সাম্য রাইয়ান
“ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কইলকাত্তার উপর,
তোমরা আমায় চিননি, তোমরা আমায় চিননি”

স্বদেশ-গ্রাম ছেড়ে অন্য দেশে অন্য শহরে চলে যাবার মর্মবেদনা নিয়ে এ গান। দেশভাগের কারনে হেমাঙ্গ বিশ্বাস হবিগঞ্জ থেকে গেছেন কলকাতা শহরে। সেখানে তিনি ডানা ভেঙে পড়ে গেছেন। আর ফিরতে পারছেন না, খুঁজে চলেছেন আত্মপরিচয়!
জীবিকার প্রয়োজনে যাওয়া আর দেশভাগের কারণে যাওয়া এক নয়, তবু এ দুইয়ের বেদনা বোধয় কিছুটা একইরকম— কোনো কোনো বিন্দুতে মিলে যায় এ বোধ। গ্রামের ডানা মেলে উড়ে বেড়ানো পাখি, নগরে গিয়ে আছড়ে পড়ে— ডানা ভেঙে যায়— ওড়াউড়ি বন্ধ! জন্ম হয় এক নতুন অবয়ব। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শুরু হয় টিকে থাকার লড়াই, চিরচেনা জীবন বজায় থাকে না সেখানে—
“দুজনের চোখ দিয়ে এখন আর গোধূলি দেখি না।”
(অস্তরাগ)
সেইসব দিন বহমানতা হারায়, শহুরে স্পিডব্রেকারে ধাক্কা লেগে নতুন গতি পায় স্রোতস্বিনী জীবন৷ সেই নাগরিক জীবনে প্রবেশের রূপ-রঙ অবলোকন করেছেন ধীমান ব্রহ্মচারী— গ্রামের কবিয়াল এসে পড়েছেন নগর কলকাতায়, তারপর তাঁর চোখে নগরের গতিময়তা-স্থিতি ও দ্বন্দ্ব যে রূপে ধরা দিয়েছে, বেদনা ও ভালোবাসা নিয়ে সে বিবর্তনের ইতিকথা তিনি লিখেছেন ‘শহর ও কবিয়াল’ কাব্যে। সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব এর পাতায় পাতায় রগরগে হয়ে উঠেছে। একটু স্বস্তির আশায় জীবিকার প্রয়োজনে নগরে গিয়েও কি স্বস্তি পাওয়া যায়? নগরের চোরাগলিতে হারিয়ে যাবার ভয়। তবুও যেতে যেতে ক্লান্তি নিয়ে কিছুটা বিশ্রাম, শান্তির খোঁজে! পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্ব নিয়েই খুঁজে চলা এ নাগরিক জীবন—
“শহরের শেষ রাস্তার প্রান্তে পৌঁছে একটা বাঁকে এসে
দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম।
থেকে থেকেই শুধু ভাবছি এভাবেই চোরা গলিটার সন্ধান পাব
অথচ
পেলাম না।
না পাবার কোনো কারণ হয়তো আজও অজানা
তবুও হাতড়াচ্ছি”
(খোঁজ)
বিজ্ঞাপনের শহরে ছেঁড়া হোর্ডিং, ট্রাফিক, ফুটপাতে ফুটে থাকা অন্ধকার দেখতে দেখতে কবি ভাবেন, “হয়তো এইপথেই হেঁটেছিল জীবনানন্দ— অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি/ আর নয়তো কোনো কবিয়াল।”
“শহর গহ্বরে লুকিয়ে থাকে
আদিম পৃথিবীর পাপ৷”
(আদিম পাপ)
নাগরিকের কিছু মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর তাগিদেই আদিতে শহর জন্মলাভ করেছিল। শহরের বিকাশ মানুষ এবং ব্যবসার প্রসার ঘটাতে সহায়তা করে চলেছে। এখানে চাকরির সুযোগ-সুবিধাও বেশি। কালক্রমে শহরের দূরবর্তী এলাকাগুলো থেকে অধিবাসীগণ প্রয়োজনের তাগিদে শহরের ভিতরে অন্তর্ভুক্ত হতে শুরু করেন। গ্রামের কৃষিজীবী মানুষটি হয়ে ওঠেন শহুরে শ্রমিক।
“রাত ফুরলেই ব্যস্ত শ্রমিক দলের সঙ্গে ফিরি; কাজকর্মের ফাঁকে
হাওয়ায় মিশে থাকা নিকোটিন নিয়ে চলছি প্রত্যেকটা মুহূর্ত
আর তখন বুঝতে পারি আমরা যেন কোথাও হারিয়ে যাচ্ছি”
(বিলীন)
কাজ শেষে শ্রমিকদলের সঙ্গে ফেরা যায়, কিন্তু মুক্তি মেলে কি?
“আমি মুক্তি পেতে চেয়েছিলাম বিকেল ঠিক পৌনে চারটে নাগাদ
ফসিলের আস্তারণ সরিয়ে ভাবলাম এবার ঘরে ফিরতে পারব—”
(শেষ পাণ্ডুলিপি দেওয়া থাক মিশর সভ্যতাকে/ ১৫)
ধারণা করা হয়, কৃষি বিপ্লব শহর সৃষ্টির মূল। এই বিপ্লব কৃষির উদ্ভাবন করায়। এর ফলে মানুষ খাদ্য উৎপাদনের তাগিদে স্থায়ীভাবে একস্থানে বসবাস শুরু করে। এই ঘন জনবসতির ফলেই ধীরে ধীরে শহর গড়ে ওঠে। পল বাইরোচ তাঁর ‘শহর এবং অর্থনৈতিক উন্নতি’ বইয়ে বলেন, “কৃষির ফলেই মানুষ একসাথে বসবাস করার প্রয়োজন অনুভব করে এবং এই মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর জন্যই মানুষ শহর গড়ে তোলে।” কিন্তু পরিবর্তিত শহুরে পরিস্থিতিতে কৃষি— বৃক্ষ— বিপন্ন! শহরের বন ও বাগানের বিপন্নতা উঠে আসে ‘বসন্ত’ কবিতায়—
“আজ বাগানের চারিদিকে মুষড়ে পড়া গাছগুলোকে দেখি।
চেয়ে দেখি
সব শুনশান,
শুধু একটা শিমুল গাছ,
পরনের জামা প্যানটাও আজ নেই,
গত বসন্ত কেড়ে নিয়েছে ওর সব।”
পৃথিবীব্যাপী শ্রমিকের একই চেহারা। ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতেও তাকে আলাদা করার উপায় থাকে না৷ পুঁজির রাজ্যে রাষ্ট্র নামক কারখানায় আমরা শুধুই শ্রমিক— আমাদের রূপ প্রকৃত প্রস্তাবে এক ও অভিন্ন৷ আলাদা করা যায় না কিছুতেই৷ একই স্টীম রোলারের নিচে পৃথিবীর যত শহুরে শ্রমজীব। এই বোধ ধীমান ব্রহ্মচারীর কবিতায় দৃশ্যমান হয় এভাবে—
“সবাই কেমন যেন একই মুখোশ পরে আছে জীবিকার তাগিদে৷”
(শেষ পাণ্ডুলিপি দেওয়া থাক মিশর সভ্যতাকে/ ১১)
সেই মুখোশ শুধু কি অন্যদের? না তো! সেখানে আত্মপ্রতিকৃতিও দৃশ্যমান৷ নিজের মুখ আবিষ্কার করার ভয়ার্ত অনুভূতিও রয়েছে—
“জামা কাদা-জলে ভিজতে ভিজতে পুরোটাই ভিজে যায়,
চেহারায় ফুটে ওঠে আমারই মতো কোনও এক মানুষের
জলছবি; যে আমার মতোই হুবহু—”
(শেষ পাণ্ডুলিপি দেওয়া থাক মিশর সভ্যতাকে/ ২৪)
পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে মধ্যবিত্তীয় চরিত্র এঁকেছেন কবি দ্বান্দ্বিক দোলাচলের তুলিতে। কেননা নিজের ব্যথাকে চেপে রেখে, গুমড়ে কেঁদে ওঠার পরেও বিরত থাকার যে বৈশিষ্ট্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির, তাকে অস্বীকারের উপায় নেই৷ কবিকে সত্য বলতে হয়। সে-ই সত্য, দর্শিত সত্যের উপরে যার অবস্থান৷ যার পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে শেষ সভ্যতার শেষ অসহায় মানুষটি মনে হয়।
“আমার জানলার কাচ বেয়ে আসে প্রতিবাদের ভাষা,
রাস্তায় রাস্তায় চলে মজুরের আন্দোলনের কোলাহল
আমি সবটুকু উপেক্ষা করে ফিরে আসি,
যন্ত্রনায় কান্না চেপে বন্ধ করি নিজের মুখ”
(শেষ পাণ্ডুলিপি দেওয়া থাক মিশর সভ্যতাকে/ ২৫)
এ কবিতার ‘আমি’ কবির আত্মপ্রতিকৃতি নয়, এ বিপুল মধ্যবিত্ত। ব্যক্তিগত বোধের বিবরণ থেকে এক নিমেষে কবি মোড় নেন সামষ্টিক পরিণতির মহাসড়কে। যেখানে দেখতে পান চিরচেনা মধ্য-নাগরিক চালচিত্র।
আসলে ধীমান ব্রহ্মচারীর প্রথম কবিতাবই ‘শহর ও কবিয়াল’ কিংবা দ্বিতীয় কবিতাবই ‘শেষ পাণ্ডুলিপি দেওয়া থাক মিশর সভ্যতাকে’ পড়ার সময় আস্ত শহরই যেন কানের কাছে ফিসফিসিয়ে ওঠে৷ পাতায় পাতায় শহরের কোলাহল— গাড়ির হর্ণ, চায়ের দোকানের আড্ডা, ট্রাম-চলার শব্দ, টাকা ও নর্দমার গন্ধ, ল্যাম্পপোস্টের আলো, সিগ্রেটের ধোঁয়া, আরো কত শহরচিহ্ন! যেখানে নিয়তই চলে মনন কিংবা নগর দখলের লড়াই— “আমি বলতে চেয়েছিলাম যুদ্ধ শেষ হোক।” (ইচ্ছা)
“পিছন ফিরে যদি তাকাই
দেখি হাজার হাজার মানুষের সারি
এরা সবাই মৃত।
…
এখন শুধুই মৌনতা,
চোখে চোখে ভয় আর থেকে থেকে কোণায় জমছে জল।”
(শেষ পাণ্ডুলিপি দেওয়া থাক মিশর সভ্যতাকে/২)
‘শেষ পাণ্ডুলিপি দেওয়া থাক মিশর সভ্যতাকে’ বইটা অন্যতর— মহারামীতে মানুষের বিপন্নতার দিনচিত্র উঠে এসেছে৷ বর্ণনাধর্মী সিরিজ কবিতাবই। যদিও কখনো কখনো আমাকে ক্লান্ত করে বিশদ বিবরণ! আমি তো আড়ালপ্রিয়—আঁধারে থাকতে ভালোবাসি। আলোতে ঝলসে গেলে চোখ— তার আগে, কালো চশমায় ঢেকে রাখি চোখের যৌনজীবন। কবি জানেন, তাকে জানতে হয়, মিথ্যা সব সময় মিথ্যাকেই উস্কে দেয়। মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা যায় না!
“ধর্মাবতার আমাকে রাজদণ্ড দিন
যাতে আমি সারা দিন রাত একটা অন্ধকার ঘরে
নিজের আত্মার সঙ্গে কথা বলতে পারি”
(শেষ পাণ্ডুলিপি দেওয়া থাক মিশর সভ্যতাকে/১০)
আমরা সর্বদা চেয়েছি, পৃথিবীটা সর্বপ্রাণের হোক। শুধু মানুষই নয়, স্বাভবিক জীবনে থাকুক সকল প্রাণ৷ সীমান্তে হত্যা না হোক। সর্বপ্রাণবাদী কবি তাই লিখেছেন—
“সব অন্ধকারের প্রবেশ পথে বসিয়েছিলাম আলো
সারারাত হয়তো কারোর আশা টিম টিম করে জেগেছিল
সীমান্তে বন্দুক হাতে
সীমান্ত থেকে না ফিরে আসার কোন শঙ্কায়,
যেখানে প্রতিনিয়তই বাজে শেষের ঘন্টা।”
(শেষ পাণ্ডুলিপি দেওয়া থাক মিশর সভ্যতাকে/ ১৬)
ধীমান ব্রহ্মচারীর কবিতায় নগর-প্রতিবেশের গভীর ছাপ থাকে।অনেক পংক্তি আছে তাঁর কবিতায়, যার সামনে আমরা থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হই—
১. পাজরের মাংস শিথিল হয়
রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে
(একটি রাজনৈতিক আচরণ)
২. এখানে ইতিহাস ফিকে হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে
শহরের ইমারতের ভিড়ে।
(একা থাকার গান)
৩. শহর আগলে রাখবে আমাদের মৃতদেহ।
(এখন সময়)
৪. জীবন এখানে উদ্বাস্তু নামে পরিচিত
(শহরের এক শীতকালীন রাতে)
৫. শহরের ছবি ভেসে ওঠে শহরের রাস্তায়
(প্রতিবিম্ব)
৬. হঠাৎ একপশলা বৃষ্টিতে জলে ভেসে যাচ্ছে
আমার মার্কসবাদী স্বপ্নের ইস্তেহার পত্র, যেখানে
আমার শৈশব জুড়ে রয়েছে শুধু স্বপ্ন দেখার দেশ—
(শেষ পাণ্ডুলিপি দেওয়া থাক মিশর সভ্যতাকে/ ৯)
৭. হাতড়ে হাতড়ে আমি খুঁজে নি আমার রক্তের দাগ লেগে থাকা
একটা বই যার নাম ‘ম্যাক্সিম গোর্কির মা’
(শেষ পাণ্ডুলিপি দেওয়া থাক মিশর সভ্যতাকে/ ২৫)
ধীমান ব্রহ্মচারীর কবিতায় প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশের যে রূপ দৃশ্যমান— তা আমাদের পরিচিত। সেই চেনা জগত থেকে তুলে আনেন তিনি কবিতার উপাদান; যা অখণ্ড পরিণতিতে খণ্ডিত ভূগোলরেখা ও গভীর বিপন্নতা মাড়িয়ে বহুবর্ণ স্বপ্ন নির্মাণ করে।



খুব ভালো পাঠ প্রতিক্রিয়া। যেমন লেখা তেমন তার অনুভব।