Press "Enter" to skip to content

মুখ্যমন্ত্রীর কথায় “ম্যানমেড” বন্যা, সত্যিই কি তাই?

অমল মাজি এগজিকিউটিভ এডিটর, অনলাইন কোলফিল্ড টাইমস

প্রতিবছর বর্ষাকালে বন্যা পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের জন্য এক আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে, সাম্প্রতিককালে যেভাবে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক যথেষ্ট জোরাল। এই ধরনের বন্যার জন্য বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি দোষারোপ করেছেন দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (ডিভিসি)-কে। তিনি এটাকে “ম্যানমেড” অর্থাৎ মানুষের তৈরি বন্যা বলে দাবি করেছেন। তবে প্রশ্ন ওঠে, এই বিপর্যয় কি শুধুই ডিভিসির দায়, না কি এর পেছনে মানুষের তৈরি অন্যান্য কারণও রয়েছে?

১. প্রাকৃতিক এবং ম্যানমেড বন্যার তফাৎ

প্রাকৃতিক কারণে বন্যা হওয়া একেবারেই নতুন ঘটনা নয়। বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং নদীর জলের স্তর বৃদ্ধি পাওয়াই প্রধান কারণ। কিন্তু বর্তমানে আমরা যেসব বন্যা দেখতে পাচ্ছি, তার অনেকাংশই “ম্যানমেড”, বা মানুষের তৈরি বলে দাবি করা হয়। বিশেষ করে ডিভিসির অতিরিক্ত জল ছাড়ার কারণে যখন বন্যা সৃষ্টি হয়, তখন এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। তবে শুধুমাত্র ডিভিসির ওপর দোষ চাপানো যথাযথ নয়। বন্যার মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে মানবসৃষ্ট কার্যক্রলাপ, যা প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে নষ্ট করে দিয়েছে। একই সঙ্গে রয়েছে সদর্থক পরিকল্পনার অভাব।

২. জনবসতির অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি

হাওড়া, হুগলি, বীরভূম এবং পশ্চিম মেদিনীপুর-সহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি এক বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অঞ্চলে অনেক সময়েই ডিভিসি অতিরিক্ত জল ছাড়লেই বন্যার পরিস্থিতি তৈরি করছে। যদি এই সমস্যা সমাধানে ডিভিসি এবং রাজ্য সরকার এলাকাগুলিতে যথাযথ পরিকল্পনা করে এগোয়, প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তবে হয়তো এই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না।

৩. খাল, বিল এবং জলাশয় বন্ধ হয়ে যাওয়া

একটি প্রধান সমস্যা যা বন্যার জন্য দায়ী, তা হল খাল, বিল, এবং প্রাকৃতিক জলাধারগুলির দখল হয়ে যাওয়া। বাংলার অনেক অঞ্চলে গ্রাম এবং শহর উভয় ক্ষেত্রেই এসব প্রাকৃতিক জলাধার বন্ধ করে বসতি গড়ে তোলা হয়েছে। বিশেষ করে নদীর কাছাকাছি এলাকার বাসিন্দারা বিভিন্নভাবে নদীর চর বা প্রাকৃতিক জলাধার দখল করে সেখানে অবৈধ নির্মাণ করছে। ফলে অতিরিক্ত বৃষ্টির জল নদীতে প্রবাহিত হওয়ার পরিবর্তে স্থানীয় এলাকায় জমে যায় এবং বন্যা সৃষ্টি করে।

৪. নদী এবং চর দখল

নদীর চর দখল করে অবৈধ নির্মাণ একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলি যেখানে প্রাকৃতিকভাবে জল সঞ্চিত হতো এবং তারপরে ধীরে ধীরে নদীতে প্রবাহিত হতো, সেসব এলাকায় মানুষজন দখল করে বাড়িঘর তৈরি করেছে। এর ফলে বৃষ্টির জল নদীতে প্রবাহিত হওয়ার জায়গা পাচ্ছে না, বরং স্থানীয় এলাকায় জমা হয়ে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি করছে। চরের এই দখলদারিত্ব এবং প্রাকৃতিক জলাধার ধ্বংস করার ফলে সামান্য কারণেই প্লাবিত হওয়ার পরিস্থিতি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৫. জল নিষ্কাশনের সঠিক ব্যবস্থার অভাব

পশ্চিমবঙ্গে নদনদীর সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে এক টানা অতি ভারী বৃষ্টিতে বন্যা পরিস্থিতি নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু বর্তমানে সঠিক জল নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাব আরও বেশি করে সংকট ডেকে আনছে। বাংলা তথা ভারতের অনেক এলাকায় পুরনো নিকাশী ব্যবস্থা এখনও চালু রয়েছে। এই ব্যবস্থা বর্তমানে যথেষ্ট নয়। যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে জল নিষ্কাশনের বর্তমান ব্যবস্থা কাজ করতে পারছে না। খাল-বিল ভরাট এবং নিকাশী ব্যবস্থার অপ্রতুলতায় বর্ষাকালে অতিরিক্ত জল জমে যাওয়া এবং বন্যার মত পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।

৬. ডিভিসির ভূমিকা এবং দায়িত্ব

ডিভিসির ভূমিকা নিয়ে নানা ধরনের বিতর্ক রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অনেকেই মনে করেন, ডিভিসির অতিরিক্ত জল ছাড়ার কারণে এই ধরনের বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে ডিভিসি পাল্টা যুক্তি দিয়েছে যে, তারা বাধ্য হয়েই জল ছেড়েছে, কারণ বাঁধের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ছিল। জলাধারের ধারণক্ষমতা অতিক্রম করায় তারা এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছিল। এটি সত্য যে, যদি ডিভিসির সঠিক পরিকল্পনা থাকত এবং আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তবে হয়তো এই বিপর্যয় কিছুটা এড়ানো যেত। কিন্তু শুধু ডিভিসির ওপর দোষ চাপানো সঠিক সমাধান নয় বলেই মনে হয়।

৭. ভবিষ্যতে করণীয়

বন্যার প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করে যদি যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তবে আগামী দিনে বাংলায় আরও ভয়াবহ বন্যা দেখা দিতে পারে। প্রশাসনের উচিত অবিলম্বে জল নিষ্কাশনের আধুনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। প্রাকৃতিক জলাধার, খাল, বিল সংরক্ষণ এবং পুনরুদ্ধার করতে হবে। নদীর চর দখল বন্ধ করতে কড়া আইন প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। শহর এবং গ্রাম উভয় এলাকায় জনবসতি সম্প্রসারণের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার দিকে নজর দিতে হবে।

৮. প্রশাসনের দায়িত্ব এবং ভূমিকা

প্রশাসনের এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলা করা এবং এর স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করা। শুধু ডিভিসির ওপর দোষ চাপিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। স্থানীয় সরকার এবং প্রশাসনের উচিত প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করা এবং বেআইনি বসতি গড়ার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। পাশাপাশি, নগরায়ণ পরিকল্পনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে বৃষ্টির জল সুষ্ঠুভাবে নিষ্কাশন হতে পারে এবং ভবিষ্যতে বন্যার মতো বিপর্যয় এড়ানো যায়।

৯. ডিভিসি কী বলছে?

ডিভিসির এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার আঞ্জনিকুমার দুবে বলেন, “আমরা ডিভিআরআরসির নির্দেশ মতো জল ছাড়তে বাধ্য হই । নদীর বাঁধের জল ধারণ ক্ষমতার উপর নির্ভর করছে জল ছাড়ার পরিমাণ। এখন যেমন মাইথনে জল ধরে রাখার ক্ষমতা ৪৯৫ ফুট। সেই জায়গায় জলস্তর যদি চলে আসে ৪৯৪.২৪ ফুটে। তাহলে আমাদের কিছু করার থাকে না একইভাবে পাঞ্চেতের জল ধরে রাখার ক্ষমতা ৪২৫ ফুট। প্রচণ্ড বৃষ্টির জন্য জলস্তর হয়ে যায় ৪২৫.২৫ ফুট। আমাদের লক্ষ এই জলস্তরকে মাইথনে ৪৯১ এবং পাঞ্চেতে ৪২১ ফুটে নিয়ে আসা। না হলে বাঁধের ক্ষতি হবে”। তবে তিনি বলেন, বৃষ্টি থেমে গেলে, জল ছাড়ার পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব। ডিভিআরআরসির সদস্য সচিব শশী রাকেশ বলেন, “আমাদের কিছু করার নেই। বরাকর – দামোদর উপত্যকায় ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। তাই এই পরিমান জল ছাড়তে আমরা বাধ্য হয়েছি। নাহলে যদি বাঁধে ভয়ঙ্কর ক্ষতি হতে পারে”।

১০. তাহলে কি ম্যানমেড নয়?

সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতি এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের “ম্যানমেড” বন্যার অভিযোগ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে এই পরিস্থিতির জন্য শুধুমাত্র ডিভিসি দায়ী নয় বলে দাবি করেছেন কর্তৃপক্ষ। বাংলায় প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর যেভাবে চাপ পড়ছে, অবৈধ বসতি গড়ে উঠছে এবং জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা যেভাবে ব্যাহত হচ্ছে, তাতে বন্যা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। প্রশাসনের উচিত অবিলম্বে এই বিষয়ে নজর দেওয়া এবং মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *