আরজি কর: পথে তিন প্রধানের সমর্থকরা
জয়ন্ত মণ্ডল
আরজি কর হাসপাতালে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পর দোষীদের শাস্তির দাবিতে উত্তাল রাজ্য। বিক্ষোভ, ধরনা, মিছিল চলছে। নিজেদের মতো করে প্রতিবাদে নামছে সাধারণ মানুষ। ফেসবুকের একটা ছোট্ট ডাক রাতের রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষকে। আরজি কর কাণ্ডের বিচার চেয়ে রাস্তায় নামা এই বিশাল জনতার মনে জায়গা করে নিচ্ছে সরকার বিরোধী মনোভাব।

মুখে স্বীকার না করলেও যা বেজায় অস্বস্তিতে ফেলছে শাসককে। পরিস্থিতি এমনই যে, সরকারি ভাবে যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হচ্ছে, তা ‘ভুল’ বলে প্রমাণিত হচ্ছে জনতার দরবারে।গত ৯ আগস্ট আরজি কর হাসপাতালের মহিলা চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হয়। জানা যায়, ধর্ষণ এবং নৃশংস ভাবে খুন করা হয়েছে তাঁকে। নানা রকমের ঘটনার ঘনঘটা তখন থেকেই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, পুলিশ এবং রাজ্য প্রশাসনের তরফে তার পর থেকে যে ধরনেরই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলির কোনটাই বিতর্কের আঁচ এড়াতে পারেনি। এমনও হয়েছে, কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল যাচাই না করেই সরকারি পদক্ষেপের কড়া সমালোচনা করছে বড় অংশের মানুষ। অনেক সময় নিছক গুজবও বাতাসে মিশে বেকায়দায় ফেলছে শাসককে।
কলকাতা ডার্বি
এই যেমন, নিরাপত্তা সমস্যার কারণ দেখিয়ে বাতিল হয়ে গেল ১৮ আগস্টের ডুরান্ড ডার্বি। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের বল গড়াল না রবিবার। ফুটবলের মাধ্যমে প্রতিবাদ করার শান্তিপূর্ণ পরিকল্পনা করেছিলেন দুই দলের সমর্থকরা। সেটাকেই আটকে দিতে এই সিদ্ধান্ত। খেলা তো বাতিল হল, প্রতিবাদের কণ্ঠরোধ করা গেল কি? উল্টে আরও বেশি সংখ্যায় লাল-হলুদ ও সবুজ-মেরুন সমর্থকরা প্রতিবাদে সামিল হলেন রবিবার। নিলেন লড়াইয়ের নতুন শপথ। ফলে সমস্যা আরও জটিল করল ডার্বি বাতিলের সিদ্ধান্ত।
স্টেডিয়ামের ধারণক্ষমতা কম, তাই সেই প্রতিবাদ হল সারা শহরের রাস্তাতেই হবে। পথে নামল দুই বড় ক্লাবের সমর্থক গোষ্ঠীগুলো। বাদ গেল না মহামেডান। কেন এতটা জেদ চেপে বসল ফুটবলপ্রেমীদের মনে? আসলে ফুটবল সমর্থকদের একাংশ আরজি করের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ টিফোর পরিকল্পনা করেছিলেন। কয়েকটি সমর্থক দলের তরফে ঘোষণাও করা হয়, ম্যাচের দিন ব্যানার, টিফোর মাধ্যমে ঘটনার প্রতিবাদ করা হবে। ডার্বি বাতিল হতে তাদের দাবি, এই ধরনের টিফো পরিস্থিতিকে আরও জটিল করতে পারে বলে আশঙ্কা করেই ডার্বি বাতিল করেছে পুলিশ-প্রশাসন। কলকাতা আর ফুটবল, সবসময়ই এক অন্য এক আবেগ। এমন পরিস্থিতিতে তৃণমূল নেতাদের কেউ কেউ মনে করছেন, এই সিদ্ধান্তে ভুল বার্তা গেল জনতার কাছে।
রাত দখল

এর আগে, গত বুধবার (১৪ আগস্ট) রাতে দেখা গেছে, নির্দিষ্ট কোনো সংগঠনের ব্যানার ছাড়াই শুধুমাত্র ফেসবুকের প্রচারে রাতের রাস্তা দখল নিয়েছেন মহিলারা। সঙ্গী হয়েছেন পুরুষরাও। দলীয় অবস্থান থেকে সরে গিয়ে পরিচিত তৃণমূল নেতাদের কেউ কেউ আবার সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেওয়া সেই কর্মসূচিকে সমর্থনও জানান। অন্য মাত্রা পেয়ে যায় এই কর্মসূচি। এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী উচ্চ নেতৃত্বই বলতে পারবেন ভুলটা কোথায়।
পুলিশের তরফে ব্যাপক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা জানা গিয়েছিল। রাজ্যের কোথাও এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার কথা শোনা যায়নি। কিন্তু সেই নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিয়েছে একটা মাত্র ঘটনা। আরজি কর হাসপাতালে ভাঙচুর। ধর্ষণ ও খুনের মামলায় এমনিতেই ব্যাকফুটে পুলিশ (সরকার এবং সরকারি দলও)। তদন্তভার কেড়ে নিয়ে সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিল হাইকোর্ট। এরই মধ্যে আরজি করে ব্যাপক ভাংচুরে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা এবং শাসক দলের যুক্ত থাকার অভিযোগ, তৃণমূলের প্রতি একটা বড় অংশের মানুষকে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে বাধ্য করছে। আর কলকাতা পুলিশ কমিশনার সাংবাদিক বৈঠক ডেকে নিজেদের দুর্বলতা স্বীকার করে নেওয়ায় আরও একটা ভুল ধরে ফেলল জনতা। সাড়া ফেলে দেওয়া এই ঘটনাকে শুরুতেই আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার কৌশলে যে ভুল ধরা পড়েছিল, সেটাই ক্রমশ ডালপালা ছড়াচ্ছে।
সন্দীপ সমস্যা
আরজি করের সদ্য প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ আলোচনার মূল বিষয়গুলির অন্যতম একটি। কোনো না কারণে তাঁকে নিয়ে রাজ্য সরকারের একের পর এক সিদ্ধান্তও ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। বিতর্ক বাড়তেই তাঁকে আরজি করের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয় রাজ্য। এতে সাধারণের মনে সন্দেহ বাড়ে।। এরই মধ্যে ঘৃতাহুতি কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তাঁর পুনর্নিয়োগ। ন্যাশনাল মেডিক্যালে দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। আরজি করে তৈরি হওয়া ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সেখানেই। ব্যাপক বিক্ষোভ। মামলা আদালতে। সন্দীপকে নিয়ে দ্বিতীয় পদক্ষেপ ভুল প্রমাণিত হওয়ার সঙ্গেই হাইকোর্টের কড়া নির্দেশে ছুটিতে গেলেন সন্দীপ। কিন্তু সেখানেও রেহাই নেই। এখন সিবিআইয়ের নিশানায় তিনি।
সন্দীপের প্রভাবশালী হওয়া নিয়েও নানা কথা শোনা গিয়েছে। আরজি কর থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর পরই কোন যুক্তিতে তাঁকে ন্যাশনাল মেডিক্যালের মাথায় বসানো হল, সেই প্রশ্নও তোলেন অনেকে। এমনকি দলের প্রাক্তন সাংসদ শান্তনু সেনও বিষয়টি নিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন। সন্দীপ ঘোষ দোষী না নির্দোষ, সেটা তদন্ত সাপেক্ষ। তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া গেল, সরকার হয়তো সেসব জানে না । কিন্তু যাঁকে ঘিরে এত বিতর্ক, তাঁকে নিয়ে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তই সরকারি ভাবে কোনো কিছু আড়াল করার জল্পনা এবং কল্পনাকেও জোরদার করতে যথেষ্ট।
ভুল আর ভুল
আরও কত নতুন ভুল যে অপেক্ষা করে আছে কে জানে। এটা নিছক অনুমান নয়, অভিজ্ঞতা। ২০০৬ সালে ২৩৫ আসন নিয়ে ক্ষমতায় ফেরা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকারের কথা মনে পড়তেই পারে। বলে রাখা ভালো, তুলনা নয়, স্মৃতিচারণ। ২০০৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাতিপুকুর রেল লাইনের ধার থেকে রিজওয়ানুর রহমানের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। ঘটনাটি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় রাজনৈতিক মহলে। ঘটনার তদন্ত নিয়ে কলকাতা পুলিশের কয়েক জন অফিসারের ভূমিকায় বেকায়দায় পড়তে হয় বামফ্রন্ট সরকারকে। ধারাবাহিক ভাবে, নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, রাজারহাট, নেতাইকাণ্ড এবং মাওবাদী উত্থানকে কেন্দ্র করে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত। যা ভুল সেটা তো ভুলই, কিন্তু সময়ের ফেরে ঠিক মনে হওয়া সিদ্ধান্তগুলোও ভুলের বহর বাড়ায়। উল্টো দিকে, ধাপে ধাপে ক্ষয় পায় বিপুল ভোটে জিতে আসা বাম সরকারের ক্ষমতা।
এখন কি সেরকমই অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তৃণমূল সরকার? বলার সময় হয়তো এখনই আসেনি। কিন্তু সময়ের চাকা বড্ড দ্রুত গড়াচ্ছে। ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া-শাসিত যুগে যে কোনো অভাবনীয় ঘটনা ঘটে যেতে পারে চোখের নিমেষে! বিশেষ করে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী যখন নিজেই বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনার তুলনা টেনে বিরোধীদের পাল্টা আক্রমণ শানাচ্ছেন!
(লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত, আংশিক সম্পাদিত)
আরও পড়ুন: ভোটে জিতে নিশ্চিন্তে থাকার দিন শেষ! ‘দাদা-দিদি’দের দেখিয়ে দিল বাংলাদেশ




Be First to Comment