অঞ্জন চক্রবর্তী ও অনুপ ধরের ‘কথপোকথনে মার্ক্স ও রবীন্দ্রনাথ (উন্নয়ন ও বিকল্প) ‘ বইটির মধ্যে বিস্তর আলোচনা আছে রবীন্দ্রনাথ ও মার্ক্সের চিন্তা ও দর্শন নিয়ে। প্রায় বিশেষ বিশেষ কিছু কথপোকথন প্রস্তুত করতে পেরেছেন লেখকদ্বয়। লিখলেন ধীমান ব্রহ্মচারী
১. বাঙালির কাপড়ের কারখানা ও হাতের তাঁত
২. রবীন্দ্রনাথ: একটি যাযাবর সত্তা

৩. হীরক রাজার দেশে নন্দিনীর গ্রাম
৪. মার্কসীয় অর্থনীতি ভাবনা
৫. উন্নয়ন: অর্থনৈতিক বাস্তবতার জটিল বিন্যাস ও তার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন
৬.আধিপত্য ও প্রাকরুদ্ধি: পুঁজিবাদ কি ?
এছাড়াও আরও বিশেষ কিছু..একটি সুন্দর ধারণার পাশাপাশি আমাদের ব্যক্তিঅবস্থান এর নির্দিষ্ট দিক ও সাফল্যের আভাস কোথাও উঠে আসে। একটু বইটা নিয়ে নাড়াঘাটা করি
‘…এই লেখাটার নাম রাখলাম- কথোপকথনে মার্ক্স ও রবীন্দ্রনাথ: উন্নয়ন ও বিকল্প। লেখাটি একটি কথোপকথন।
কথোপকথন মার্ক্স ও রবীন্দ্রনাথ-এর মধ্যে।
সেই অর্থে এই লেখাটি মার্ক্স-রবীন্দ্রনাথ-এর কথোপকথনের উপর আধারিত। আধারিত একটা ‘না হওয়া’, একটা ‘না হয়ে ওঠা’ কথোপকথনের উপর। আধারিত একটা ‘সম্ভাব্য’ কথোপকথনের উপর। এমন একটা কথোপকথন যেটা হলেও হতে পারত। কিন্তু হয়নি। হয়ে ওঠেনি। হয়নি কারণ মার্ক্স-রবীন্দ্রনাথ-এর কিছু বিশেষ পাঠ, কিছু সরল-তরল পাঠ আমাদের কল্পনাকে অধিকার করে রেখেছিল এতকাল; এবং পরিণতিতে প্রতিহত করতে থেকেছিল মার্ক্স-রবীন্দ্রনাথ-এর অন্য কোনও পাঠ; একই সঙ্গে প্রতিহত করতে থেকেছিল মার্ক্স-রবীন্দ্রনাথ-এর মধ্যে কোনও সম্ভাব্য কথোপকথন।
হয়তো বা আমাদের উদ্বেগ-উৎসাহ-কে অবলম্বন করে সেই না-হওয়া কথোপকথনের, সেই না-হয়ে-ওঠা কথোপকথনের কিছু মাত্রা এই লেখার সীমিত পরিসরে আকার পাচ্ছে। কথোপকথনটা আকার পাচ্ছে আমাদের মধ্যে দিয়ে; আমাদের দুজনের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে তা আকার পাচ্ছে। এমনকী আমাদের সঙ্গে অন্যদের কথোপকথনের মধ্য দিয়েও তা আকার পাচ্ছে। পাচ্ছে শরীর।’
বইটির শুরুর কথা লেখা হচ্ছে এইভাবে।
এদিকে কার্ল মার্কস অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ। একদিকে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে স্বর আর অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের সমবায়। বিশ্ব ইতিহাসে উনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ তিন ব্যক্তিত্ব কার্ল মার্কস, চার্লস ডারউইন এবং সিগমুন্ড ফ্রয়েড। এরই সাথে আমাদের সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই বইটি মূলত দুই ব্যক্তিত্বকে নিয়ে। মার্কস এবং রবীন্দ্রনাথ। দুই ব্যক্তিই তাঁদের সমাজ চিন্তা,ভাবনা এবং জীবনব্যাপী নানান কাজের মধ্যে দিয়ে সমাজের বিরাট একটি ধারণা দিয়েছেন আমাদের। পুঁজিবাদের বিপরীতে সমান এক সমাজ ব্যবস্থা নির্মাণ করতে গেলে যে যে বিষয়গুলি আমাদের ভাবায় অথবা আদৌ যেগুলো বিষয়ের মধ্যেই আবর্ত থেকে যাবে অথচ কোনো কাজই হবে না অথবা সেই সম্যক চিন্তার বারংবার পুনরাবৃত্তি চালিয়ে যেতে হবে — তাহলে বর্তমান সভ্যতার নিরিখে রাজনৈতিক মতবাদের নতুন সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে।
বইটির ‘ শিল্প বনাম কৃষি ‘ প্রবন্ধে বেশ কিছু ব্যবস্থা ও মতবাদের ওপর আলোচনা হয়েছে। একটু কিছু বক্তব্য আনি —
” কৃষি আমাদের ভিত্তি আর শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ- ভিত্তি থেকে ভবিষ্যৎ- অতীত থেকে সামনে- পথচলার (বা থেমে না থাকার) এই ছকটা তো মেনস্ট্রিমই আমাদের দিয়েছে। আর আমরা মেনস্ট্রিমের দেওয়া এই সিঁড়ির ধাপগুলো নিয়েই তর্কবিতর্ক করে চলেছি। কোন ধাপটায় কখন পা ফেলব; এখন ফেলব কি না; এইভাবে ফেলব কি না; কোন ধাপটা আগে আসবে, কোনটা পরে; এই নিয়েই তো আমাদের যত তর্ক। আমরা এখন ঠিক কোন ধাপে আছি? সামন্ততন্ত্রে আছি? না পুঁজিবাদে আছি? নাকি দুটোর মাঝামাঝি, আধাআধি কিছুতে আছি? আধা-ধাপ না সিকি-ধাপে আছি? আমাদের ধাপটা আধা-সামন্ত্রতান্ত্রিক না সিকি-সামন্ততান্ত্রিক? ধাপ সর্বস্বতার এই ফাঁদে আমরা ধরা দিলাম কেন? ধাপের এই প্রবঞ্চনাতে কেন আমরা বাঁধা পড়ে গেলাম? জগৎসংসারের পথচলাটা কেন ভাবতে হবে সিঁড়ির রূপকটির মধ্য দিয়ে- এই প্রশ্নটাই তো সবার আগে করার দরকার ছিল আমাদের। কিন্তু আমরা করলাম কই? আমরা তো সেই মেনস্ট্রিমের ভাববিশ্বের শরিক হয়ে গেলাম। ধাপের ধরন-ধারণ নিয়ে আমরা বিরোধী বটে, এই ধাপ থেকে ওই ধাপে যাওয়ার পদ্ধতি-প্রকরণ নিয়ে আমরা তর্কসর্বস্ব বটে, কিন্তু ধাপসর্বস্বতার বা ধাপসর্বস্ব ইতিহাসকল্পনার বিরোধিতা করলাম কই?..” খুব সুন্দর ভাবেই আমাদের প্রাচীন কাল থেকেই একটি ধারণার নিরন্তর প্রচেষ্টার কথা বলেছেন। একটি দেশের বা রাষ্ট্রের অবশ্যই ফসল বা খাদ্যশস্য প্রথম এবং প্রধান সম্পদ। কিন্তু বর্তমান সভ্যতা যেভাবে যন্ত্রের পক্ষে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে,সেখানে সম্পদ থেকে উৎপাদন সবই যন্ত্র করছে। অর্থাৎ আমার যন্ত্র সভ্যতায় নিজেদের এডজাস্ট করে ফেলেছি। তাহলে সমস্যা কোথায়? আমার ব্যক্তিগত ভাবেমনে হয় যেকোন দেশের বা রাষ্ট্রের উন্নতির আরও একটি মূল ও প্রধান দিক সেই রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো, শ্রমিকের শ্রম। ওপরের কথাগুলি একটু ভালো করে দেখছিল বোঝা যাবে, আমার কোনটা আগে মেনেছি বা মানব ইত্যাদি। আসলে কৃষি যদি যেকোন দেশের প্রাণশক্তি হয় তাহলে সেই দেশের বা রাষ্ট্রের পরবর্তী ভাবনা কী হতে পারে ? কেননা বিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমার কখনোই শিল্পের ব্যবহার বা প্রয়োগকে অস্বীকার করতেই পারিনা। তাহলে সমস্যা কোথায়? ওপরের কথাগুলি মাথায় রেখেই বলতে পারি,সমস্যা একটি রাষ্ট্রের প্রয়োগের ক্ষেত্রে। আমরা একই জীবন পদ্ধতি মেনে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাব ? নাকি সময়ের স্বার্থে, রাষ্ট্রের স্বার্থে সঠিক সময়ে প্রয়োগ করব?
রবীন্দ্রনাথের কাছেও প্রশ্ন: বিকল্প। বিকল্প সমাজ-সত্তার কল্পনা। বিকল্প উন্নতি-কল্পনা।
কীভাবে সম্ভব ‘পল্লীর উন্নতি’, পল্লির শ্রীবৃদ্ধিসাধন? রবীন্দ্রনাথ যেন জানেন- এই পথে নয়- নিওক্লাসিকাল ‘গ্রোথ’ এবং ‘ওয়েলফেয়ারিজম’-এর পথে নয়। কিন্তু কোন পথে? কী সেই বিকল্প পথ? রবীন্দ্রনাথের কাছে বস্তুত ফললাভের আয়োজনের দুটো ভাগ আছে- ‘একটা ভাগ আকাশে, একটা ভাগ মাটিতে। এক দিকে মেঘের আয়োজন, এক দিকে চাষের। আমাদের নব শিক্ষায়, বৃহৎ পৃথিবীর সঙ্গে নূতন সংস্পর্শে, চিত্তাকাশের বায়ুকোণে ভাবের মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। এই উপরের হাওয়ায় আমাদের উচ্চ আকাঙক্ষা এবং কল্যাণসাধনার একটা রসগর্ভশক্তি জমে উঠেছে। আমাদের বিশেষ করে দেখতে হবে শিক্ষার মধ্যে এই উচ্চভাবের বেগ সঞ্চার যাতে হয়। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিষয়শিক্ষা। আমরা নোট নিয়েছি, মুখস্থ করেছি, পাস করেছি। বসন্তের দক্ষিণ হাওয়ার মতো আমাদের শিক্ষা মনুষ্যত্বের কুঞ্জে কুঞ্জে নতুন পাতা ধরিয়ে ফুল ফুটিয়ে তুলছে না। আমাদের শিক্ষার মধ্যে কেবল যে বস্তুপরিচয় এবং কর্মসাধনের যোগ নেই তা নয়, এর মধ্যে সংগীত নেই, চিত্র নেই, শিল্প নেই, আত্মপ্রকাশের আনন্দময় উপায় উপকরণ নেই। এ যে কত বড়ো দৈন্য তার বোধশক্তি পর্যন্ত আমাদের লুপ্ত হয়ে গেছে। উপবাস করে করে ক্ষুধাটাকে পর্যন্ত আমরা হজম করে ফেলেছি।… আমাদের শিক্ষার মধ্যে এমন একটি সম্পদ থাকা চাই যা কেবল আমাদের তথ্য দেয় না, সত্য দেয়; যা কেবল ইন্ধন দেয় না, অগ্নি দেয়। এই তো গেল উপরের দিকের কথা। তার পরে মাটির কথা, যে মাটিতে আমরা জন্মেছি। এই হচ্ছে সেই গ্রামের মাটি, যে আমাদের মা, আমাদের ধাত্রী, প্রতিদিন যার কোলে আমাদের দেশ জন্মগ্রহণ করছে। আমাদের শিক্ষিত লোকদের মন মাটি থেকে দূরে দূরে ভাবের আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে- বর্ষণের যোগের দ্বারা তবে এই মাটির সঙ্গে আমাদের মিলন সার্থক হবে। যদি কেবল হাওয়ায় এবং বাষ্পে সমস্ত আয়োজন ঘুরে বেড়ায় তবে নূতন যুগের নববর্ষা বৃথা এল। বর্ষণ যে হচ্ছে না তা নয়, কিন্তু মাটিতে চাষ দেওয়া হয়নি।’ (পল্লীর উন্নতি- পল্লীপ্রকৃতি) কীভাবে বিরাট একটা সাধারণ সত্যের কথা রবীন্দ্রনাথ বলছেন।
তাঁর ‘রক্তকরবী ‘ নাটক —
” ‘যক্ষপুরী’- যেখানে ‘খোদাইকরের দল পৃথিবীর বুক চিরে দরকারের-বোঝা- মাথায় কীটের মতো সুড়ঙ্গের ভিতর থেকে উপরে উঠে আসছে।’ পাতালে সুড়ঙ্গ খুদে তারা বের করে আনছে যক্ষের ধন- বের করে আনছে অনেক যুগের মরা ধন- পৃথিবী যাকে কবর দিয়ে রেখেছিল। যক্ষপুরী- যেখানে সেই মরা ধনের শবসাধনা। সব জিনিসকে টুকরো করে আনাই যেখানে পদ্ধতি। যক্ষপুরী- যেখানে কোনও শ্রম-আইন কাজ করে না। যেখানে কোনও শ্রম-নিরাপত্তা নেই। যেখানে শুধু রাজার নিয়ম কাজ করে। যে রাজাকে আবার কখনও নাকি দেখা যায়নি। শুধু তার নিয়মগুলো সক্রিয় থেকেছে। তার অবর্তমানে। নিয়মগুলোই তৈরি করেছে একটা কাঠামো; একটা সংগঠন; একটা ছক। আর ওই নিয়মের জালেই সবাই বাঁধা পড়েছে। বাঁধা পড়েছে রাজার রাজত্বে। নাকি রাজা বলে কেউ নেই? শুনেছি রাজা আছেন জালের ওপারে। জালের ওপার থেকে ভেসে আসে তাঁর বাণী, তাঁর আদেশ। নাকি জালের ওপারে কেউ নেই? জালটাই শুধু আছে; আছে শুধু রাজার ভাবনাটা। আর ভাবনাটা আছে আমাদেরই মধ্যে। ওই ভাবনাটারই অধীন হতে থাকছি আমরা। ‘রাজা’ নামক ভাবনাটার। মনে-মননে জাঁকিয়ে বসেছে রাজা নামক ভাবনাটা। জাঁকিয়ে বসেছে রাজার অধীনে অধীনতার ভাবনাটা। রাজার কাছে বশ্যতার ভাবনাটা। নিয়ম মেনে চলার ভাবনাটা। যক্ষপুরীতে তাই কেউ কাজে যেতে দেরি করে না, কেউ কাজে ফাঁকি দেয় না, প্রশ্ন করে না রাজার ম্যানেজমেন্ট স্টাইলকে, যা মানুষকে পরিণত করে নম্বরে, প্রশ্ন করে না উদ্বৃত্ত আহরণের শোষক প্রক্রিয়াকে, প্রশ্ন করে না আহৃত উদ্বৃত্ত বণ্টনের অসম-অন্যায় কাঠামোকে। পরিণতিতে যা আরও আরও উদ্বৃত্ত আহরণের ভিত্তি প্রস্তুত করে- প্রস্তুত করে আরও আরও শোষণের জমি- মার্ক্সের ভাষায় যা আদতে pumping out the maximum possible amount of surplus value from the workers। পুরো শহরটা ডুবে থাকে দিনরাত, নিমগ্ন থাকে দিনরাত মাটির গভীর থেকে যক্ষের ধন তুলে আনার প্রক্রিয়ায় মাটির গভীরের অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে, মাটির বুকে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে; তুলে আনে যুগ যুগ ধরে সযত্নলালিত ধন- মৃত ধন। তুলে আনে সোনা- যে সোনা কখনও পরশপাথর হয়ে ওঠে না।..”
আবার অন্যদিকে —
” আমরা আগেই দেখেছি যে মার্ক্সিয় তত্ত্ব এক শ্রেণি অবলম্বী তত্ত্ব। কিন্তু শ্রেণির কোন ভাবনা মার্ক্সিয় তত্ত্বের অবলম্বন? মার্ক্সিয় শ্রেণিভাবনা সম্পত্তির মালিকানা কেন্দ্রিক নয়- কার কত সম্পত্তি আছে বা কার কত পয়সা আছে- কে বড়লোক আর কে গরিব- তা দিয়ে মার্ক্সিয় শ্রেণিভাবনাকে নির্দিষ্ট করা যায় না। যদিও কিছুটা দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, মার্ক্সের শ্রেণিভাবনা অনেক সময়েই বুর্জোয়া = বড়লোক এবং প্রলেতারিয়েত = গরিব, এমনতর সরলীকরণের শিকার হয়েছে বা হয়ে পড়ে। আবার কখনও কখনও মার্ক্সের শ্রেণিভাবনা ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে- কার কত ক্ষমতা আছে- কে ক্ষমতাশালী (এলিট), কে ক্ষমতাহীন (সাবঅল্টার্ন) তার উপরই যেন নির্ভর করেছে কে বুর্জোয়া আর কে প্রলেতারিয়েত। আমাদের কাছে মার্ক্সের শ্রেণিভাবনা না ক্ষমতাকেন্দ্রিক, না সম্পত্তিকেন্দ্রিক। মার্ক্সের শ্রেণিভাবনা উদ্বৃত্ত শ্রম-অবলম্বী এক ভাবনা। মার্ক্স যখন শ্রেণি নিয়ে ভাবেন তখন তিনি আদতে (উদ্বৃত্ত) শ্রম নিয়ে ভাবেন- সে (উদ্বৃত্ত) শ্রম, (উদ্বৃত্ত) মূল্য বা (উদ্বৃত্ত) উৎপাদন- যে আকারেই অভিব্যক্ত হোক না কেন।
আবার, এই আলোচনায় আছে —
” সনাতন মার্ক্সবাদ-এর সমস্যা
ভারত এবং, প্রকৃতপক্ষে, সারা বিশ্বেই, সনাতন মার্ক্সবাদ এতকাল অবধি মার্ক্সের ‘কমিউনিস্ট ইস্তেহার’-এর সূত্র অনুসরণ করে ‘শ্রমিক শ্রেণি’-কে এক সমসত্ত্ব (homogeneous) পরিসর হিসেবেই ভেবে এসেছে (চক্রবর্তী, কালেনবার্গ ও ধর, ২০০৭)। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের যুক্তিকাঠামোতে শ্রেণিকে ভাবা হয়েছে এক সচেতন কার্যকারক হিসেবে। এক সচেতন এজেন্ট হিসেবে। এই সচেতনতা আসবে কোথা থেকে? জন্মগতভাবে তা শ্রেণির মধ্যে থাকবে? না, থাকবে না। এই সচেতনতা আসবে শোষণের অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস থেকে। আসবে যুগ যুগ ধরে শোষিত হওয়ার অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস থেকে। স্বাভাবিকভাবেই আসবে? আসবে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে? না। অভিজ্ঞতা ও চেতনার মধ্যে মধ্যস্থতা করার জন্য থাকবে এ ভ্যানগার্ড পার্টি অব এডুকেটরস- যার আর এক নাম ‘কমিউনিস্ট পার্টি’। প্রায় একই সঙ্গে শ্রেণির এই পরিচয়-পরিসরটিকে আমরা ভেবে নিলাম একটা সমসত্ত্ব গোষ্ঠীরূপে; কারণ, সেই গোষ্ঠীর সকলের মধ্যেই থাকবে শোষণের অভিজ্ঞতা এবং তার থেকে উঠে আসবে চেতনা। এই সমসত্ত্বতার সূত্র ধরেই যেন শ্রেণিকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল- পুঁজিবাদী শ্রেণি (অর্থাৎ শোষক শ্রেণি) এবং শ্রমিক শ্রেণি (অর্থাৎ, শোষিত শ্রেণি)। উনিশ শতকে সবকিছুকে এইরকম একটা ‘দুই’-এর ছকে ভেঙে ফেলার প্রবণতা দেখা গিয়েছিল; পুরুষ-নারীর দুই, পূর্ব-পশ্চিম-এর দুই; সাদা-কালো-র দুই। মার্ক্সবাদ-ও (মার্ক্স নয় কিন্তু; অন্তত সব সময় তো নয়ই) অনেক সময়ই এই ছকের শরিক হয়ে পড়েছিল। আরও একটা ছকেরও অধীন হয়ে পড়েছিল মার্ক্সবাদ- সিঁড়ির ধাপের মতো করে পথচলার ছক, সিঁড়ির ধাপের মতো ইতিহাসভাবনার ছক- যেখানে ধাপের নীচের দিকে আছে কৃষিনির্ভর সামন্ততন্ত্র এবং ধাপের ওপরে দিকে আছে শিল্পনির্ভর পুঁজিবাদ।..”
অর্থাৎ তাহলে আজকের পুঁজিবাদী যন্ত্র সভ্যতায় আমরা কীভাবে সবটুকু গ্রহণ করব আবার আমাদের অপ্রয়োজনে বর্জন করব। এদিকে পুঁজিবাদের আগ্রাসন, দ্রুতগতিতে সভ্যতার সাথে মানসিক – শারীরিক এবং অর্থনৈতিক ও ভৌগলিক পরিবর্তন। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমাকে ফসলের জন্য ভাবতে হয় না। প্রচণ্ড গরমেও আমরা সবটুকু গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছি নির্দ্ধিধায়। এবং এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আমাদের বর্তমান রাজনীতি দ্বারা সম্ভবপর হয়েছে। একটি সম্পদ যেমন পরিবর্তন হয়েছে সম্পদহীন হয়ে আবার অনেক সম্পদহীন হয়েছে প্রকৃত সম্পদের অধিকারী। তাহলে এরই ভিত্তিতেই কি রবীন্দ্রনাথ সমবায় এর ভবিষ্যত দেখেছিলেন? নাকি তিনিও কোনো বিকল্প অনুসন্ধান করেছেন। তাঁর রাশিয়ার চিঠি তে..
” ….সাইবীরিয়ার একজন চাষী স্ত্রীলোক বললে, “সমবেত খেতের কাজে আমি প্রায় দশ বছর আছি।… একত্রিক কৃষিক্ষেত্রের সঙ্গে নারী-উন্নতি-প্রচেষ্টার ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। আজ দশ বছরের মধ্যে এখানে চাষী-মেয়েদের বদল হয়েছে যথেষ্ট। নিজের উপর তাদের অনেক বেশি ভরসা হয়েছে। যে-সব মেয়ে পিছিয়ে আছে, ঐকত্রিক চাষের যারা প্রধান বাধা, এরাই তাদের মন গড়ে তুলেছে। আমরা মেয়ে-ঐকত্রিকের (তথা মেয়ে-ঐকত্রিকতার) দল তৈরি করেছি; তারা ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে ঘুরে বেড়ায়; মেয়েদের মধ্যে কাজ করে, চিত্তের এবং অর্থের উন্নতিসাধনে ঐকত্রিকতার সুযোগ কত তা ওদের বুঝিয়ে দেয়। ঐকত্রিক দলের চাষী-মেয়েদের জীবনযাত্রা সহজ করে দেবার জন্যে প্রত্যেক ঐকত্রিক ক্ষেত্রে একটি করে শিশুপালনাবাস, শিশুবিদ্যালয়, আর সাধারণ-পাকশালা স্থাপিত হয়েছে।”
সুখোজ প্রদেশে জাইর্গান্ট্ নামক একটি সুবিখ্যাত সরকারী কৃষিক্ষেত্র আছে। সেখানকার একজন চাষী… বললে, “আমাদের এই খেতে জমির পরিমাণ এক লক্ষ হেক্টার (hectares)। গত বছরে সেখানে তিন হাজার চাষী কাজ করত। … জমিতে বিজ্ঞানসম্মত সার দেবার এবং কলের লাঙল ব্যবহার করবার ব্যবস্থা হয়েছে। এইরকম লাঙল এখন আমাদের তিনশো’র বেশি আছে। প্রতিদিন আমাদের আট ঘণ্টা কাজ করবার মেয়াদ। যারা তার বেশি কাজ করে তারা উপরি পারিশ্রমিক পায়। শীতের সময় খেতের কাজের পরিমাণ কমে; তখন চাষীরা বাড়ি- তৈরি রাস্তা-মেরামত প্রভৃতি নানা কাজে শহরে চলে যায়। এই অনুপস্থিতির সময়েও তারা বেতনের এক-তৃতীয়াংশ পেয়ে থাকে আর তাদের পরিবারের লোক তাদের নির্দিষ্ট ঘরে বাস করতে পায়। “–(রাশিয়ার চিঠি)
এই যে একটি সুনির্দিষ্ট সমবায় পন্থা। একটু নির্দিষ্ট সময়। নির্দিষ্ট শ্রম। নির্দিষ্ট উদ্বৃত্ত। নির্দিষ্ট পারিশ্রমিক – এই পদ্ধতি আজকের সময় কোথায় ? সারা বইটিতে লেখকদ্বয় তাঁদের মতো করে বিশেষ বিশেষ কিছু প্রশ্ন বা কিছু দিক তুলে ধরতে চেয়েছেন পাঠকের কাছে। আমরা সাধারণ মানুষ। সাধারণ জীবন যাপন। সাধারণ চিন্তা। কিন্তু এর বাইরেও আছে একটা সমাজ, একটা রাষ্ট্র,একটা দেশ, একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা — আমরা কতটুকু গ্রহণ করছি বা বর্জন করছি।
সর্বশেষ বলি,অসাধারণ একটি বই যা এতো অল্প বিস্তরে আলোচনা সম্ভব নয়। তবুও বেশ কিছু বিষযের দিক থেকে আজকের এই আলোচনা,কিছু কথা ও পরবর্তী ধারণার কথা বলতে পারলাম। যা পাঠকের কাছে পৌঁছতে অনেকটা সহযোগিতা করবে। এমনকি এই বইয়ের একেবারে শেষ পাতার শেষ কথা, কী চমৎকার ভাবে দুই লেখক বলেছেন। আসলে দীর্ঘ কাল ধরে এই সমাজ ব্যবস্থার যে দিক, যে অভিমুখ তা কিন্তু কোনভাবেই একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে ব্যাখ্যা বা আলোচনা করা যাবে না, তারজন্য বিকল্প নীতি বা বিকল্প আলোচনা হয়তো বার বার দরকার হয়েই পরবে। তাই এই বইয়ের আয়োজনে বিরাট শ্রম ও বিষয় যে বিরাট একটা পদ্ধতি হতেই পারে মাত্র তাতেই বা ক্ষতি কি? ‘ শেষের কথা ‘ য় তাই তারা বলছেন —
“.. অবশ্যই খুব গুছিয়ে, খুব সাজিয়ে মার্ক্স-রবীন্দ্রনাথ কথোপকথন এবং আমাদের ভাবনা কোনোটাই রাখা গেল না। কথাটার উপরই জোর পড়ল বেশি। কথাটার পরিবেশনটার উপর জোর পড়ল কম। আর তাতেও ভরসা রবীন্দ্রনাথ। বিলিতি গান নিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটা লেখা হাতে এল। সেই লেখাটারই একটা অংশ তুলে আনলাম- — “আমাদের দেশে বড় বড় ওস্তাদ গায়কেরাও গান গাহিবার প্রয়াসটাকে ঢাকিতে পারে না- যে-সকল খাদসুর বা চড়াসুর সহজে তাহাদের গলায় আসে না, যেমন-তেমন করিয়া সেটাকে প্রকাশ করিতে তাহাদের কোনো লজ্জা নাই। কারণ, আমাদের দেশে শ্রোতাদের মধ্যে যাঁহারা রসজ্ঞ তাঁহারা নিজের মনের মধ্যে নিজের বোধশক্তির জোরেই গানটাকে খাড়া করিয়া তুলিয়া খুশি হইয়া থাকেন। এই কারণে তাঁহারা সুকণ্ঠ গায়কের সুললিত ভঙ্গিকে অবজ্ঞা করিয়া থাকেন; বাহিরের কর্কশতা এবং কিয়ৎ পরিমাণে অসম্পূর্ণতাতেই আসল জিনিসটার যথার্থ স্বরূপটা যেন বিনা আবরণে প্রকাশ পায়। এ যেন মহেশ্বরের বাহ্য দারিদ্র্যের মতো- তাহাতে তাঁহার ঐশ্বর্য নগ্ন হইয়া দেখা দেয়। য়ুরোপে এ ভাবটা একেবারেই নাই। সেখানে বাহিরের আয়োজন একেবারে নিখুঁত হওয়া চাই। সেখানে অনুষ্ঠানে ত্রুটি হইলে মানুষের কাছে মুখ দেখাইবার জো থাকে না। আমরা আসরে বসিয়া আধঘণ্টা ধরিয়া তানপুরার কান মলিতে ও তবলাটাকে ঠকাঠক্ শব্দে হাতুড়িপেটা করিতে কিছুই মনে করি না। কিন্তু য়ুরোপে এই সকল উদ্যোগকে নেপথ্যে লুকাইয়া রাখা হয়। সেখানে বাহিরে যাহা কিছু প্রকাশিত হয় তাহা একেবারেই সম্পূর্ণ। এইজন্য সেখানে গায়কের কণ্ঠস্বরে লেশমাত্র দুর্বলতা থাকিলে চলে না। আমাদের দেশে গান সাধাটাই মুখ্য। সেই গানেই আমাদের যতকিছু দুরূহতা; য়ুরোপে গলা সাধাটাই মুখ্য, সেই গলার স্বরে তাহারা অসাধ্য সাধন করে। আমাদের দেশে যাহারা প্রকৃত শ্রোতা তাহারা গানটাকে শুনিলেই সন্তুষ্ট থাকে, য়ুরোপের শ্রোতারা গান গাওয়াটাকে শোনে।”–গান সাধা ও গলা সাধা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনাটাকে সম্বল করেই এই লেখাটা ছাপতে উদ্যোগী হলাম। বাহ্য দারিদ্র সত্ত্বেও। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনাটাকে অবলম্বন করে এই লেখাটা ছাপার সাহস দেখালাম।
এই লেখায় গান সাধাটাই মুখ্য। গান সাধার খণ্ড মুহূর্তগুলোতে কোথাও কোথাও নিতান্ত অলক্ষ্যে হয়তো তানপুরার টুং টাং আর তবলার ঠুক ঠাক রয়ে গেল। আশা করব পাঠক-পাঠিকা গানটাকে বেশি গুরুত্ব দেবেন; গান গাওয়াটাকে নয়।
কথপোকথননে মার্ক্স ও রবীন্দ্রনাথ (উন্নয়ন ও বিকল্প) – অঞ্জন চক্রবর্তী ও অনুপ ধর / গাঙচিল/ মূল্য ৪০০.০০



Be First to Comment