Press "Enter" to skip to content

আরজি কর কাণ্ড: তৃণমূলের কাছে কঠিন চ্যালেঞ্জ, বড় সুযোগ বাম-বিজেপির

স্বাস্থ্যভবনের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থান। ছবি: রাজীব বসু

অমল মাজি এগজিকিউটিভ এডিটর, অনলাইন কোলফিল্ড টাইমস

সম্প্রতি আরজি কর হাসপাতালে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নতুন করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনা শুধু রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসকেই নয়, গোটা সমাজ এবং বিশেষত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করেছে। এই ঘটনা রাজনৈতিক পরিসরে এক গভীর সংকট তৈরি করেছে, যা বিরোধী দলগুলোকে শাসক দলের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানোর জন্য উপযুক্ত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।

তৃণমূলের জন্য অস্বস্তি ও সংকট

আরজি কর হাসপাতালের ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের উপর চাপ বেড়েছে। এমনিতে শাসক দলের বিরুদ্ধে স্বচ্ছতার অভাবের অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই ছিল, তবে এই ঘটনার ফলে তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। বিরোধীরা সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকারের উপর আঙুল তুলছে এবং আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার বেহাল দশার দিকে ইঙ্গিত করছে। তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সংস্কার আনার চেষ্টা করেছে, তবে এই ঘটনাটি সেই সংস্কারের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।

লোকসভা ভোটে তৃণমূলের জনপ্রিয়তা নতুন করে নজর কেড়েছিল। কিন্তু আরজি করের ঘটনাটি সেই ছবিকে নিমেষে বদলে দিয়েছে। বিশেষত, তৃণমূল সরকার তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন প্রাথমিকভাবে এই ঘটনার দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যাপারে উদ্যোগী ছিল না বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রশাসনের এই উদাসীনতা এবং দোষীদের গ্রেফতারে দেরি তৃণমূলের ওপর রাজনৈতিক চাপ আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়া এবং কৌশল

এই ঘটনার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলগুলো—বিশেষত সিপিএম এবং বিজেপি—একজোট হয়ে শাসক দলের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করেছে। প্রথম থেকেই তারা তৃণমূলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার জন্য সরকারকে দায়ী করেছে। বিরোধীদের মতে, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে, এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বলতে কিছুই নেই।

সিপিএম এবং বিজেপি উভয়ই জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছে, যা সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভকে আরও উস্কে দিয়েছে। সিপিএম রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সমালোচনা করছে। তারা যুক্তি দিচ্ছে যে তৃণমূলের অধীনে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ, বাস্তবে তা কোনো কার্যকরী ফল দেয়নি। অন্যদিকে, বিজেপি এই ঘটনাটিকে একটি জাতীয় ইস্যুতে পরিণত করতে চায়, যেখানে আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে দেশের মানুষের সামনে তৃণমূলের ব্যর্থতাকে তুলে ধরা যায়।

আন্দোলন এবং জনসমর্থন

আরজি কর হাসপাতালে ঘটে যাওয়া এই নৃশংস ঘটনার পর জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে গভীর ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। সমস্ত দোষীকে গ্রেফতার, দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের অপসারণের দাবির পাশাপাশি তাঁরা হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন এবং তাঁদের কাজের পরিবেশকে নিরাপদ করার দাবি জানাচ্ছেন। সাধারণ মানুষও এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছে, কারণ এই ঘটনা সাধারণ মানুষের মনেও আতঙ্ক তৈরি করেছে।

জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকও কোনো ফলপ্রসূ হতে পারেনি। বারবার বৈঠক হলেও, তাদের দাবি মেনে নেওয়া হয়নি, ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। এই আন্দোলন শুধু জুনিয়র ডাক্তারদের সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা সাধারণ মানুষের সাথেও একাত্ম হয়ে উঠেছে।

জনগণের এই সমর্থন বিরোধী দলগুলোর জন্য এক বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। সিপিএম এবং বিজেপি উভয়েই এই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে তাদের রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চাইছে। মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিও উঠছে, এবং এই দাবির পেছনে বেশ কিছু যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে।

প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং সিবিআই তদন্ত

এই ঘটনার পর পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। টালা থানার প্রাক্তন ওসিকে সিবিআই গ্রেফতার করেছে, যা পুলিশের কার্যকারিতা নিয়ে নতুন করে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, কীভাবে এই ধরনের ঘটনা ঘটল এবং পুলিশ প্রশাসন কেন সমস্ত দোষীকে দ্রুত শনাক্ত করে গ্রেফতার করতে পারল না। এছাড়াও, আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের গ্রেফতারি আরও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। প্রথমে আর্থিক দুর্নীতি এবং পরে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় তাঁর গ্রেফতারি পুরো পুলিশ-প্রশাসনকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

সিবিআই-এর এই তদন্তে বিরোধীরা সরকার এবং প্রশাসনের মধ্যে এক গভীর চক্রের সন্ধান করার চেষ্টা করছে। তাদের দাবি, এ ঘটনা শুধু একজন বা দুজনের দায় নয়, বরং সমগ্র প্রশাসনিক ব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অসচেতন।

রাজনৈতিক অস্থিরতার সম্ভাবনা

এই ঘটনার ফলে রাজ্য রাজনীতিতে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে, তা সহজে মিটে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তৃণমূলের কাছে এটি এক বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। একদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে, অন্যদিকে জনমানসে তাদের হারানো আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যদি এখনই দ্রুত এবং কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে বিরোধীরা এই ঘটনাকে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করে শাসক দলের বিরুদ্ধে জোরদার প্রচার চালাতেই থাকবে।

বিরোধী দলগুলোর জন্য এটি একটি সুযোগ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। তারা ইতিমধ্যেই এই ঘটনাকে হাতিয়ার করে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করেছে। মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি যেমন উঠে আসছে, তেমনি সরকারের অন্যান্য খাতে ব্যর্থতাও তুলে ধরা হচ্ছে। যদি সরকার দ্রুত এই সংকট মোকাবিলা করতে না পারে, তাহলে আগামী নির্বাচনে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে।

কী আছে শেষে

আরজি কর হাসপাতালের এই মর্মান্তিক ঘটনা শুধুমাত্র একটি নিছক অপরাধের ঘটনা নয়, এটি রাজ্যের প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা এবং তৃণমূল সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। বিরোধীরা যে এই ঘটনার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। সাধারণ মানুষও এই বিষয়ে উদাসীন নয়।

রাজনৈতিক ভাবে, তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকট মুহূর্ত। যদি তারা এই পরিস্থিতি সমাধানে ব্যর্থ হয়, তাহলে এর প্রভাব তাদের ভবিষ্যতের রাজনৈতিক অবস্থানে গুরুতর আঘাত হানতে পারে। অন্যদিকে, সিপিএম এবং বিজেপির মতো বিরোধী দলগুলোর জন্য এটি এক বিরাট সুযোগ, যার মাধ্যমে তারা তৃণমূলের জনপ্রিয়তায় ভাগ বসাতে সক্ষম হবে।

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *