Press "Enter" to skip to content

দশভূজাও কি রাত দখল দেখতে চান?

বাবুঘাটে প্রদীপ জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন জুনিয়র ডাক্তারদের। ছবি: রাজীব বসু

হাসি বসু

আকাশ বাতাস আনমনা আজ
শুনে এ কোন ধ্বনি 
চিরনতুন হয়েও অচিন
এ কার আগমনী…. 

শরত মানেই কাশফুল, শরত মানেই নীল আকাশে পেঁজা তুলো মেঘ, টুপটাপ ঝরে পড়া শিউলি ফুল আর মাতৃসম দেবী দুর্গার আগমন। বছর ঘুরে আবার সেই দিন এসেছে। 

জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দুর্গাপুজো সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে সারা দেশে। শারদ উৎসবের শুভলগ্নে আবেগ আর সম্প্রীতির গভীর মিলনমেলার প্রতীক্ষায় থাকে আপামর জনসাধারণ। এ যেন এক মহামিলন। মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রাণের আবেগ, মনের ভালবাসা, কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে থাকা সবটাই আমাদের ঘরের মেয়ে উমার জন্য। 

এ বার পুজোয় আনন্দ কতটা হবে, দুঃখই বা কতটা হবে তার পরিমাপ কীভাবে করব বলতে পারেন বন্ধুরা? এটা মাপার তো কোন একক (ইউনিট) হয় না। আসলে কী জানেন তো – পুরোটাই আমার মনের অভিব্যক্তি, প্রাণের আন্দোলন, স্নায়ুর যুদ্ধ, প্রতিটি শিরায়, ধমনিতে যে রক্ত বয়ে চলেছে তার আকুতি। সবাই একযোগে বলতে চাইছে প্রতিবাদ হোক। সমস্ত সত্তা বলছে প্রতিবাদ করো। রোজ চায়ের কাপে, ডালে ভাতে, ডেলিপ্যাসেঞ্জারিতে, তর্কে, আড্ডার আলোচনায় কখন যেন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত হয়ে যায়। একটা একটা করে দিন চলে যায়। পুজোর ছুটি আসে আনন্দ নিয়ে নয় বরং হতাশা নিয়ে। একটা কথা বার বার মনে আসে – জাস্টিস ডিলেড মিনস্ জাস্টিস ডিনায়েড।

সমাজের এলিট ক্লাসের মানুষেরা কী ভাবছেন জানি না।  বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক নেতারা কী ভাবছেন তাও জানি না। শুধু এইটুকু জানি যে চুপ করে থাকার, সব সহ্য করার দিন বোধহয় শেষ হয়েছে। মনের গভীরে যে মশালটা জ্বলছিল, সেটাকে এ বার হাতে নিতে হবে। কিছু পোড়াতে নয়, সমাজ শুদ্ধিকরণের জন্য। 

বলাই বাহুল্য প্রতি বছর পুজোর বেশ কিছু আগে থেকে দোকানপাটে এবং রাস্তায় মানুষের ঢল নামে। ট্র্যাফিক পুলিশেরা হিমসিম খায় ভিড় সামলাতে কিন্তু এ বছরের চিত্রটা অন্য রকম। আমি দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা তাই গড়িয়াহাট মোড় দিয়ে দিনের মধ্যে একআধবার যেতেই হয়। এ বার একটু ব্যাতিক্রম লক্ষ্য করছি, সপ্তাহের ছুটির দিনেও রাস্তা তুলনামূলক ভাবে অনেক ফাঁকা থাকছে। এটা কী একধরনের প্রতিবাদ নয়? প্রশ্ন করি নিজেকে। সারা কলকাতা এতদিনে আলোর মালায় সেজে ওঠার কথা, এই প্রতিবেদন যখন লিখছি, সেসবও এ বছর চোখে পড়েনি সেভাবে। কোথাও একটাও তোরণ তৈরি হয়নি। সব আবাসনের এবং সব মোড়ের মাথায় নানান ফ্লেক্স, ফেস্টুন, পোস্টার টাঙানো আছে। তাতে অবশ্য একটাই স্লোগান লেখা, “উই ওয়ান্ট জাস্টিস।”

একটা কথা উল্লেখ না করে পারছি না, সেটা হচ্ছে এ বছর আমার আবাসনের বিশ্বকর্মা পুজোয় একটাও ঢাক ঢোল বাজেনি, একটাও গান বাজেনি মাইকে। মেশিন ঘরে শুধুই ছোট করে পুজো হয়েছে, তাতে কোন আড়ম্বর ছিল না। মেশিন ঘরের খেটে খাওয়া মানুষদের এই প্রতিবাদকে শ্রদ্ধা না জানিয়ে পারলাম না।

দু’হাজার চব্বিশের পুজোর নির্ঘন্ট যদি দেখি আমরা তাহলে একটা অদ্ভুত জিনিস আমাদের মনকে অনেকগুলো প্রশ্ন করতে বাধ্য করবে। প্রতিদিন অর্থাৎ পঞ্চমী থেকে দশমী রোজই ভোর চারটে থেকে ছ’টার মধ্যে পুজো শেষ করতে হবে। সারারাত জেগে পুজোর কাজ করতে হবে। দশভূজাও কি রাত দখল দেখতে চান? এমন পুজো নির্ঘন্ট আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এও যেন এক প্রকৃতির প্রতিবাদ। 

একেকটা করে  দিন এগোলো শারদ উৎসবের। যথানিয়মে।
কিন্তু আকাশের পেঁজাতুলো মেঘ, কাশফুল আনন্দের আবহাওয়া নিয়ে এসে খুশির জোয়ারে ভাসাতে পারলো না শহর বা গ্রামাঞ্চলের কোন মানুষকে। শিউলির সুগন্ধও যেন ফিকে আজ। 

“ রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দিষো যহি”
আমরা নিজেদের অজান্তেই অনেক কিছু চেয়েছি মহিষাসুরমর্দিনীর কাছে কিন্তু নিজেদের নিরাপত্তা কি কখনো চেয়েছি? না– চাইনি। আমরা পারিনি নিজেদের অশুভ শক্তির হাত থেকে বাঁচাতে। 

যেখানে সব মায়ের, সব মেয়ের, সব বোনের মুখ ব্যাথাতুর মলিন সেখান এ বার মা দুর্গার মুখে কী ভাবে হাসি ফুটবে?

দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তির পুজো করা হয় কিন্তু চিন্ময়ীদের ন্যূনতম সম্মানটুকুও দিতে শিখিনি। আমরা ক্রমশ অন্ধকার যুগে ফিরে যাচ্ছি। সভ্যতা, ভদ্রতা, সততা, সহিষ্ণুতা কথাগুলোর অর্থ আমরা ভুলতে বসেছি। 

এ বছরের এই প্রতিবাদের পুজো আমাদের শিখিয়ে দিল, সবাই সংঘবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে, এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে, এই সমাজ ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে মেরুদণ্ডের জোর রাখতে হবে। জুডিশিয়ারির সঠিক বিচার এবং মুল্যায়নের ওপর ভরসা রাখছি আরো একবার। আসুন সবাই হাতে হাত রাখি। ক্ষমতার লড়াই নয়, ন্যায় বিচারের লড়াইয়ে রাস্তায় নামি।

এবার যখন মর্তে আসবি
জ্যান্ত হয়েই আসিস মা
মন্দিরের ওই পুতুল হয়ে 
আর যেন চেয়ে থাকিস না…

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *