সেদিন দুজনে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং জ্যোতি বসু। ছবি: রাজীব বসু
অমল মাজি এগজিকিউটিভ এডিটর, অনলাইন কোলফিল্ড টাইমস
বিনিয়োগ, শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থান। বাঙালির জন্য এক নতুন স্বপ্ন, বাংলায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনার ভাবনা। বঙ্গ রাজনীতিতে ব্যক্তিগত স্বচ্ছতার এক সর্বজনস্বীকৃত নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে আলোকময় দিক। তাঁর অতি বড় সমালোচকরাও বলেন, বুদ্ধদেবের প্রশাসনিক জীবনে সদিচ্ছার অভাব ছিল না বিন্দুমাত্র। কিন্তু কিছু ‘ভুল’ তাঁর নামের সঙ্গে দীর্ঘ ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের শেষ মুখ্যমন্ত্রীর তকমা সেঁটে দিয়েছিল।

১৯৪৪ সালের ১ মার্চ উত্তর কলকাতায় এক বামপন্থী পরিবারে জন্ম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। ১৯৬২ সালে ভারত-চিন যুদ্ধের পর ১৯৬৪ সালে সিপিআই থেকে ভেঙে গঠিত হয় সিপিএম। ১৯৬৬ সালে বুদ্ধদেব সিপিএমের সদস্য হন। তখন তিনি ছিলেন একজন বাম-মনস্ক ছাত্র, যার সাহিত্য চর্চার একটি বিশেষ আগ্রহ ছিল। প্রথমে ছাত্র আন্দোলন, তারপরে দলে যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআইয়ের কাজে জড়িয়ে থাকলেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জীবনে সবসময়েই সাহিত্য-সংস্কৃতি গুরুত্ব পেয়েছে। নিজেও অনেক কবিতা, নাটক লিখেছেন, করেছেন অনুবাদও। দলে যোগ দেওয়ার পর বুদ্ধদেব মূলত দলীয় পত্রিকা সম্পাদনা এবং লেখালিখির দায়িত্ব পালন করেন। ষাটের দশকের শেষের দিকে ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন (ডিওয়াইএফআই)-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক হন। খাদ্য আন্দোলন ও ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রচারেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
বাংলায় বামফ্রন্টের সরকার হল ১৯৭৭ সালে। মন্ত্রী হলেন তিনি। পছন্দের সংস্কৃতি দফতরের দায়িত্বে ছিলেন। পরের বার বিধানসভা নির্বাচনে অবশ্য হেরে গিয়েছিলেন। সেসময় দলীয় কাজকর্মে আরও বেশি করে সম্পৃক্ত হন। ফের পাঁচ বছর পর ভোটে জিতে মন্ত্রিসভায় প্রত্যাবর্তন। সেবারও (১৯৮৭ সাল) যাদবপুর কেন্দ্র থেকে জিতে তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের মন্ত্রী হন। এর পর ২০০০ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা ১১ বছর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বুদ্ধদেব।
উল্লেখযোগ্য ভাবে, নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন, তবে পরে আবার মন্ত্রিসভায় ফিরে আসেন। ১৯৮৪ সাল থেকে বুদ্ধদেব সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির আমন্ত্রিত সদস্য এবং ১৯৮৫ থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। ২০০০ সালে পলিটব্যুরোর সদস্য এবং ৬ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসেন। ২০১১ পর্যন্ত তিনি ওই পদে ছিলেন।
২০০৬ সালে ২৩৫টি আসনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসেন। শিল্পায়নের অভিমুখে রাজ্যকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের পদ্ধতি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়। পূর্বসূরি জ্যোতি বসুর সময় থেকেই একের পর এক কলকারখানা বন্ধ নিয়ে সমালোচনায় বিদ্ধ বাম সরকার। এই পরিস্থিতির মোড় ঘোরাতে চেয়েছিলেন বুদ্ধদেব। বাংলায় একটি শিল্প নবজাগরণের সুস্পষ্ট প্রয়াস দেখা যায় সপ্তম বাম সরকার গঠনের আগে – পরে। কিন্তু তার জন্য রচিত রূপরেখা ততটা স্পষ্ট ছিল না।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পেশ করা দলিল অনুযায়ী, শিল্পায়নের জন্য জমি অধিগ্রহণ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনা ব্যতিক্রম হিসাবে উল্লেখ করেন তিনি। ২০০৭ সালে নন্দীগ্রামে গুলি চালনায় ১৪ জন গ্রামবাসীর মৃত্যুর ঘটনা বামফ্রন্ট সরকারকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বুদ্ধদেবের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট শোচনীয় পরাজয়ের মুখে পড়ে। ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের অবসান ঘটে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, শিল্পায়ন করতে গিয়ে বুদ্ধদেব সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে যে ধাক্কা খেয়েছিলেন, তার থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। তাঁর আমলেই স্লোগান উঠেছিল, ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’। সেই লক্ষ্যেই সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ করেছিল তাঁর সরকার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জল গড়ায় সরকার পতনের দোরগড়ায়। যদিও দলীয় মহলে শোনা যায়, রাজ্যে শিল্পায়নের সেই সিদ্ধান্ত ছিল নিতান্তই ফলের। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বুদ্ধদেব সেই পথে এগিয়েছিলেন। কিন্তু জমি অধিগ্রহণের বিতর্কিত পদ্ধতি এবং বিভিন্ন মহলের একত্রিত প্রতিরোধের মুখে কার্যত ‘একা ‘ হয়ে যান বুদ্ধদেব। যার পরিণতি ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বুদ্ধদেবের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারের শোচনীয় পরাজয়। ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের অবসান।

শুরু এবং শেষ। জ্যোতি বসু এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ছবি: রাজীব বসু
তার পর থেকে নিজেকে কার্যত গৃহবন্দি করে ফেলেছিলেন ৩৪ বছরের বামশাসনের শেষ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। অনেকের মতে, স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় নিজেকে গৃহবন্দি করেছিলেন। পাম অ্যাভিনিউয়ের দু’কামরার ফ্ল্যাট থেকেই খোঁজ রাখতেন বিশ্বের। ৮ আগস্ট সকালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জীবনাবসান হয়। বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। সময়ে সময়ে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে, তুমুল সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছেন দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে। তবে, তাঁর সাধারণ জীবনযাত্রা এবং আর পাঁচজন বামপন্থী নেতাদের থেকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির জন্য অনেকের কাছেই অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন।




Be First to Comment