Press "Enter" to skip to content

হালখাতা লালখাতা

তাপস রায়

সত্যি আর মিথ্যে — গণেশের পায়ে আজকাল দুটোকেই চরাতে লাগে। দুটোকেই হালখাতার দিনে হলুদ, সিঁদুর লাগিয়ে রাখতে হয়। লাল সুতোয় জড়িয়ে পুরোহিত দুটোকেই মন্ত্রপুতঃ করে দেয়। স্বস্তিক চিহ্ন আঁকে গোটা বছরের হিসেব নিকেষের খাতায়। সকাল সকাল কালীঘাটের মন্দিরের পাণ্ডাকে ঘুষ দিয়ে লাইন বাঁচিয়ে এসে দশটার মধ্যে এখানে, এয়ারপোর্টে। হ্যাঁপা একদিনের, নাফা গোটা বছরের। সিল্কের সাদা পাঞ্জাবীতে সিঁদুরের দাগের দিকে তাকিয়ে তেমন দৃকপাত করলে চলে না। লাগলে লাগুক।

হেমবতী লক্ষ্ণৌর ধুপ জ্বালিয়ে দিয়ে শিলিগুড়ির রবীন্দ্র সরণীতে ঘরময় দিব্যতা এনেছেন। কাচা হলুদ রঙের পিঠে সকালের রোদের ফালি পিছলে যাচ্ছে। পুজোর জায়গা, বাসন-কোশন, ফল-ফলাদি, ধান-দুব্বো, ফুল সব রেডি। সব নিজের হাতে করেন। এমনকি সিঁদুর,তেল, প্রদীপ, শঙ্খ, ঘন্টা, পুজোর আসনও সিদ্ধিদাতা গনেশের মুর্তির সামনে নির্দিষ্ট দূরত্বে পাতা — সবটুকু তাঁর। এই বাড়ির পুজো হেমবতীর নিজের। দোকানের পুজো তাঁর স্বামী জলধর দেখেন।

রাত থাকতে স্বামীকে যেমন বিছানা থেকে ঠেলে তুলে চান-টান করে কালীঘাটের উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছেন, তেমনি নিজেও স্নানটান সেরে এদিকটা গুছিয়ে নিচ্ছে্ন। এক একবার ঊঠে ঊঠে একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখে নিচ্ছেন হেমবতী কোথাও কোনো কিছু কম পড়ল কি না!

একটা ছোটো জল-চৌকির উপর পিতলের কলসি আর তার উপরে আমের পল্লব সহ পান আর গোটা সুপুরি আছে। ঘটের দুপাশে বসবে ব্যাবসার দু-দু’খানি লাল খাতা। ঘটের সামনে সিঁদুর রাঙা রূপোর টাকা, যা বংশ পরম্পরায় এ বাড়িতে আছে ।

উবু হয়ে কাজ করতে করতে হেমবতীর কোসা শাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসেছিল তার বুকের স্বর্ণ মহিমাটুকু। তা যেন কেউ দেখে ফেলেছে এমন সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে ঢাকতে ঢাকতে এবার মনে পড়ল আর একটি কাজের। রুস্তমের সোনার আপেল দেয়া হয়নি তো। আলমারির নিজস্ব লকার থেকে বের করে এনে চোখের আড়ালে জলের ঘটির ভেতর রেখে দিলেনও তা।

এ বাড়ির সমৃদ্ধি বৃদ্ধির সাথে ওই আপেলের বুঝি সংযোগ আছে। বাবা গণপতি এই বাড়ির ধন যেমন প্রতি বছর বাড়িয়ে তোলেন, তেমনি হেমবতীর চোখে ওই আপেলের শ্রীও বেড়ে যায় দিন দিন।

শোয়ার ঘরের আলমারিতে লাগান আয়নার সামনে এসে হেমবতী এবার গা থেকে নিজের পোশাক ফেলে দিলেন। নতুন লালপাড় গরদের শাড়ি আর ব্লাউজ পড়তে হবে। একটুকু কাজল দিতে হবে চোখে । ঠোঁটে একটু লাল আভা। এমনিতেই হেমবতীর ঠোঁট তাঁর শরীরের হেম প্রভার সঙ্গে মানান সই হয়ে উজ্জ্বল গোলাপী। তবুও আরো নিখুঁত করে নিতে চান নিজেকে। দুপুর দুপুর আসবেন বিশিষ্ট সারেঙ্গীবাদক রুস্তম খাঁ। তিনি চান পুরোহিতের সামনেই নিজেই সই করবেন নতুন খেরোর খাতায়। দুটি খাতা জমা দেয়া থাকে গণপতির পায়ে। একটির উপরে তানপুরার ছবি সাঁটা, অন্যটিতে সারেঙ্গি। রুস্তম খাঁর বিশ্বাস এই ডিভিশনে এসে গণপতি তাঁকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন এই নবর্ষের হালখাতার পুজো করেন বলেই।

সোনার আপেল জলের কলসীতে রেখে এসে আয়নায় তাকালেন হেমবতী। নিজের বুকেও দুটি সোনার আপেল। এতগুলো বছরের পরও কোথাও টোল পড়েনি। রুস্তম-এর তো শুধু সারেঙ্গিতে দম, তা তো নয়, মোচরানো গোঁফে তা দিয়ে গোঁফের ফাঁকের সাদ দাত মেলে যা একবার বলে, তা খেটে যায়। সেই কবে হেমবতীকে বুকের ভেতর নিয়ে তার বুকের শস্য দেখে বলেছিলেন রুস্তম খাঁ, “ তোমার বুকে যে দুটি সোনার আপেল ফুটে আছে, তুমি কি তা জানো ঠুংরি মহারানি?”

হেমবতী বলেছিলেন, আমি জানব কী করে! আমি কি দেখতে পাই, সে কেমন! আয়নায় প্রতিবিম্ব, মানে ছায়া দেখা যায়, কায়া দেখা যায় না। তখন ওস্তাদ রুস্তম সিং একদিন একটি সোনার আপেল হেমবতীকে ঊপহার দিয়ে বলেছিলেন, “এইই হচ্ছে তোমার বুকের শস্য। একে যত্নে রাখবে।”
সেই থেকে যত্নে ও গোপনে রাখেন নিজের ও দানের আপেল। বছরে এই একটি বার বের হয়। এবাড়ির গণপতি বড় জাগ্রত। হেমবতী জানেন, আর টের পান তা।

সারেঙ্গী আঁকা খাতার দিকে চোখ রেখে মনে পড়ল, তাইত, আর একটি রূপোর টাকা রাখতে হবে। একটা এইঘরের শান্তি আর সমৃদ্ধির জন্য, আর একটা তার বিশেষ আপনজন রুস্তমের জন্য। স্বামীর আসল নকল খাতাদের মতো এখানে কোনটা সত্যি, মানে ঘর সত্যি না বাহির জানেন না। ফলে দুটোকেই হেমবতী গণপতির আশীর্বাদে চুবিয়ে নেন।

স্বামী জলধর দত্ত সোনার কারবারি। শিলিগুড়ির হংকং মার্কেটের বাইরে বিশাল গ্লো সাইন সহ দ্বিতল দোকান, দত্ত গিনি মহল। জলধর দত্তরা অনেক পুরনো সোনার বেনে। তাদের পূর্বপুরুষরা নাকি সপ্তগ্রামের বিখ্যাত সোনার বেনে ছিল। কলকাতা পর্যন্ত দত্ত সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পড়েছিল। আর বৃটিশ কলকাতার উঠতি বাবুদের যা হয়, সেই রোগেই পূর্বতন দত্তবাবুরা বাইজি আর মদে সব বিত্ত ফুঁকে দিয়েছিলেন। তারপরের কয়কটা প্রজন্মর করুণ দশা। কিন্তু রক্তের ভেতর যে সোনার বেনের মহিমা তা টের পেয়ে জলধর একদিন চলে আসেন এই শিলিগুড়িতে। ভাড়া বাড়ি নিয়ে দোকান করে্ন। তারপর তো এই গিনি মহল। জলধর জানেন তাঁর এই সমৃদ্ধি কালীঘাটের লালখাতার কৃপা।

গুণধর পাণ্ডা প্রতিবছর মায়ের পায়ের প্রথম খাতাটিকে জলধর দত্তকে সমর্পণ করেন। এই খাতার এমন মহিমা যে সিন্দুকে রাখা হবে, তা এমনিতেই ধন-রত্নে ভরে উঠবে। তবে সাবধান। অযত্ন যেন না হয়। তাহলেই গোল।
জলধরের সোনা আসে নেপাল থেকে। নেপালে ঢোকে আফগানিস্তান থেকে। আর আফগানিস্তানে আসে কুয়েতের সোনা। এত হাত ঘুরে এলেও অনেক সস্তা। কয়েকবছরের ভেতর জলধরের সোনার সাম্রাজ্য ফুলেফেঁপে ওঠায় লোকজনের চোখে তো পড়বেই। একদিন ইনকাম ট্যাক্স রেইড করল। দোকানে আর বাড়িতে এক সঙ্গে।
জলধর দোকানের বাইরে অচেনা গাড়ি পরপর দাঁড়াতেই কি মনে করে সিন্দুক খুলে আসল হিসেবের লাল খাতাখানি বের করে কারখানায় ছাইয়ের গাদার ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। আর দুনম্বরী খাতা সিন্দুকে। এই খাতার রেকর্ডেই ট্যাক্স দেয়া হয়।

