Press "Enter" to skip to content

পুলিশ যখন চক্ষুশূল, অশনি সংকেত শাসকের

জয়ন্ত মণ্ডল

পুলিশের জন্য এক দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি। সময় বলবে, আর কত ধৈর্যের পরীক্ষা দেবে পুলিশ। উর্দি নিয়ে বরাবরই থাকে, এখন পুলিশের ঘরের মেয়েকে টেনে বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দিচ্ছে তাদেরই সামনে দাঁড়িয়ে। পড়ুয়াদের বিক্ষোভে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘেরাও হচ্ছে পুলিশ। রক্তে ভেজা পুলিশকর্মীর ছবি পোস্ট করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আবেগঘন বার্তা দিচ্ছে পুলিশ। পরিস্থিতি এমনই যে পুলিশকে প্রকাশ্যে বলতে হচ্ছে, ‘আমরাও এই সমাজের একজন, আমরাও মানুষ’। তা হলে কি পুলিশ বদলে যাবে? বলা কঠিন। তবে অতীত বলছে, এ ধরনের পরিস্থিতি শাসকের কপালে ভাঁজ চওড়া করার জন্য যথেষ্ট।

আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, অপরাধের তদন্ত, ইত্যাদি পুলিশের সাধারণ কাজ হলেও ঘুরেফিরে শাসকের নিরাপত্তা তাদের হাতেই। সেই জন্যই তো যুগ যুগ ধরে সেনা বরাবর শাসক-বিশ্বস্ত। রাজা-মহারাজাদের ইতিহাস পেরিয়ে এখন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত শাসকের মতো করেই চলতে হয় পুলিশকে। সেই চলার পথেরও একটা দূরত্বও থাকে। যা নির্ধারণ করে জনগণ।

শাসক বদলায়, পুলিশ নিশানায়

আর পাঁচটা সরকারি দফতরে চাকরির থেকে অনেকটাই আলাদা পুলিশের প্রকৃতি। পুলিশ সরাসরি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে বলে শুধু নয়, পুলিশকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনার প্রতিফলনও একটা বড় ফ্যাক্টর। গড়পড়তা সাধারণ মানুষ মাত্রই পুলিশের শৃঙ্খলাজনিত গাফিলতি অথবা দুর্নীতিকে অন্য সরকারি কর্মীদের তুলনায় অনেক বেশি ঘৃণ্য বলে মনে করে। যে কারণে পুলিশকে এই দিকটা থেকে অনেক বেশি পেশাদার পদ্ধতিতে কাজ করতে হয়। কিন্তু শাসকের চাপ বা ব্যক্তিগত প্রলোভনে সেই পেশাদারিত্ব অন্য পথে মোড় নেওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। পুলিশের জন্য নির্দিষ্ট নিয়মকানুন আছে। সেসব জানে পুলিশ-প্রশাসন। সাধারণ মানুষ সেসব নিয়ে ততটা মাথা ঘামায় না। পুলিশের বাহ্যিক বিচ্যুতিই সাধারণের আলোচ্য বিষয়। যেটা খুব সহজেই প্রভাবিত করে সাধারণ মানুষকে। কারণ, সাধারণের রক্ষক যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর রক্ষাকর্তা হয়ে ওঠে, তখন জনগণের রোষে পড়তেই হয় পুলিশকে।

কয়েক দশক আগে পুলিশের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠেছিল, ‘পুলিশ তুমি যতই মারো, মাইনে তোমার একশো বারো’। এখন উঠছে, ‘পুলিশ তুমি চিন্তা করো, তোমার মেয়েও হচ্ছে বড়’। এ সব ক্ষেত্রে শাসকের ‘রক্ষাকবচ’ ছাড়া পুলিশকে আর অন্য কিছু ভাবতে চায় না বৃহত্তর অংশের মানুষ। একাংশের অভিযোগ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যায় সঠিকভাবে তদন্ত করা এবং দোষীদের শাস্তি দেওয়া যখন পুলিশের কাজ হওয়া উচিত, সেখানে তারা পরিস্থিতি এড়িয়ে যায় এবং ক্ষমতাশালীদের পক্ষে কাজ করে। এটা খুবই হতাশাজনক। সাধারণ মানুষ অভিযোগ নিয়ে যায় পুলিশের কাছে। কিন্তু, পুলিশের বিরুদ্ধে সাধারণের অভিযোগ বরাবরের। কার কাছে যাবে? জায়গা থাকলেও সেখানে পৌঁছনোর পথ দুর্গম। যে কারণে জনমনে ক্ষোভ জমে। যা জমতে জমতে বিক্ষোভ। শাসকের বিরুদ্ধে সেই বিক্ষোভকে মুঠোয় পুরতে চায় বিরোধীরা। শাসক-বিরোধী অবস্থান বদল হলেও যে-কে-সেই। নতুন শাসক নতুনত্ব আনার তাগিদ দেখায়।পুলিশের উদ্দেশে গালমন্দ কমে যায়। পুলিশকর্তা পাড়ার পুজো-জলসায় অংশ নেন। সাধারণের সঙ্গে পুলিশ গাছ লাগায়, রক্তদান শিবির করে, কৃতী পরীক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দেয়, ফুটবল খেলে, আটকে পড়া পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছে দিয়ে বাহবা কুড়য়। আইনের রক্ষক পুলিশ হয়ে যায় সামাজিক পুলিশ, মানবিক পুলিশ। শাসক নিজের ‘ধর্মে’ ফিরে এলে পুলিশেরও ভোল বদলায়। মানুষ এটাই দেখে আসছে শেষ কয়েক দশকে।

আরজি কর, উঠল ঝড়

আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সাম্প্রতিক ঘটনার পর, পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসে ব্যাপক ভাটা পড়েছে। এই কাণ্ডের ফলে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর উদ্বেগ এবং অসন্তোষ সর্বত্র। বিশেষ করে পুলিশের কথা-কাজ এবং শাসক দলের প্রতি তাদের আনুগত্য নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। অধিকাংশের মতে, পুলিশ জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করার পরিবর্তে শাসক দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করছে, যার ফলে রাজ্যের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। তা না হলে পুলিশকে নিশানা করে আন্দোলন কেন এতটা তীব্র? রক্তাক্ত, অসহায় পুলিশের ছবি বারবার কেন ভেসে উঠবে!

নতুন করে বলার নয়, সাধারণ মানুষের এই ক্ষোভের কারণ পুলিশের প্রতি আস্থার অভাব। অনেকেই মনে করছেন, আইনশৃঙ্খলার রক্ষাকর্তা হিসেবে পুলিশের দায়িত্ব পালন নিয়ে প্রশ্ন ওঠা কাঙ্ক্ষিত নয়। কিন্তু যখন তারা নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়, তখন সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যায়। পুলিশের নিরপেক্ষতা এবং দায়িত্ব পালনে সঠিক ভাবে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা এখন সময়ের দাবি। যদি এই ধরনের ঘটনা বারবার ঘটে, তবে পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা এবং বিশ্বাস আর কতটা অবশিষ্ট থাকবে, সেটাই বড় প্রশ্ন। যে প্রশ্নের উত্তর মেলানো তখন সহায়-সম্বলহীন শাসকের পক্ষেও অসাধ্য!

আরও পড়ুন: ভুলের গোলক ধাঁধা! কিছুতেই যেন বাইরে বেরোতে পারছে না ‘অমিতবিক্রম’ শাসক

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *