আর তার নীরবতা ও কাছে গভীরতার কাছে সামান্য জল হয়ে পড়ে থাকেন তরুণ কবি। “বাঁকানো কাকের মতো মাটির কলসিতে একটা একটা করে নুড়ি ফেলে তুলে আনেন …. তুমি জল!” (মিথ) মায়াবী পেন্সিলের জ্যামিতির বদলে এঁকে রাখেন উল্টোরথ। প্রেমিকার এলো চুলে শব্দ গেঁথে গড়ে তোলেন এক কাব্যিক ইমারত যার বন্ধ দ্বার নিমেষে খুলে যায় মুগ্ধতায়, লুকিয়ে থাকা মিনিট দশকের উচ্চারণে। (দাশগুপ্ত সন্ধ্যা) “মুহূর্তে উধাও তুমি ফেসবুক থেকে!/ এভাবে উধাও হলে জেনো -/ তোমার বেড়াল নিয়ে ছেড়ে দেব মাঠে/ নদীজলে অফিসের তাপ মুছে নেব” এতটাই শক্তিশালী যার প্রেম, যার তারুণ্য চোখ রাঙাতে পারে কালো বেড়ালের মত – “তোমার বিছানা থেকে আমি গানের ভীষণ কাছে চলে যেতে পারি।“ (বেড়াল) কবি নিজেই প্রেমের প্রতি তার সেই উত্তেজনা ও আত্মযাপনের অহংকারে বিস্মিত হয়ে লিখতে বাধ্য হন –“এতটা প্রেমিকা তুমি! কবিতা এতটা!” “আমাকে বিনম্র করো। বেশি রাত জেগে তোমাকে লেখার জন্য বসে আছি হোটেলের ঘরে…/ রোজ খাদ থেকে তুলে সূর্যকে জ্বেলে দাও পাহারশিখরে…”(বিস্ময়)। দেশভাগ অথবা প্রেমের কবিতায় যুদ্ধঘোষণা হয় কলমে, আঙুলে ভেসে ওঠে কোথাও দ্রোহ অথবা বিচ্ছেদের সুর, আবারও অহংকারী ভাষা শশব্দে জানান দেয় তার প্রিয় পরিচিতি অথবা সেই ধারাভাষ্যের সাংবাদিকাকে – “চলো যাই বাংলাদেশে/ রাখো হাত বইয়ের তাকে/ দু পাশে শিশির জমুক/ মিশে যাও ধুলোর বাকে” – আমরা আচ্ছন্ন হই ঝাপসা আলোয় উছিলায় ঋণ বেড়ে যায় অনির্বাণ আলোকে। অরুনাভর কবিতায় ভেসে ওঠে টাইম স্পেস এর জার্নাল। সময়ের ঘোরাফেরায় দেহের প্রচন্ড উত্তাপে অসমাপ্ত অন্দরমহলের রহস্য পাঠকের কাছে অবশ্যই প্রশংসনীয় হবে। আমরা বারবার ডুব দেব হুল্লোড় শুরু করব বিলিয়ার্ড খেলতে খেলতে। আন্দামান থেকে আসা যুবতীদের সাথে জাহাজের রেলিং ঘেঁষে একসাথে দাঁড়িয়ে হাওয়ার ধাক্কায় ডানা মেলে দেবো টাইটানিকের মত। কবি সেই দৃশ্যটাকে সযত্নে যেন দাঁড় করিয়ে দেবেন আমাদের ছেড়ে পৃথিবীর তালুর উপর রেখে যাওয়া ব্রহ্মাণ্ডের বাইরে। একে অপরকে নষ্ট করা ছাড়া আমাদের এই বৃত্ত থেকে বেরোনোর আর তাই কোন গতি নেই। কবিতা ও কবির আত্ম অনুভূতিকে বজ্রমানিকের বেঁধে রাখার জন্য তাই আমাদেরও ধন্যবাদ দিতেই হয় সেই প্রেরণা, সেই প্রেমিকা, সেই শর্তহীন স্নিজা দাশগুপের কাছে। যার জন্য বারবার ঘুরে আসা যায় জলঙ্গি থেকে জোড়াসাঁকোর পার অবধি। বাকি কথা তোলা থাম পাঠকের জন্য।

স্নিজার সঙ্গে জোড়াসাঁকোয় প্রকাশক: এবং অধ্যায়/ প্রচ্ছদ: শুভাপ্রসন্ন/ মূল্য: ২০০ টাকা

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *