বিষাদ বায়ু। বিষন্নতায় মুহ্যমান সারা সমাজ থেকে মানুষ। এই মানুষের প্রতি কবির আহুতি শান্তির। আহুতি প্রেমের। আহুতি প্রতিবাদের। লিখলেনধীমান ব্রহ্মচারী
আমি মৃতদের সঙ্গে কথা বলতে পারি
আমি মৃতদের সঙ্গে কথা বলতে পারি

মৃত মানুষ, গাছপালা, নদীদের সঙ্গে।
কখনও কখনও আমি আমার পূর্বপুরুষদের দেখতে পাই: প্রবচনগুলোতে চড়ে উড়ে বেড়াচ্ছেন আমার ঠাকুমা, আমার ঠাকুর্দা ধাঁধায় চেপে পার হচ্ছেন নদী।
দ্বিপদী আর চতুপদী লাইনগুলোতে দোল খাচ্ছেন কেউ কেউ
কেউ কেউ দাবার ঘুঁটিগুলোয় চড়ে যাচ্ছেন এখানে ওখানে। কেউ কেউ খেলছেন গোল্লাছুট, আবাদ করছেন জমি,
কেউ কেউ স্বর্গের বেলপাতা তুলছেন।
কখনও কখনও আমার প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়।
তারা খুব একটা পালটে যায়নি; শুধু
তাদের শরীরগুলো হয়ে গেছে কাচের।
আমরা তাদের শরীরের ভেতরের হৃৎপিণ্ডগুলো স্পষ্ট দেখতে পাই।
না, ওরা বন্ধ হয়নি, বরং ওরা
আমাদের হৃৎপিণ্ডগুলোর চেয়ে জোরেই চলেছে।
ঝিরঝিরে বৃষ্টির ভাষায় ওরা কাঁদে আর
মৃদু হাসে ঝরে-পড়া পাতাদের মতো।
আমরা যারা তথাকথিত জীবিত মানুষ
ওরা তাদের থেকে খুব একটা আলাদা নয়, শুধু মাঝে মাঝে ওরা ঠিক করে যে, উড়বে। ওদের আকাঙ্ক্ষা, আশঙ্কা, হতাশা: সব ঠিক আমাদেরই মতো।
মৃত্যুতেই সন্দেহের শেষ হয় না;
প্রশ্নগুলো তাদের তখনও তাড়া করে।
কিন্তু তারা অনেক আগেই তাদের ভাষা হারিয়েছিল।
তাদের সূর্য পুব আকাশে একটা মড়ার খুলির মতো ওঠে। তাদের কপালে ছত্রাক জন্মায়।
আমি যখন নিজের সঙ্গে কথা বলছি
আমি আসলে মৃতদের সঙ্গেই কথা বলছি।
আমি যখন তোমার সঙ্গে কথা বলছি, তখনও আমি মৃতদের সঙ্গেই
কথা বলছি।
আমাদের ভাষায় সূর্য ডুবে গেছে।
ভারতবর্ষের কবিতা। বাংলার কবিতা। এটি একটি মৃত্যু প্রেম এবং চিরন্তনের অবগাহন। কবি নিজের সঙ্গে কথা বলেন। উত্তাপহীন,সংকোচনভাবে। অন্ধকারে, নিজের মনে। চারিদিকে জীবনের সংকুচিত প্রবাহ তিনি দেখতে দেখতে যান। আর তারপরই নিজের মধ্যে প্রশ্ন করতে থাকেন। কবি লেখেন – ‘ মৃত্যুতেই সন্দেহের শেষ হয় না;/
প্রশ্নগুলো তাদের তখনও তাড়া করে।/
কিন্তু তারা অনেক আগেই তাদের ভাষা হারিয়েছিল।/
এই যে প্রশ্ন তাত্ত্বিকের। এই যে প্রশ্ন উঠে আসে মৃত্যুর পরও, এখানে অন্ধকার, অন্ধকার পেরিয়ে দ্যুলোকে চলন। আসলে আমাদের চিন্তার সঙ্গে বোধের আর কাজের সঙ্গে জীবনের পারস্পরিক যে যোগ এই যোগ শুধুমাত্র একচ্ছত্র কালের নয়, জীবন ও ঘটনার আকস্মিকতায়। তাই কবি সর্বদা বাস্তববাদী। সর্বদা নিজের মতো করে দেখেছেন প্রকৃতি, জল , আলো, অন্ধকার। এই অন্ধকারের পথেই তাঁর মৃত্যুর পথ। এই পথের সূচনা আর শেষ সেও প্রশ্ন চিহ্নের। কবিতার বাস্তবতা বা naturalism পেরিয়ে কবিতার কথা পৌঁছে যায় surrealism এর পর্বে। আর এই কথা আলোচনা করলে আমাদের ফিরে আসতে হয়, জীবনানন্দের কাছে। একটা কবিতার কথা এখানে উল্লেখ করি :
‘আলো-অন্ধকারে যাই–মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে!
