ধীমান ব্রহ্মচারী
বাংলা গদ্যের ব্যাবহার, প্রয়োগ, নির্মাণ ও বৈচিত্র্য রামমোহন রায় থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (যদিও এক্ষেত্রে শ্রীরামপুর মিশন এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ভাষা পণ্ডিতদের অবদান অনস্বীকার্য)। আবার বঙ্কিমচন্দ্র – রবীন্দ্রনাথ থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আবার কমলকুমার মজুমদার… একে একে নবারুণ ভট্টাচার্য। দুই শতাব্দী ধরে এক বিরাট বাংলা গদ্যের প্রয়োগ গগনচুম্বী। শুধু মাত্র গদ্যের ভাষায় নির্মিত সাহিত্যের প্রভাব হয়েছে প্রাচ্য ছাড়িয়ে পাশ্চাত্য অভিমুখী।
বাংলা সাহিত্য যে কালের নিয়মে কতটা সময় ধরে পরিবর্তন হয়েছে, তা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যপ্রেমী থেকে শুরু করে বর্তমানে যারা বাংলা সাহিত্য চর্চার সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকেই বিনা বাক্যব্যয়েই সমর্থন করবেন। তৎকালীন সুদীর্ঘ প্রেক্ষাপটের ওপর দিয়ে বয়েছে সাহিত্যের স্রোত। বঙ্গভঙ্গ আন্দলোন (১৯০৫), প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮), কল্লোল আন্দোলন (১৯২৩), জালিয়ান ওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড (১৯১৯), একের পর এক সামাজিক পরিবর্তন বিরাট সময় ধরে চলা বাংলা সাহিত্যের বিশেষ বিশেষ সময়ের ফলক হয়ে রয়ে গেছে। ফলে গদ্যের শাণিত ভাষা পাঠকদের দিয়েছে প্রলেপ।

বাংলা সাহিত্যের একটা বিশেষ পার্ট (এক্ষেত্রে এই পার্ট শব্দটি দিক হিসেবেই বলব), তা হল কথা সাহিত্য। যার দুটি ভাগ এক ‘উপন্যাস’ এবং দুই ‘ছোটগল্প’। সার্থক উপন্যাস সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপধ্যায়ের হাত ধরে দুর্গেশনন্দিনী ‘ র মধ্য দিয়ে হলেও সার্থক ছোট গল্পের সূত্রপাত রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই। যাইহোক এরপর প্রায় দুশো বছরের বেশি পার হয়ে যাওয়া বাংলা সাহিত্যের ব্যাপ্তি ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে বিষয় বৈচিত্র্য,সামাজিক প্রেক্ষাপটে, মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধানে। এই বিরাট কাল পর্বে আমাদের বৃহত্তর পাঠকের সামনে এসেছেন একের পর এক কালজয়ী নাম। বিংশ শতাব্দীতে বেশ কিছু লেখক ও লেখিকার কথা সাহিত্যের আখ্যান ও তার রীতি করেছে পাঠক প্রিয়। তাই আলোচিত বই ‘ মৃত্যু, ময়ূর কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ‘ বিশিষ্ট লেখক ও চিন্তক অর্ণব সাহা ‘ র আলোচনায় উঠে এসেছে এমনকিছু নাম।
লেখকের কথায়, -” এই ক্ষুদ্র বইতে যে বাঙালি লেখকেরা আলোচিত, তাঁরা হলেন, মহাশ্বেতা দেবী, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, উদয়ন ঘোষ, মানিক চক্রবর্তী, রবিশংকর বল, নবারুণ ভট্টাচার্য, মতি নন্দী এবং অরূপরতন বসু। এঁরা সকলেই নিজ নিজ পন্থায় বাংলা আখ্যানের নাশকতার দেবদূত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের একটি নির্দিষ্ট উপন্যাসকে আলোচনায় ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। কারও কারও ক্ষেত্রে অবশ্য উপন্যাস ও ছোটোগল্পের মিলিত পাঠ ধরে এগিয়েছে আলোচনা।” এখন আমাদের নিরন্তর পাঠ পর্যালোচনায় উঠে এসেছে যে ‘সামাজিক অবস্থান থেকে অবক্ষয়’,’নিম্নবর্গের ইতিহাস’,’ প্রভুত্ব ও আধিপত্য(dominanc and hegemanay)’,’ অন্তঃসারশূন্যতা’, অথবা ‘ নাগরিক চেতনা ‘ বা ‘ চেতনার অন্তর্দ্বন্দ্ব ‘, ‘ রাডিক্যাল সোসাইটি ‘,’ সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম ‘ এবং এর পরবর্তী ‘ রাষ্ট্র বিপ্লব ‘ থেকে ‘ ব্যক্তিমানুষের অন্তর্ঘাত ‘ , যা থেকে কথা সাহিত্যের একের পর এক কাহিনীতে উঠে এসেছে ‘ অ্যাবসার্ডিটির’ এবং ‘ মর্বিডিটি ‘ ইত্যাদি ইত্যাদি। সেখানে এই বিষয় গুলোর এক বিরাট বাস্তব সত্যতা নিরন্তর গোটা কয়েক শতাব্দী ধরে সমাজ জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে।
