শঙ্খ ঘোষ। সংগৃহীত ছবি
তাপস রায়
শঙ্খ ঘোষের শরীর অতীত। কিন্তু তাঁর কবিতা! যেন রাত্রি এসে স্পর্শ করেছে, যেন তার সৌন্দর্যে সুরভিত হয়ে আছে ছড়ানো চারপাশ … অনুভব এমন আততি নিয়ে জেগে উঠল, চোখ বন্ধ করে নিজের ভেতর মঞ্জরিত হবার কাল পাঠকের। শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘জার্নালে’ মধ্যরাত শিরোনামের ভাবনাটিকে যেন সেতারের ধ্বনিতরঙ্গের মূর্চ্ছনা দিয়েছিলেন … এর অধিক কবিতা আর কী, তার গম্যতাই বা কোথায়! বললেন,
“ অন্ধকারের ভেতর দিয়ে স্তবকে স্তবকে উঠে আসা নিঃশব্দ গানে ভিজে যায় ঘাস, ভিজে যায় অবোধ প্রাণীদল, ঘূর্ণিত হতে থাকে সময়, গ্রহণে গ্রহণে ভরে যায় অঞ্জলি, করপুট উঠে যায় আলোড়িত আকাশের দিকে। না-এর মধ্যে দিয়ে ঝলকে ঝলকে এগিয়ে অস্তি, অশ্বত্থের গুড়ি ছুঁয়ে মধ্যরাত বলে: স্তব্ধ হও, শোনো। শুনি। অবিরল উত্রোল অনাবিল পদধ্বনি শুনি সারারাত।”
শুধু মধ্যরাত নয়, ‘জার্নালের’ প্রতিটি রচনাই কবিতার হার্দ্য আলিঙ্গন নিয়ে যেন বসে আছে, যেন চোখাচোখি হলেই কোনো অতিন্দ্রিয় ঈপ্সার দিকে ছড়িয়ে পড়বে রং। ‘জার্নালের’ মোমের আলোর মতো উদ্ভাসিত কবিতার ঘোরের ভেতর থেকে সপ্রশ্ন মনে পড়তে পারে, আজ যেন তাঁর ‘ধুম লেগেছে হৃৎকমলে’। তাঁরই কবিতার বই এটি। যেখানে অন্তহীন প্রশ্ন আর না-এর বিভঙ্গ দেখে ভয় জাগে … শুধু কি প্রলয়ের কথা হবে, নাকি ঊনজন্মের ভেতর থেকে নতুন প্রাণপ্রবাহের এই সে অভিমুখ!
একটি কবিতাই পাঠকের চেতনাকে অনিঃশেষের দিকে নিয়ে যেতে চায়। শরীর থেকে অ-শরীরের দিকে। মৃত্যু থেকে অমৃতের দিকে। একটি কবিতার ভেতর লুকিয়ে থাকে আবিষ্কারের শতজল ঝর্ণার ঈপ্সিত আবাহন। ফলে কবিকে বলার চেয়ে না-বলাটা বেশি করে দেখতে হয়, তিনি দেখেন শব্দ-উত্তীর্ণ কোনো এক অরূপতা তাঁর সামনে উপস্থিত। তাঁকে ছুঁতে চাওয়ার কোনো মানে হয় না, তিনি শঙ্খ ঘোষ শুধু লিখতে পারেন, “ যে গ্রহনক্ষত্র ছিল ওই চোখে তার কিছু স্বাদ/ এই অমাবশ্যা থেকে ঝরুক তোমারও চোখেমুখে/ প্রায় শিশিরের মতো অগ্নিকণা বুকে বিঁধে নিয়ে/ ব্রতপালনের দিকে ঝুঁকে থাকা নিশিজাগরণ।”( ব্রত, ধুম লেগেছে হৃৎকমলে)।
‘হুমায়ুন নামা’ থেকে জানা যায় মৃত্যুশয্যা থেকে হুমায়ুনকে ফিরিয়ে আনতে বাবর নিজেকে উৎসর্গ করছেন, “ On me be all thy suffering”। এর ফলে হুমায়ুন বেঁচে উঠেছিলেন কিনা সেটা বিষয় নয়। কিন্তু ঐ উচ্চারণের অনুরণনে বোনা হয়েছিল একটি অমোঘ সময়ের প্রতিবাদের ইতিহাস। আধুনিক বাংলা কবিতায় মানবতাবাদের সে এক অমোঘ চিহ্ন — ‘ বাবরের প্রার্থনা’। যেখানে লেখা হলঃ
এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম
আজ বসন্তের শূন্য হাত …
ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।
এ কবিতা শুধু কাল চেতনার বলে উল্লেখের নয়, প্রকরণেরও। এ কবিতা একটি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সত্য চিরে তৈরি। কিন্তু যেহেতু আত্মউন্মোচন ও আত্মগোপন হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে, ফলে এক সামান্য আড়াল হয়ত রাষ্ট্রীয় রোষের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে আমাদের কবি শঙ্খ ঘোষকে সেসময়। তাঁর সমস্ত কাব্যকৃতিই সাংবাদিকতার বিপরীত,জনগণের কথা হলেও আড়ালকে অবলম্বনে রেখেছে। আর তিনি, কবি শঙ্খ ঘোষ বলেও ফেলেন, “ তোমাকে বক্ব/ ভীষণ বক্ব আড়ালে।”
শুধু কালিক ইতিহাস নয়, মানুষের মনের ইতিহাসকেও বিবেচনায় রাখেন শঙ্খ ঘোষ। মানসিকতার যে পরিবর্তন ঘটে যেতে থাকে নিরন্তর, তাকেও মূল্য দেন। এখানে কবির যে ডিসকোর্স তাতে যুক্তি অধরা থাকে না। আর কবি মনের ইতিহাসও যে নমনীয় নদীর মতো হয়ে বয়ে এসেছে তা-ও অস্পষ্ট থাকে না। তাঁর স্বরভঙ্গির এই চলিষ্ণু পদ্ধতিকে মিত কথনের বিস্তৃত বাকভঙ্গি বলা যেতে পারে। যেখানে কোথাও ভাবনার গাঢ় ও গহনকে অসরলের অবাকত্ব দিতে হয়নি। আর আশ্চর্যের ‘তুমি কোন দলে’ বলে তাঁকে চিহ্নিত করার ঝোঁক আজও দুর্লভ। এক ছন্দোময় মন্ত্রোচ্চারণের ধ্যান যেন তাঁর সমস্ত কবিতা পরিমণ্ডলে স্বভাবতা পায়। নীরবতার ভাষা আলোময় করে দেয় চেনা ও অচেনা।
সমাজের সঙ্গে তন্বিষ্ঠ থেকেও একজন কবির যাত্রা এককতার দিকে, এটাই তাঁর সম্পূর্ণতা। অনবচ্ছিন্ন ওই সব মুহূর্তকে কবি ধরে রাখতে চান কোনো অখিল সুরভি দিয়ে। তিনি তো বলবেন, “ এরও পর যখন জেগে উঠবে দু’একটা গন্ধরাজ, মনে রেখো/ নিঃশ্বাসের জন্য এই অসাড় আঙুল দিয়ে আকড়ে ধরেছিলাম ন্যুনতম ঘাসবিন্দুটুকু।” (নিঃশ্বাস, ধুম লেগেছে হৃৎকমলে)।
কে প্রকৃতি? সে কি কেবল গাছ, নদী, পাহাড়? এই মানুষ … মানুষের বসবাস, তার পরিমণ্ডল, তার কেঁপে ওঠা আত্মা … এসব প্রকৃতি নয়? একটি নিঃশ্বাস পতনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শ্রম ও চেতনার অবিমিশ্র প্রকৃতি। ওই বৃহতের সমস্ত অসংগতির দিকেই কবির নির্দেশনামা ঘুরে যায়। আর পাঠকের জানালা খোলে। কোনো একটা কবিতা থেকে তখন পাঠকের অনুভবে এসে লাগে বাইরের মিষ্টি প্রাণ ভরানো হাওয়া, তার আকুলতা। ঘর ও বার মিলে মিশে যায়। এই মেলবন্ধনই যেন কবির ধ্যেয় ছিল, যেন পাঠকের ওই সামান্য শুশ্রুষায় তাঁর সমস্ত কবিজীবনের সার্থকতা। শঙ্খ ঘোষ লিখতে পারেন ঃ
চিতা তখন জ্বলছে আমার হৃৎকমলে
ধুম লেগেছে, ঘুম লেগেছে চরাচরে, পাপড়ি জ্বলে
এই তো আমার?
এই তো আমার জন্মভূমির আলোর কথা।
( হৃৎকমল, ধুম লেগেছে হৃৎকমলে)
কবির আত্মার মুক্তি ধ্বনিত হল সামাজিক সংকটের আলোড়নে। নিজস্ব নিঃশ্বাসের কম্পন, যন্ত্রণা, ব্যথা বাঁশির ভেতর দিয়ে চলাচল করে গান হয়ে গেল। শেষ লাইনটি লিখবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত যে যন্ত্রণা ও মুগ্ধতা, যে তর্ক ও উদবেগ-পোড়েন, তা থেকে যেন মুক্তি এল। এই দ্বিধা পৃথিবী নিয়ে, তার সংঘর্ষ ও চলাচল নিয়ে ‘পা তোলা, পা ফেলা’ শীর্ষক একটি রচনায় শঙ্খ ঘোষ বলেছেনও — “ কী নিয়ে লেখা হবে কবিতা? আমার বাইরের পৃথিবী নিয়ে? না কি আমারই ব্যক্তিগত জগত নিয়ে? এই ছিল তর্ক, দেশ-বিদেশের বহুকালের পুরনো তর্ক। কিন্তু এই দুই কি ভিন্ন নাকি? এই দুয়ের মধ্যে নিরন্তন যাওয়া-আসা করেই কি বেঁচে নেই মানুষ?তার থেকেই কি প্রতি মুহূর্তে তৈরি হয়ে উঠছে না একটা তৃতীয় সত্তা?”
একেই হয়ত সমগ্রতা বলেছেন কবি আলোক সরকার। তাত্ত্বিক চোখে তবে একেই কি বলা হবে synthesis! এই পূর্ণতাকে আলোক সরকার আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করেন এভাবে। “ কবিতার ব্যবহারিক উপস্থাপন এবং তার সারাৎসারের ভিতর এই মৌল দ্বন্দ্ব বা বিরোধ যে ভাব বা ইমোশনের সঙ্গে রস অথবা অভিনিবেশকে একাত্ম করে দেখার ফলেই উদ্ভূত তা অলঙ্কারশাস্ত্রের পাঠক মাত্রেই জানেন। বস্তুত একটি গাছের হয়ে ওঠা এবং একটি পূর্ণাবয়ব গাছের মধ্যে অসেতুসম্ভব ব্যবধান। একটা গাছ তার ডাল নয়, তার পাতা নয়, ফুল নয়, … একটা গাছ সর্বাঙ্গ নিয়ে একটা গাছ, যেমন একটা ছবি সামগ্রিক একটা ছবি। বিশ্লিষ্টভাবে একটা গাছ পাতাও নয়, ফুলও নয়, একটা ছবি দশ-বারোটি রেখাও নয় কিংবা তিন-চারটি রঙ। কেবল একটা সমগ্রতা”
শঙ্খ ঘোষের এই কবিতাটি সেই সমগ্রতার কথাই বলেঃ
পিছনে সূর্যাস্ত সামনে ছোটো থেকে বড়ো শিশু জিমন্যাস্টিক মিছিলে চলেছে
শাদা জামা শাদা শর্টস নীরব আর্দ্রতা নিয়ে ছন্দোময় পায়ে পায়ে তারা
সূর্যের ভিতর থেকে বেরিয়ে চলেছে যেন আধোদূর চন্দ্রিমার দিকে
মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে অদৃশ্য পাথরে গড়া অতিকায় স্ফিংকস ঘরবাড়ি
যেন বা তোরণ পথে সেই মুখে ঢুকে গেলে জমি পড়ে থাকে সামনে ফাঁকা
পদ্মের শূন্যতা থেকে পান্ডুর নীলাভ ছায়া নেমে আসে পথের ওপারে
মুহূর্তে মুর্ছিত বোধ সমস্ত শরীর দিয়ে ঘাসের কিনার ছুঁয়ে বলেঃ
‘এই তো উঠেছে দেখো সকলের অগোচরে আমাদের দুঃখজলনিধি।’
( পিছনে সূর্যাস্ত, ধুম লেগেছে হৃৎকমলে)
এই কবিতাতেও তো সেই ভেতর বাহির একাকার করে নেবার আত্যন্তিক সংবেদন। এই সমগ্রতাও তো উপনিষদের স্মিত আলোয় স্নান শেষের শুদ্ধতা নিয়ে উপস্থিত। হৃৎকমলের বৃন্তলগ্ন পাতায়েকটি আলোকণার টলটল করে ওঠার ছবি পাঠকের চোখে আসে।
পরবর্তী অংশ প্রকাশিত হবে আগামী ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪
Be First to Comment