অফিসারেরা দুনম্বরী খাতা নিয়ে চলে যেতে গিয়ে ফিরে এসে বলল, “ উঠুন গাড়িতে। আমাদের সঙ্গে যেতে হবে উপরঅলার হুকুম। আপনার এত বড় কারবার, অথচ খাতা-কলমে তেমন কিছু একটা দেখাচ্ছে না। নিশ্চই কোনো গন্ডগোল আছে। চলুন তো অফিসে।”

বিকেলে বাড়ির দোতলার জানায় দাঁড়িয়ে হেমবতী খালিগলায় একটা বুনো ঠুংরি ভাঁজছিলেন। এসময় হাতের মোবাইলে মেসেজ এলো। আর ঠিক সেই মুহূর্তে বাড়ির সামনে দু-তিনটে গাড়ি। হেমবতী বুঝে নিয়েছেন, বাড়িতেও আসছে ওরা। এবার কি হবে! শোবার ঘরের পালঙ্কের পায়ার ভেতর সোনার বিস্কুট ভরা যে!

হেমবতী সব সময় সুন্দর পোশাকেই থাকেন। ঝটকরে একটু সেন্ট গায়ে ছড়িয়ে তানপুরাটা সামনে টেনে নিয়ে সেই ঠুংরিটিতে অল্প স্বরে আলাপ সঞ্চার করতে লাগলেন। মাথা নিচের দিকে নামানো । একটা ধ্যানী মূর্তি। দীর্ঘদিন কালোয়াতি গানের চর্চা করে আর মজলিসে ঘুরে দেখেছেন, প্রায় সব মানুষই সুরের বশ। তিনি জানেন নীচে চাকর জনার্দন দরোজা খুলে দেবে। তখন ওরা উপরে উঠে আসবে।

ইচ্ছে করেই আলাপ থেকে ঝাল্লায় চলে যান হেমবতী। অনেকটা সময় লাগবে। ততক্ষণ দাঁড়াবে কি ওরা! ওদের ধৈর্যচ্যুত করতে পারলে কাজে খেই হারিয়ে ফেলবে। হেমবতী ঠুংরিতে নিজের কারুকাজ মেশাতে থাকেন। ঠুংরিতে লাগালেন ধ্রুপদের গমক। তাঁকে তো বশও করতে হবে নির্দিষ্ট শ্রোতাকে। মেশালেন খেয়ালের হলক তান। আর টপ্পার দানা। ঠিক করে রাখলেন ঢেউ খেলানো মীড়ও দেবেন একটু পরেই।

“ আহা কি দরদ! অসম্ভব জোরদার আর সুরেলা আওয়াজ আপনার গলায়। এই ঠুংরিতে কী আন্দাজ! এখানে এই জঙ্গলে বসে লখনৌ ঘরানার ঝিঞ্ঝিট রাগ শুনতে পারব, ভাবিনি! সঙ্গে সারেঙ্গি থাকলে আরো তুখড় শোনাত।”

হেমবতী গান থামিয়ে বললেন, “ অনুষ্ঠান থাকলে একজন আসেন বাজাতে, রোজ আসেন না।”
“আমি কি একবার …”।

সেই দীর্ঘদেহী পাকানো গোঁফের ভদ্রলোক সামনের সোফাতে বসে পড়েই নিখাদ পঞ্চমে সারেঙ্গি বাঁধলেন। তারপর গানের তোয়াক্কা না করেই ঝরনার স্রোতের মতো সুরের আবহ ঘরময় ছড়িয়ে দিলেন। বেশ খানিকক্ষণ বাজানোর পর সম্বিত পেয়েছেন যেন, তেমনি করে জিভ কেটে বললেন, “ দেখেছেন, দেখেছেন, আপনার গান শুনব কোথায়, না আমি বেহদ্দ বাজনা বাজাতে বসেছি। ছিঃ ছিঃ। আপনি গান ম্যাডাম।”

হেমবতী সুযোগ নিলেন। সুযোগ বারবার আসে না। মেহফিলে গান ছাড়া আদবও একটা বড় ব্যাপার। হেমবতী বললেন, “ এই সুরের বেহেস্ত বনে যাবার পর আমি কি আর আমার গান শোনানোর হিম্মৎ রাখি!”
“ নাহ্। গান ম্যাডাম। আমি আপনাকে মাঝ পথে থামিয়েছি।”

হেমবতী চাইলেন এই রসিক পুরুষকে মেরে ফেলবেন। তাঁর তূণের শ্রেষ্ঠ একখানা তির নিক্ষেপ করলেন। এটা ‘রসিকরঞ্জনী’ রাগ। তেমন ব্যবহার হয় না। তানপুরায় আঙুল ছুঁয়ে গান ধরলেন, “ আজ আয়ে মোরে ঘর রাজাধিরাজ, করুঙ্গা মঙ্গল দীপ গান।”

“ আহা হা, কি মধুর! কি মধুর!। আপনার কন্ঠ থেকে তো সোনা ঝরে পড়ছে। আমার সারেঙ্গি তো আপনার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না।”

হেমবতী দেখলেন মেহফিল হাতের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছেন। বুঝে গেছেন, আর কোনো বিপদ নেই। ইনকাম টাক্স অফিসার তাঁর বশ এখন। তিনি কথা ফেললেন, “ কিন্তু ওস্তাদজি, বেয়াদবী মাফ করবেন। আজ যে আমার মন খুব চঞ্চল। আমি গানে তেমন করে প্রাণ লাগাতে পারছি না যে!”
“কেয়া কহেনা!”

“ দেখুন, আজ বিনা কারণে আমার স্বামীকে শিলিগুড়ির ইনকাম ট্যাক্স দপ্তরে ডেকে নিয়ে গেছেন অফিসারেরা। একটু আগেই মেসেজ এসেছে। আমি খুবই ডিস্টার্বড।”

“এহি বাত!”

পেছনে ঘুরলেন। “চ্যাটার্জী, অফিসে ফোন করে বলে দাও তো।”

দরজার পাশে ছায়ামূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলল, “ স্যার, এই বাড়িটা তাহলে রেড করব না!”

“ না। আমি কমিশনার বলছি, যে বাড়িতে স্বয়ং সরস্বতীর বাস, সেখানে কোনো দুর্নীতি থাকতে পারে না।”

কমিশনার রুস্তম খাঁ উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে বললেন, “ আজ অনেক অনেক দিন বাদে প্রাণে আরাম হলো। কতদিন পর যে সারেঙ্গির তারের ভেতর থেকে প্রাণ এনে নিজের প্রাণে লাগালাম! ম্যাডাম, আপনাকে নমস্কার। আজ আসি? আবার আসব। ”

ফোন পাবার পাঁচমিনিটের ভেতর জলধরকে ছেড়ে দেয়। জলধর তো অবাক । নো পয়সাকড়ি বিজনেস! মনে মনে কুড়ি লাখের একটা এস্টিমেট নিয়েই ছিলেন। তাতেও কোটি টাকা বেঁচে যাবে ট্যাক্সের। ঠিক করেছিলেন, প্রতি বছর ওই কুড়ি লাখই দেবেন, বিনিময়ে নিরুপদ্রবে ব্যবসা। কিন্তু বাই জোব! কোনো রফার নামই কেউ নিল না। বদলে দামি চা খাইয়ে নিজেদের গাড়িতে করে দোকানে পৌঁছে দিয়ে গেল! জলধর দোকানে এসে প্রথমেই ছাইয়ের গাদার
ভেতর থেকে আসল লালখাতা বের করে এনে ভালো করে পরিস্কার করে, গঙ্গাজলে মুছে তাতে কপাল তিনবার ছুঁইয়ে আবার সিন্দুকে তুলে দিলেন। সিন্দুকের যেখানটায় নকল খাতা রেখেছিলেন, সেখানটা গঙ্গাজলে মুছে নিলেন। মুছতে মুছতে ঠিক করলেন,এবার থেকে বছরের শুরুতে আসল, নকল দুখানি খাতাকেই কালীঘাটের দেবী পায়ে ছুঁয়ে সিদ্ধ করে নেবেন। তাতে খরচা একটু বেশি হলে হোক।

তখন থেকে জলধর দত্ত প্রতি বছর দুটি করে খাতার পুজো করেন। আর কোনো খরচা নেই। খরচের ভেতর পাণ্ডার প্রণামী। যা তিনি নিজেই দশ হাজার থেকে কুড়ি হাজার করেছেন। আর মাত্র একবারই ইনকাম ট্যাক্স কমিশনারকে একটা সোনা দিয়ে বানানো আপেল পাঠাতে হয়েছে। ব্যাস! এইই হলো খেরো খাতার হিসেব নিকেষ।

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *