উত্তর কলকাতার বড়বাজারে রঙের আনন্দ। ছবি: রাজীব বসু
তাপস রায়
কুড়ি টাকা থেকে দু’শ টাকা দরে পূর্বপল্লীর পাশের লাল মোরাম পথ জুড়ে পলাশফুলের মালা কেনার তুমুল উত্তেজনা। কাঁচাঘুম ভেঙে উঠে আসার যে বিরক্তি তা অল্পক্ষণ স্থায়ী হয়ে মিলিয়ে গিয়েছে। মেয়েদের চুলের বিনুনি, খোঁপা, হলুদ শাড়ি, মাটির গয়না আর ঠোঁটের রক্তাভায় বসন্ত হুড়মুড় করে চলে এসেছে এখানে। ছেলেরাও জান-প্রাণ দিয়ে পাঞ্জাবী আর পাজামা বা ধুতির সাদায় চরাচর শুভ্রতায় ভরিয়ে দিতে চেয়েছে। মানে একটু বাদের রাঙিয়ে দেবার ক্যানভাস তৈরি করে ফেলেছে।
আমার আস্তানা শান্তিনিকেতন ট্যুরিস্ট লজে। সেখান থেকে হেঁটে গেলেই হত। মেরে-কেটে দেড় কিলোমিটার পথ। কিন্তু রিক্সায় উঠেছি ভোরের সৌন্দর্য উপভোগ করব বলে। দেখতে দেখতে যাব ছাতিমতলা, উপাসনাগৃহ, প্রকৃতিভবন। রাস্তার ভিঁড়-ভাট্টার চিন্তা রিক্সাওয়ালার মাথায় দিয়ে আমি ফুরফুরে থাকতে চাই। আজ শুধু বসন্তের উচ্ছ্বাসে ডুবে থাকব।
প্রভাত সরণী দিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি হত। কিন্তু আমি চাইছিলাম পথ দীর্ঘতর হোক, অপেক্ষা গাঢ়তর হোক। যেতে যেতে বনস্থলীর দিকে চেয়ে থাকব। আমের বোলের উপরে যে পাতলা সবুজ ছুঁয়ে আছে, যেন টের পেতে পারি সেই সবুজ আমাকেও ছুঁয়ে আছে। পাহাড়ি ঝর্ণার পাশে বসে যেভাবে অঞ্জলি ভরে তৃষাতুর তৃষ্ণা মেটায়, ঠিক সেরকম দশা হোক আমার। চৈত্র হাওয়া সকাল সকাল আমার পাঞ্জাবীকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আমাকেও খানিকটা উড়িয়ে নিতে চাইছে যেন।
রিক্সাওয়ালা দীনু সর্দার দু’দিন ধরে আমাকে দেখছে। ওর রিক্শাতেই গত দু’দিন শান্তিনিকেতনে এদিক-ওদিক ঘুরছি। সে বলল, “ দাদা, আজ একদম ঝাক্কাস লাগছে আপনাকে।”
“ হ্যাঁ, সত্যি বলছ ভাই?” নিজের পাঞ্জাবীটা একটু টানাটানি করি। চুলে আলতো হাত চালাই। পাঞ্জাবীর হাতা দুটোর ভাঁজ সমান হয়েছে কিনা ফের চেক করি। গড়িয়াহাটের নামী দোকানের পাঞ্জাবী, জানি বেশ ভালোই হয়েছে।
দীনু সর্দার প্যাডেলের চাপ হালকা রেখেছে। বেশি জোরে ছুটলে তো রাস্তা ফুরিয়ে যাবে তাড়াতাড়ি। তখন সওয়ারি ভাববে এত কাছে, আর কত বেশি টাকা নিল! সে সওয়ারির সাথে ভাব করে নিয়ে তার মনের ভেতর ঢুকে পড়তে চায়। দীনু সর্দার বলে, “ দাদা, সঙ্গে আবির লিয়্যাছেন তো?”
আমি বললাম, “ না। আমি আবির কিনব কেন? আবির কাকে মাখাব! আমার তো পরিচিত কেউ নেই।”
“ সে কি দাদা ! হেথায় ওসব লাগে না। হোলির মাঠে সব্বাই আপন, লিজের। ইখ্যানটোতে এমন আলতো করে কপালে মুখে রং লাগায়, যে মনে হব্যে সব্বাই সাত জন্মের লিজের লোক গো।”
আমি মনে মনে শিহরিত হলাম। তাহলে এই যে এত সুন্দরী মেয়েরা চলেছে দোল উৎসবের মাঠের দিকে, এদের কেউ না কেউ আমাকেও আবির মাখাতে পারে! আর যদি মাখায়, তখন আমারও তো একটুকু রং দিয়ে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করবে নাকি! বললাম, “ না তো, আবির তো নেয়া হয়নি। তাহলে উপায়?”
“ আরে ঘাবড়ান ক্যান! মুই আছি না। মুই দীনু সর্দার। সেই হাফপ্যান্ট থিকা রিক্সা চাল্যাই হেথা। মুই সব জানি কুন মটকায় রং নিয়ে বস্যে দুকানী। সিখানে রিক্সা লাগিং দুবো।”
দূর থেকে যেন গান কানে ভেসে আসছে। আমি বললাম, “ এ মা, দোল যে শুরু হয়ে গেল!”
দীনু পেছনে ফিরে আমার বিষণ্ণ মুখের উপর চোখ ফেলে বলল, “ ধ্যুর, আশ্রমের ছেল্যেরা সব্যে প্রথম গানটি ধইরল। হেথাকার পড়ুয়ারা এই গানে লিজেরাও গলা মিল্যাবে। কত শত্তবার যে গেয়ে গেয়ে মাঠের ভেতর ঢুইকবে, তার ইয়ত্তা নাই!”
বলতে বলতে ও রিক্সা থামিয়ে দেয়। আর নাকি রিক্সা ঢুকবে না। কিন্তু দীনু আমাকে ছাড়ে না। সে বলে,
২
“ দাদা, এঁটকে দিছ্যে। হেথা দাঁড়ান, মুই রিক্সাটাকে ওই সরানে তালা দিয়ে ফেল্যা তুমার সাথে আইসছি।।”
“ না না আমার সঙ্গে আসতে হবে না। আমি একা একা ঠিক পৌঁছে যাব। তুমি বরং অন্য সওয়ারি দেখ গে যাও।”
সে একটু থমকাল। আমি ওয়ালেট থেকে টাকা বের করছিলাম। ওর মুখের দিকে তাকাইনি। সে মিনমিন করে বলল, “ আসলে দাদা, তুমার সাথে গেলে মুই টুকুস দেখতুম ক্যামন সাজিং দিছে সব।”
আমি ঝট করে ওর দিকে তাকালাম। শুধু ওর স্বরে নয় ওর মুখের রেখাতেও বেদনা ভাঙচুর হচ্ছিল। দীনু মাথা নিচু করে বলল, “ কত্ত কত্ত দেশ থিকা মানুষ আসে,রং খেলে, আনন্দ নেয়। মুই দেখি বিটিছেল্যারা ব্যাটাছেল্যাদের ক্যামন রং লাগাইছে। কেমন ঝমঝম করে লিজের বুকের ভিতর থিক্যে বসন্ত বের কইরছে। হাওয়ায় সেসব উড়ান দিচ্ছে। ইচ্ছা লাগে। পেছু পেছু যাই । আর ঘুরান আসি। মনরে সামলাই। কই, থুঙ দে। ইসব তুকে মানায় না। ইসব ঋতু তুদের জন্য লয়। গ্রীষ্ম তুদের। তুরা রোদে পুইড়বি। বর্ষা তুদের। তুরা জলে ভিইজবি …।”
আমি টাকা দিয়ে ওকে বিদেয় করব ভাবছিলাম। ঘুরে ঘুরে সব দেখব। ছেলে মেয়েদের সাজ দেখব, না্চ দেখব। আবির ওড়ানো দেখব। বিশ্বভারতীর ছেলে-মেয়েরা দারুণ রবীন্দ্রগানে নাচে,দেখব। একা একা বলে কিছু নেই। এই ভিড়ের ভেতর ভিড় হয়ে ঠিক এনজয় করে নেব।
দীনু সর্দারের কথায় আমাকে থমকাতে হয়। ভাবছিলাম আমি একমাত্র, যার রং খেলার কেউ নেই, অথচ রঙের উৎসবে এসেছি। কিন্তু দেখলাম, এই ছেলেটিও যে সেরকম বলছে। তবে ওর ভেতর যেন না-থাকা নিয়ে তেমন হাহাকার নেই। একটা দার্শনিক শূন্যতাই ভর করেছে। জগতে আনন্দ যজ্ঞে ওর নেমন্তন্ন নেই, ও জানে। কিন্তু চায় সেখানে জড়িয়ে পড়তে।
খোলের উপরে চাটির শব্দ আলাদা হয়ে ঊঠছে। সম্মিলিত কণ্ঠের গান ‘ স্থলে, জলে বনতলে লাগল যে দোল’ কানে আসছে বটে, কিন্তু অত কণ্ঠের মাধুর্যকে ছাপিয়ে ওই ঠিন্ ঠিন্ ঠিন্ ঠিন্ মিঠে শ্রীখোলের শব্দ আলাদা হয়ে কানে আসছে। একটু আগের রিক্সাচালক দীনুর কথাও যেমন আলাদা করে হোলির উচ্ছ্বসিত আবহ ছাপিয়ে উঁচু হয়ে এসেছে।
“ তোমার বাড়িতে আর কে কে আছে?” আমি শহুরে ভদ্রতায় ওই সরল সাধারণ ছেলেটিকে একটু একাত্ম দেখাতে চাইলাম। কত আর বয়স হবে তার, বছর ত্রিশের বেশি নয়। আমার যদি চল্লিশের আশে-পাশে হয় তো ওর তাই হবে। মনে হয় মা-বাবাকে দেখার চাপে হয়ত বিয়ে-টিয়ে করতে পারেনি। আমার যেমন।
“ বাড়িতে আমার বউ আর দুটো গেঁড়ে গেঁড়ে ব্যাটা আছে।”
ভাবনার সাথে মিলল না বলে নিজের মনেই অসহিষ্ণু। বললাম, “ বিয়ে করেছ, তা বউ ছেলে-পিলে নিয়ে এখানে এলেই তো পারো!”
“ কী যে বল্যেন দাদা! গরীবের ঘোড়া রোগ! মোর বউ রোজ পাঁচশ বিড়ি না বাঁইধলে মোদের দু’বেলা হাঁড়ি চড়তে লাড়বে। ভাড়া করা রিক্সা চালাই। মালিককে রোজ শত ট্যাঁকা দেবার পর কত্ত আর থাইকবে যে দুটো ব্যাটাকে লিয়ে সংসার চইলবে! বঊ পাঁচশ বিড়ি বেঁধে রোজ পঞ্চাশ ট্যাঁকা ঘরে আনে। দুটো ব্যাটাকে দিনভর সামলায়। মোদের কি রঙে ভাইসলে চল্যে!”
“ চলো চলো আমার সাথে আজ চলো। তুমি থাকলে আমার সুবিধা হবে। বলতে পারবে এই পাইন গাছটা রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন। এই আমগাছে তাঁর বৌঠানের দোলনা দুলত। তুমি আমাকে বলে দিতে পারবে রবীন্দ্রনাথ ঘুম থেকে ভোরবেলায় উঠে রামকিঙ্করের বানানো কোন সাঁওতাল মেয়েকে দেখে বলেছিলেন, কিচ্ছু হয়নি। তুমি থাকলে আমার সুবিধা, চলো চলো।”
৩
দীনু সর্দার খুব খুশি হয়। সে রিক্সায় তালা লাগিয়ে প্যান্টের নীচের দিকের গোটানো অংশ খুলে দিয়ে জামা-প্যান্ট হাত দিয়ে ঝেড়ে নিয়ে একটু বাবু হয়। তারপর বিড়ি ধরাতে গিয়ে মনে পড়ে কলকাতার দাদাবাবু, পছন্দ নাও করতে পারে। সে বিড়ি আবার বুক পকেটে চালান করে দিয়ে মনের সুখকে জানান দিতে গান ধরে ফেলে।
রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আমি পুরোটা দেখছিলাম। বেশ বড় গলায় ধরেছিল গান। ফলে কানে এসেছে।
সে গাইছে,
“ পাঁচভেয়্যাদের একান ভারী
তার উধারে বংশীধারী,
বংশীধারীর আছে হনু
তার উধারে বাবুর তনু। ”
চলতে চলতে রঙের দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে দীনু। আমার ভেতর থেকে সেই কেনার ইচ্ছেটা ফুরিয়ে গেছে। ভেতরে ভেতরে কেমন যেন সাদা-কালো বোধ খেলা করছে। চোখের উপর দিয়ে রঙীন মেয়েরা হেঁটে কলকল করতে করতে চলেছে, কিন্তু যেন ছুঁচ্ছে না। কেবল মনে হচ্ছে এই বসন্তেও দীনুর বউকে তো বাড়ির উঠোনে বসে বিড়ি বাঁধতে হচ্ছে। উঠোনের মাটিতে খালি গায়ে, সর্দি ঝরা নাকের দুই ছেলেকে মুড়ির বাটি দিয়ে বসিয়ে রেখে সে নিজের কোমরের ব্যথা ভোলার জন্য দুলে দুলে বিড়ি বাঁধছে। তার স্থির জীবনের ভেতর ওইটুকু দুলুনি নিজের জন্য নিতে পেরেছে। তার সামনে কোনোদিন রঙের এই আশ্চর্য উৎসব এসে দাঁড়াবে না।
রাস্তার উপর খবরের কাগজ বিছিয়ে নানা রং ভর্তি প্লাস্টিকের প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে। কিনতে গিয়েও মনে পড়ল সারা বিশ্ব করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে কাঁপছে। আর ভারতবর্ষের বাজার পুরোটাই তো চিনের দখলে। এই রং চিনের দেশ থেকে আসেনি তো!
দোকানি জানাল, শান্তিনিকেতনে কখনই কোন খারাপ রং বিক্রি হয় না। এখানে শুধু আবির। আর তার আবির ভেষজ। মানে ফুল থেকে তৈরি হয়েছে। এই হলুদ আবির গাঁদা ফুল থেকে।
আমি বললাম, “ তবে ভাই আমাকে দু’প্যাকেট দাও।”
একটা প্যাকেট ছিঁড়ে আবির নিয়ে খুব যত্ন করে দীনুর দুই গালে মাখিয়ে দিলাম। দীনু বোকার মতো কাঁদতে লাগল। বললাম, “ চলো উৎসবের মাঠের দিকে যাই, কত লোক এসে গেছে। আমাদের অনেক পেছনে দাঁড়াতে হবে। কিছুই দেখতে পাব না।”
দীনু কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ সেই কোন ছোটবেলা থেকে রিক্সা চালাই। হেথায় রবি ঠাকুরের আপন দেশে কত্ত মানুষ আসে, উৎসব হয়। উৎসব হলেই আনন্দ। আনন্দ হয় ভাড়া বেশি খাইটতে পা্রি। বেশি পয়সা হয়। আর কিছু লাই। কত্তবার দেখ্যাছি ইখ্যানটো থিকে সোন্দর সোন্দর বিটিছেল্যারা রং মেখ্যে ফিরছে। ওই সরানে কুনো ছেল্যেকে দেখে দাঁড়াইন গিছে। তার গালে রং ঘঁষে ঘঁষে দিছে। মোরও মনে হইছে যদি কেউ কুনুদিন মুকেও রং লাগায়! কিন্তু সেসব তো স্বপন। কয়েক পলক দেখেই প্যাডেলে পায়ের চাপ লাগাই আর সিখান থিক্যা সটকে পড়ি। দাদা, আজ তুমি মোর ওই স্বপন সত্যি করে দিলেন গো!”
ওর কান্না থামাতে এ ছাড়া আর আমার কিছুই করার ছিল না। আর আমি ভাবছিলাম, এখানে কে এমন চেনা লোক বেরিয়ে পড়বে যে সে এসে আমাকে রং দেবে! তারচে হাতের লক্ষ্মী পায়ে ফেলে লাভ কী। দীনুই লাগাক আমার মুখে আবির। যে কোনো একজন লাগালেই হল। রং যেন মোর মর্মে লাগে …।
আমি ছেঁড়া প্যাকেটটা ওর দিকে বাড়িয়ে বললাম, “ নাও, এখান থেকে আবির নিয়ে আমার মুখে লাগাও। আর হ্যাঁ এই আস্ত প্যাকেটটা তোমার প্যান্টের পকেটে রাখো। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে তোমার বউকে মাখিয়ে দিও। ”
দীনু সর্দার শিশুর মতো আমার চোখে তাকিয়ে তার জীবনের বসন্ত যেন খুঁজে পেল। তার চোখে আমিও দেখে ফেলি রঙের ছড়াছড়ি। সে আমার গালে হলুদ আবির মাখিয়ে দেয়। আমিও ওর মাথার চুল হলুদ করে দিই।
৪
দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে হচ্ছিল এসব। আমি সব রঙের আবিরের প্যাকেট কিনি। দীনুকে বলি, “ তুমি আমার সাদা পাঞ্জাবী সব আবিরের রঙে রাঙিয়ে দাও।”
বলতে বলতে আমি নিজে দীনুর সারা মুখে গায়ে মাথায় নানা রঙের আবির লাগাতে থাকি। হোলি খেলার মাঠের কাছেই চলে এসেছিলাম আমরা। গান হচ্ছিল। বিশ্বভারতীর মেয়েরা গাইছে,“ ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল।”
Be First to Comment