স্বপ্ন নয়-শান্তি নয়-ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমি তারে পারি না এড়াতে
সে আমার হাত রাখে হাতে;
সব কাজ তুচ্ছ হয়, পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা-প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়!'( বোধ – ধূসর পাণ্ডুলিপি/ জীবনানন্দ দাশ)
কত শতক পেরিয়ে এই স্তুতি। কত দশক পেরিয়ে বাংলার এক মহাকবির চিন্তাকে উপলব্ধি করছেন, ভারতবর্ষের দক্ষিণে বসে থাকা কবি। এই চেতনার প্রবাহই শেষ কথা। শেষ উচ্চারণ। এইখানেই পূর্বের দশকের কবির কথা এসে যেন বলেছেন পরবর্তী কয়েক দশক পেরিয়ে আসা কবি। একই পথ, একই গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন যেন উত্তরসূরি হয়ে। ‘প্রেম এবং প্রকৃতি, সামাজিক অসাম্য আর ভাষার বহুস্থরীয়তা বারবার বিষয় হয়েছে সচ্চিদানন্দনের কবিতার। বাস্তব অবশ্য তাঁর কবিতায় কেবলই বাস্তব নয়। তাঁর কাব্যের বাস্তব অবিচ্ছেদ্য অংশ কল্পনা আর বাস্তবহীনতার।’ – এই কথাই লেখা হয়েছে বইটির পেছনের মলাটে। বাস্তবতার স্থির কল্পনায় সজাগ প্রহরী।
মালায়ালম কবি কে. সচ্চিদানন্দন। তাঁর বেশ কিছু নির্বাচিত কবিতা অনুবাদ করেছেন কবি অংশুমান কর। বইটি প্রকাশ পেয়েছে দে’জ পাবলিশিং থেকে। কবিতার অনুবাদ এবং বইটির শুরুতেই আছে একটি সাক্ষাৎকার। আর রয়েছে প্রায় ৩২টি নির্বাচিত কবিতার বাংলা অনুবাদ। একটা কথা বাংলা সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে অনেক সময় শ্বাশত হয়ে থাকে, Stayle in Man Himself. আর তাই যেকোন শিল্পীর নিজের জীবন, দর্শন, আচার ও জীবিকার সাথে তাঁর চিন্তার ও কাজের কোথাও যোগসূত্র থাকে। সাক্ষাৎকারে মালায়ালম কবি কে. সচ্চিদানন্দনকে একটি প্রশ্ন করা হয় – ” অংশুমান : অতীত আপনার কবিতার একটি বড়ো বিষয়। প্রায়ই আপনার কবিতায় আপনার গ্রামে কাটানো আপনার অতীত জীবন বর্তমান যাপনের সঙ্গে মিশে যায়। আপনার গ্রামের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক নিয়ে যদি কিছু বলেন…
সচ্চিদানন্দন : ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো আমিও বলতে পারি যে, আমার গ্রাম না-থাকলে আমি কবি হতাম না। আমার গ্রামে এমন কিছু ছিল যেটা আমাকে প্রবল আকর্ষণ করত ধানের খেত, ব্যাক ওয়াটার, ছোট্ট ঝরনাগুলো, পাহাড়গুলো, নানা ফুলে ভরে থাকা ঝোপঝাড়, গ্রামের মানুষদের সহজ-সরল জীবনযাত্রা, এইসব আমাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করত। অবশ্যই আমার গ্রাম একটা আদর্শ গ্রাম ছিল না। একটি গ্রামে অন্ধকার যা-কিছু থাকে, যেমন, দারিদ্র, নির্যাতন, গুজব যা মানুষকে আহত করে, এসব আমার গ্রামেও ছিল। কিন্তু আমি ছিলাম ওই প্রকৃতির অংশ পরিচর্যাহীন, বিস্তৃত প্রকৃতি। আমি মনে করতাম কবিতার এমনই হওয়া উচিত। আমার একটা কবিতা আছে যেখানে আমি লিখেছি আমার প্রিয় বাগান নয়, জঙ্গল। তবে যখন আমি বেড়ে উঠছিলাম তখন এই সবকিছু সম্পর্কে আমি খুব একটা সচেতন ছিলাম না। পরে আমি বুঝেছি আমার গ্রামের প্রকৃতি আমার কল্পনার ওপর বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিল।”