আলোচক অর্ণব সাহার খুব গুরুত্বপূর্ণ এই বইটিতে উঠে এসেছে — মহাশ্বেতা দেবী, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, উদয়ন ঘোষ, মানিক চক্রবর্তী, রবিশংকর বল, নবারুণ ভট্টাচার্য, মতি নন্দী এবং অরূপরতন বসু প্রমুখ লেখকদের লেখা গল্প ও উপন্যাসের বিষয় এবং বাস্তবতা। উক্ত লেখক ও লেখিকাদের সাহিত্যের ভেতর দিয়ে তিনি সময়ের যে বাস্তবতা এবং এককেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে,বিংশ শতাব্দীর মানুষের যে জীবিকা ভিত্তিক বিচরণ,এবং বিরাট একটা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এক চরম ভিন্নমুখী জীবন বোধ ও চেতনার মধ্যে দিয়ে ক্রমশ এই অ্যাটমিক যুগে মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা রেখেই জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া — এরই কথা তিনি তাঁদের কথা সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে আলোচনা করেছেন। এবং এই আলোচনায় তিনি একটি শব্দ ‘ নাশকতার দূত ‘ এইটি প্রয়োগ করেছেন,উক্ত লেখক – লেখিকাদের জন্য।কেননা,এনার কেউই মেইনস্ট্রিমের কথা ভাবেননি। যে আধুনিকতার সূত্রপাত রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দের হাত ধরে এগিয়েছে, পরবর্তীতে ঠিক এদেরই হাত ধরে উত্তরসূরি হিসেবে উত্তর আধুনিকতার রীতি হয়েছে নির্মাণ। বইটিতে ‘ বিরসা,উলগুলান,অরণ্যের অধিকার ‘, বিচ্ছিন্নতা ও কাটা সেলাইয়ের দাগ : প্রসঙ্গ মানিক চক্রবর্তী ‘, ‘ বাংলা গদ্যের শেষ কমিউনিস্ট ‘ প্রভৃতির মতো প্রায় আটটি অসাধারণ প্রবন্ধ আলোচনায় নির্মাণ হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই বইটি। এরই, ‘বাংলা গদ্যের শেষ কমিউনিস্ট ‘ অংশে তিনি যেভাবে নবারুণ ভট্টাচার্যের সাহিত্যচর্চার কথা এবং তারই পাশাপাশি তাঁর গদ্য নির্মাণ এবং কাহিনীকে তুলে সাহিত্য পদভুক্ত করার যে আমৃত্যু প্রচেষ্টা, তা নিপুণভাবে আলোচনা করেছেন।
নবারুণ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘ নবারুণ কি একজন অন্ধ ‘নস্টিক’, যার অনুসন্ধিৎসা খুঁড়ে তোলে এইসব প্রান্তিক মানুষজনকে? ‘স্টিমরোলার’ গল্পে বৃদ্ধ চালকটির পুঞ্জীভূত ক্রোধ এক বিধ্বংসী কাণ্ড ঘটায়, যা এই ব্যবস্থার অন্তর্গত অসামঞ্জস্যের বিরুদ্ধে একক ব্যক্তিমানুষের অন্তর্ঘাত, যা একধরনের অ্যাবসার্ডিটির জন্ম দেয়। ‘খোচড়’ গল্পের বিষয় পুলিশ ঘাতক দ্বারা এক বিপ্লবী যুবকের হত্যা, রাষ্ট্র কর্তৃক যুব-আন্দোলন দমনের বীভৎসতা। কিন্তু হত্যার আগে-পরে ঘাতকের উদ্ভট শারীরিক অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় এক ‘মর্বিডিটি’। ‘হালাল ঝাণ্ডা’ গল্পের কথক এবং অন্যান্য চরিত্র সকলেই মৃত, অথচ এই গল্পে খুব স্থির এক সমাজবদলের নিশ্চিত প্রত্যয় কাজ করে। ‘কাকতাড়ুয়া’ নামক সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজমের ধাঁচে লেখা গল্পেও সুপরিকল্পিত এক ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড এবং তার পরবর্তী বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ নিরুত্তেজক ভঙ্গিতে বর্ণিত। আসলে নবারুণ প্রত্যেকটি গল্পেই ন্যারেটিভ ভেঙে চুরমার করেছেন, তাই নিটোল গল্পরেখা ক্ষীণ রেখে তিনি গড়ে তোলেন একটার পর একটা স্টেটমেন্ট। এই স্টেটমেন্টের পিছনে রয়েছে স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান।” অর্থাৎ যে মেইনস্ট্রিম এর বাইরের লেখক বলে,আলোচক আখ্যা দিয়েছেন,সেই অবস্থানের নিশ্চিত প্রতিস্থাপন একে বারেই সত্য হয়েছে। তাই আজকের এই ডিজিট্যাল যুগের সময়েও পূর্বসূরী সাহিত্যিকদের সাহিত্যপাঠ ও গ্রহণযোগ্যতার কথা তিনি যেন স্বীকার করছেন, তাঁর এই বইটিতে।
মৃত্যু, ময়ূর কনসেনট্রেশন ক্যাম্প – প্রসঙ্গ : বাংলা কথা সাহিত্য /অর্ণব সাহা/ মূল্য – ২৫০.০০/ সপ্তর্ষি প্রকাশনা




Be First to Comment