ধীমান ব্রহ্মচারী
জীবন ও জীবিকার টানে নব্বই দশকের কবি তালিকায় তাঁর নাম হয়তো নথিবদ্ধ হয়নি, এই প্রথম তাঁর কবিতার বই বেরোল, যে বইয়ের পাতা উল্টোলেই কবিতার পাঠক বিষাদে আক্রান্ত হবেন এই ভেবে যে এমন একজন কবিকে আমরা কেন এতদিন এ ভাবে পড়তে পারিনি।। তাঁর কবিতার ছায়াময় নরম অন্ধকার আর তারকভস্কির আলো-একেবারেই তাঁর নিজস্ব। হয়তো পেশাদার চিত্রগ্রাহক বলেই আলো ছায়ার মুদ্রা তাঁর করায়ও। মনখারাপ, নস্ট্যালজিয়া, মফস্সলযাপন, নানা প্রান্তিকতার পাশাপাশি বিষণ্ণ যৌনতাও ছুঁয়ে থাকে তাঁর অক্ষরজীবন।
‘যেভাবে গ্রুপ ফটোয়, পিকনিকে আলগোছে ডাকেনি কেউ শেষ শীতে
অপমান আসলে হালকা
ছুঁড়ে দেওয়া সহজ এমনিতে।'(প্রান্তিক)
কথাগুলি ভূমিকাকার তৃষ্ণা বসাক বলেছেন বইটির ভূমিকায়। নব্বইয়ের প্রচারের আলোয় না থাকা কবি, যেহাতে নিয়ন্ত্রণ করেছেন কবিতার স্বতন্ত্রতা, এঁকেছেন শব্দ দিয়ে কবিতার শরীর,ঠিক তেমনইভাবে এই দশকে জানান দিচ্ছেন তাঁর চিন্তার কথা। কবিতায় যে মায়াকাব্য তিনি তৈরি করেছেন, তা যেন তাঁর নিজস্ব স্টাইল। কবিতায় তিনি পাঠককে করেছেন সম্মান, দিয়েছেন স্পর্ধা এবং বিনয়ের সঙ্গে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আজকের এই বস্তুবাদের বা ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থায় তিনি নিভৃতে বিচরণ করেছেন শব্দ ব্রহ্মর অপার সম্ভাবনাময় এক অনন্ত পথে। বইটির টাইটেল নামাঙ্কিত কবিতায় তাঁর শান্ত স্বর –
‘ অপমান আসলে হালকা
ছুঁড়ে দেওয়া সহজ এমনিতে ‘-(প্রান্তিক)
আজকের এই বস্তুবাদী সমাজ ব্যবস্থায় নিজ অপমান একপ্রকার হালকা হিসেবেই যেন দেখেছেন। তাই বিপরীতে থাকা ব্যক্তিকে বা তৃতীয় পক্ষকে তিনি আদেশ দিতে পারেননি,কিন্তু দিয়েছেন শান্ত আশ্বাস এবং আহ্বান। তিনি বলেন,
‘ দুপুর, ধোঁয়া ওঠা, ফেরিওয়ালার সুরে বেজে ওঠা পুরনো অপমান কত গান হওয়ার কথা ছিল, স্নান শরীর ছোঁয়ার মুহূর্তে উদাসীন কপূর!
শুধু দুপুরের বুঝি বিষণ্ণতা থাকে? দুঃখের ও থাকে কিছু নিজস্ব দুপুর…’ (বিষাদ)
এই কবিতায় তিনি কত সুন্দর এক দুপুরের বর্ণনা দিয়েছেন। আমরা যারা বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের তাদের কাছে দুপুর বেলার রূপ, রং এবং ছবি কত রকমের চোখে লাগে। নিঃস্তব্ধ দুপুরের পাঁচিল আলগা পাহাড়ায় গৃহস্থের, ইতস্তত গলির মোড়ে পড়ে আছে বাড়ির এঁটো খাবার। গলির কুকুরের আনাগোনা। কিন্তু এই দুপুরের ফেরিয়ালার সুরে বাজে পুরনো গান বা পুরনো প্রেম বা পুরনো স্মৃতি। আজ সবটুকু মুছে গেছে যেন, সবটুকু সেদিনের মতো যেন আর নেই। নর-নারীর যেন বিষণ্ণতা, যে না পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, সেই তীব্রতায় তো আজকে কবিকে করেছে নিরাশ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি লেখা মনে পড়ছে —
‘যে আমায় চেনে আমি তাকেই চিনেছি
যে আমায় ভুলে যায়, আমি তার ভুল
গোপন সিন্দুকে খুব যত্নে তুলে রাখি
পুকুরের মরা ঝাঁঝি হাতে নিয়ে বলি’..(যে আমায়)
আসলে এই ‘ যে ‘ আসলে কে ? অথবা যদি ধরেইনি,এইতো সেই কবির মানুষ। কবির মন। কবির বাউল। কবির প্রেম। তাহলেইতো কত সহজ হয়ে যায় আমাদের ধরা। আর এই প্রেমইতো হয়ে উঠেছে শর্ত সাপেক্ষ। কবি এখানে চিনেছেন তাঁকেই,যিনি কবিকেই চিনে রেখেছেন নিজের মনে। নিজের চিন্তা চেতনায়।তাই কবির স্পষ্ট স্বীকার মনে রাখা মানুষকেই তিনি মনে রাখবেন। সে যদি ভুলেও যান তাহলেও তাঁর ভুলটা কবি তাঁর গোপন সিন্দুকে রেখে দেবেন প্রেম দিয়ে, আলো দিয়ে। কবি সোমও কি এই পথেই হাঁটছেন না? খুব ভালোভাবে খেয়াল করলেই বোঝা যায়, কবিতার এই চিরকালীন স্বীকারোক্তি। বেশ কিছু কবিতা যেমন –
‘ বিষণ্ণতা বৃষ্টির ঘরে থাকে
জন্মের ভেতরে আরেক জন্ম
পূর্বাভাস আঁকে
বিষণ্ণতা বৃষ্টির ঘরে থাকে
দিনান্তে জমে জল এবং স্নেহ
যে পথে যাবে অমায়িক সন্দেহ ‘-(ভাঙন)
এই বিষণ্ণতার মধ্যেই কবি জীবনের প্রাপ্তিটুকু তিনি পান। যে মায়াপ্রাপ্তি তাঁর জীবনের সম্পদ হয়ে দাঁড়ায়।
আবার তিনি লিখছেন,
‘হেরে যাওয়া, ক্ষয়, নানা সঞ্চয়
ঝাঁপির ভেতরে দিনপ্রতি ভয়
পুষেও যারা যে যার মতো
দু-আধ ফোটা তারার মতো ‘-(দাবী)
তাই সরলরেখায় নিজের জীবনের প্রতি তাঁর এই ছুঁয়ে দেখা তাঁর শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তির মতোই। এসঙ্গে লেখেন,
‘ ক্রমশ ঝাউ নেমে এলে
তুমিও শীতকে ডাকলে চই
চই হাতে তুলে নিলে কমলালেবুর মতো পৌষ
এক বিকেল বিষণ্ণ ধুনুরি। -(শীত)
এই আলো আধারের কাল। শীত কাল। শীতের পসরায় সাজানো আছে তাঁর প্রেম আগল। এই তুমিই তো কবির স্বপ্ন। এইভাবেই কবিতার কথায়, শব্দের জাল বুনতে বুনতে কবি সোম রায়চৌধুরী নির্মাণ করতে পারেন একটা বিষণ্ণ তবে মায়াবী জগৎ।যেখানে আমরা পাঠক হয়ে খুব সহজেই চিরাচরিত আগল থেকে পৌঁছে যায় তাঁর ভুবনে। তাঁর এই জীবনের এই চরম ব্যস্ততায় তিনি লিখতে পারেন কবিতা। শব্দ দিয়ে তৈরি করেন হালকা সুতোর জাল।
কাব্যগ্রন্থ: অপমান আসলে হালকা – সোম রায়চৌধুরী/ এবং অধ্যায় প্রকাশনা/ মূল্য – ২২৫.০০
Be First to Comment