এই উত্তর থেকেই একজন শিল্পীর বাল্য ইতিহাস, শৈশব, আদর্শ, রুচি এবং জীবিকা সম্পর্কে সহজেই কিছু অনুমান করা যায়। কবিতার মধ্যে যে জৈবিক চেতনার প্রয়োগ, জীবনের এক নিজস্ব দেখার বোধ, এক স্বাধীন চিন্তা, প্রতিটি সময়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুভব এসবই তো শিল্পের আঙ্গিক। কবিতা লেখার ক্ষেত্রে প্রায় অনেক শিল্পীর বা কবির অন্তর্দৃষ্টি স্বাভাবিকভাবে গতিশীল এবং চলমান হয়ে থাকে। একটি কবিতার লাইন অথবা একটি কবিতার বিষয় অথবা একটি কবিতার ভেতরের বোধ — এগুলি সবই সেই সৃষ্ট কবিতার আত্মকথন, মাঠের ফসল। এখানে হারানোর কিছু নেই, যা কিছু আছে গ্রহণের। উপভোগ্যতায় এখানে মূল বিষয়।
গ্রাম্যতা তাঁর চেতনার এক বিশেষ দিক। তিনি একদিকে যেমন দৈনন্দিন জীবনের কাহিনির কথা বলছেন, আবার একদিকে কবিতায় বলেছেন মৃত্যুর কথা, বলছেন সময়ের কথা, বলছেন সম্পর্কের কথা। যুদ্ধের কথা, পরিণতির কথা। হিরোশিমার স্মৃতি কবিতার নির্মাণ কী অভাবনীয়ভাবে করেছেন। তিনি লিখছেন :
আমরা ঘাস
আমাদের কোনো ঝড় শেষ করতে পারে না।/
খরগোশ, ভূমিকম্প আর বিপ্লবও আমাদের শেষ করতে পারে না।/
জঘন্য হত্যাকাণ্ডের নীরব সাক্ষী আমরা, বলছি :/
আর না।/
অসাধারণ প্রতিবাদ। মৌন প্রতিবাদ। শান্ত প্রতিবাদ। তীর্যক প্রতিবাদ। বিশ্ব সভ্যতার ভয়ংকর নরহত্যা। খুনের বদলা খুম দিয়ে। অস্ত্রের বদলা অস্ত্র দিয়ে। নৃশংস পাশবিকভাবে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া সভ্যতার কলিজা। এই বীভৎসতা আমাদের স্তব্ধ করে দেয়, কথা বলার স্বর কেড়ে নেয়। নুইয়ে দেয় মাথা। ক্লান্ত মানুষ। ক্লান্ত পৃথিবী হৃদপিন্ড। ক্লান্ত হিরোশিমার প্রকৃতি, আলো হয়ে আসছে মৃয়মান, সন্ধ্যের সূর্যাস্ত একটু একটু করে কালো আকাশে লেপে দিচ্ছে আবছা মায়ার রং। ধুলিধূসরতা পেরিয়ে আমরা দেখছি প্রান্তজনের জীবন। এই জীবনে আছে সজীবতা, আছে জৈবিক চাহিদা। আছে বার্ধক্যের বোঝা আর তারুণ্যের প্রেম। এই প্রেমের মধ্যেই কবি খোঁজেন জীবনের স্রোত, যা একেবারে নয় ধীরে ধীরে তিনি নতুন করে প্রাণ স্ফুরণ করতে পারেন। আগুনের লেলিহান শিখায় ক্ষত বিক্ষত হয়ে, পুড়ে যাওয়া মানুষের প্রতি যেন তাঁর সমবেদনা। যেন তাঁর আত্মাহুতি। তিনি এই হত্যার বিরুদ্ধ স্বর। তাই তিনি বলেন :
‘হতচকিত গাছগুলো যেখান থেকে মৃত পাখির দল লুটিয়ে পড়েছিল,/
তেতো মধু, কালো পরাগ, কালো বরফ,/
বৃষ্টিকে হত্যা করছিল, হত্যা করছিল বাতাসকে/
হত্যা করছিল চাঁদের আলোকে।’
বিষাদ বায়ু। বিষন্নতায় মুহ্যমান সারা সমাজ থেকে মানুষ। এই মানুষের প্রতি কবির আহুতি শান্তির। আহুতি প্রেমের। আহুতি প্রতিবাদের।
অসাধারণ কবিতা ও চিন্তায় এই বইটি নির্মাণ হয়েছে। কবিতার এই কথা, এই ভাষা, এই প্রলেপ আমরা খুব সহজেই বুঝে নিতে পারি।
কে. সচ্চিদানন্দন – নির্বাচিত কবিতা / ভাষান্তর – অংশুমান কর / দে’জ পাবলিশিং/ মূল্য -২০০.০০




Be First to Comment