Press "Enter" to skip to content

কবির আত্মশ্লাঘা থেকে জন্ম নেওয়া কবিতারা যেন তাঁর সন্তানের মতোই

১৪টি কবিতা নিয়ে একটি বই। একটি অপমান। যাঁর থেকে পরিত্রাণ নেই কবিমন, বাড়ে অপমান, বাড়ে ক্রোধ। তারপর সারারাত নির্ঘুম। লিখলেন ধীমান ব্রহ্মচারী

(ক)

২৫ সেপ্টেম্বর দুপুর বেলা। কী ঘটেছিল ? আমরা কী করে জানব। আমার কেউই জানি না। অথচ অধীর আগ্রহে আছি এই আশা নিয়ে যদি কিছু জানতে পারি।  তাই নিজের ঘরের মধ্যে অবস্থান করে বাইরে থেকে আসা অবাঞ্ছিত ও অপ্রত্যাশিত কথা মনকে স্বাভাবিকভাবেই করবে বিচলিত। এই কি আত্মশ্লাঘা ? উদ্দীপনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে মৌনতা? একজন কবি নিরন্তর ভাবেন। এমনকি চলাফেরা করেন ভাবের মধ্য দিয়ে। অকস্মাৎ একটি কথা যখন নিজের দিকে ধেয়ে আসে,তখন ঠিক কী মনে হয়! এইরকমই কিছু ভাবতে ভাবতে একটা দিনের প্রায় সারারাত ঘুমোতে পারেননি কবি। পর পর দুটি ঘটনা। একটি ঘটে ফোনেই। দ্বিতীয়টি ঘটে এক আত্মীয়ের সঙ্গে অপমান সংবাদ। আচ্ছা এই অপমান শব্দটি তো এক রকমের সজ্জা। এর ‘ ভার ‘এতোই ভারি যে বহন করে নিয়ে যাওয়া খুবই কঠিনের কাজ। আর যার ফলে কোথাও এই ভার লাঘবের জন্য মাত্রাতিরিক্ত চিন্তা করে ‘কবির মস্তিষ্ক ‘! লিখে ফেলেন একের পর এক কবিতা! আসলে এই রাগ বোধই হয়তো বিপরীতে একটি শান্ত-শীতল নিস্তেজ জলরাশির প্রতিচ্ছবি! ভূমিকায় কবি জয় গোস্বামী বলছেন , –” একটি অপমান ঘটে, ফোনে। ২৫ সেপ্টেম্বর, দুপুরে। তার আগেই এক অতি নিকটজনের অপমান-সংবাদ পাই। সেদিন, দুটি ক্ষেত্রেই, সম্পূর্ণ নিরুত্তর থাকি- তারপর সারারাত নির্ঘুম।

পরদিন সকাল এগারোটা থেকে শুরু হয়ে মধ্যরাতের মধ্যে তৈরি হয় এগারোটি কবিতা। তারও পরের দিন সন্ধ্যা থেকে রাত্রির তৃতীয় প্রহরের মধ্যে জন্ম নেয় আরও পাঁচটি লেখা।

এই ষোলোটি কবিতার মধ্যে একটির ভেতর সেই অপমানের আভাস সূত্রাকারে এসে পড়েছে- আমি আটকাতে পারিনি। ‘… এই কথাগুলোই বলেছেন কবি, ছোট্ট এই পুস্তিকার ভূমিকায়। ছোট্ট এই পুস্তিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে প্রায় ১৪টি কবিতা। 

বেশ কিছু স্মৃতি মনে পড়ে, এই বইটি পড়তে পড়তে। আমার ছোট বেলা কেটেছে মফস্সলে। সেখানে আমরা ছিলাম যেহেতু জমিদার বংশের,তাই যেখানে সেখানে যা খুশি করে উঠতে পারতাম না। বাড়ির ছিল একটা কড়া শাসন এবং সম্মান। রাস্তাঘাটে বেরোলে প্রতিদিন কত পরিচিতদের সাথে দেখা হলে,অদ্ভুত একটা সম্মান প্রদর্শন পেতাম। বাবাকে প্রায় সকলেই দাদা এবং গ্রামে সবাই মেজ বাবু বলে ডাকতেন। কোনো কোনোদিন বাড়িতে কোনো অচেনা কেউ এলে বেল দিয়ে অথবা কড়া নেড়ে বলতেন, অমুক বাবু আছেন ? অমুক জায়গা থেকে এসেছি। গোয়ালা দুধ দিত প্রায় দুপুর তিনটেয়। বলতো,কাকাবাবু আছে? একটু ডেকে দাও না। আবার অচেনা গ্রাম থেকে কেউ এলে বলতো,উকিল বাবু আছে ? তাই অপমান অথবা অসম্মান এইটুকুই কেমন যেন আমাদের ছোটবেলা থেকেই গায়ের সাধারণ পোশাকের ওপর অদৃশ্য দামি পোশাক হয়ে থাকত। ভালো রেজাল্ট করে কলকাতার মতো শহরে আসতে হবে,পড়াশোনা করতে। অথচ, বাড়িতে ভাড়ারে টাকা নেই। আবার কাউকে বলতে পারব না। কারোর থেকে চায়তেও পারব না। কেমন যেন একটা অসম্মানবোধ আর অপমানবোধ কাজ করত। একটা অস্থির চঞ্চল উন্নাসিকতা কাজ করত, যতক্ষণ না টাকার একটা ব্যবস্থা হচ্ছে। এই সামাজিক অপমান কীভাবে মেখে মেখে গোটা স্কুল জীবনটা কেটে গেছে। আজকের যৌবনে এর গুরুত্ব অনেকটা বেশি। কাজ আর কাজের মধ্যেই মাঝে মাঝে অনভিপ্রেত অপমান কেমন যেন আমাদের কাছে অসম্মানের। কবি সত্যিই তো এই   ‘ঔরস ‘ নিয়েই বেশ কিছু কথা বলে গেছেন কবিতায়। 

পুস্তিকাটির কবিতা ‘ গৃহ ‘-এ লিখছেন —

‘ সমুদ্রের পর সমুদ্রের

কারা অধিকারী?

স্রোত, জলোচ্ছ্বাস, স্তম্ভজল

কেউ কিনতে পারি? (৩য় স্তবক)

এই আসমুদ্রের চিরন্তন সত্যের কথা কি কবি বলছেন না ? আদৌ কি এগুলো মনুষ্য আয়ত্ত করা যায় ?

পুস্তিকাটির কবিতা ‘ প্রাণ ‘ এ -লিখছেন —

‘ এক অর্ধে তন্দ্রা- অন্যদিকে

লুপ্ত হয় গান।

সে-জগতে আঙুল নাড়ায়

আমাদের ক্ষণস্থায়ী প্রাণ।'(১ম স্তবক)

তন্দ্রাচ্ছন্ন পৃথিবীরও কিন্তু একই সময়ে সবদিকে আলো থাকে না। এদিক কালো, ওদিক আলো। আমরা পরম ব্রহ্মের যেন আঙুলে বাস করছি। বেঁচে আছি এটাই আশ্চর্যের। আজ আছি, কাল নেই।

পুস্তিকাটির কবিতা ‘ কাদা ‘-তে -লিখছেন —

ভূয়সী প্রশংসা করো, মুখে-

প্রশংসা ভূয়সী!

আমি সেই প্রশংসা বিছিয়ে

সন্ধেবেলা প্রায়ই ছাদে বসি।

ভূয়সী প্রশংসা শুনে শুনে

কান অন্ধকার।

শ্রবণে সংগীত-ও ঢুকছে না-

বাক্য কোন ছার্!

ভূয়সী প্রশংসা ছাদে পেতে

বসবই না নিজে!

কেন না তাহলে এই ছাদ

ভেঙে পড়বে সরাসরি নীচে…

এমনকি মরতেও পারে কেউ

মাথায় ইঁট লেগে

ছাদে গিয়ে মাটিতেই শোব

পাশেই প্রশংসা থাক জেগে!(১ম থেকে ৪র্থ স্তবক)

এই কাদা দেওয়া মানেই তো বাঙালির চিরকালীন একটা অবিবেকি চর্চার উদাহরণ। কাদা দিয়েই তো সাদাকে সহজেই কালিমালিপ্ত করা যাবে। এইতো প্রয়াস এবং মানসিক প্রচেষ্টা। কিন্তু তাতে কি যায় আসে? 

আমাদের নিজেদের সমাজ কতটা ক্ষয়িষ্ণু। আশ্চর্য তখনই মনে হয় যখন দেখি, আমরা নিজেদের কেমন গুটিয়ে নিয়েছি নিজেদের মতো করে। আমরা কেউই এখন কারোর পেটের ভাতের জন্য কাঁদি না। অস্তিত্বের মধ্যেই আমাদের অনস্তিত্ব সত্তা বাসা বেঁধেছে নিজের মতো করে, আমরা এক টুকরো মোবাইল বিশ্ব হাতে ঘুরে নিচ্ছি ব্রহ্ম। একজন কবির আত্মশ্লাঘা থেকে জন্ম নিয়েছে কবিতারা যারা তাঁর সন্তানের মতো। আসলে একটা অপমান সে অপমান যদি আমরা যদি একটু দূরে সরিয়ে রাখি,তাহলে তো পুরো বইটা নিয়ে এবার একটু দেখি আর কি কি দেখা যায় ? নিঃশব্দ প্রতিবাদ, আগুনের ফুলকি, জ্বলন্ত কয়লার উত্তাপ – এই সমানুপাতিক চিন্তা গুলো কি কবিতা গুলো মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নেই ? তারওপর একটা প্রতিজ্ঞা। ঝড়ের মুখে, শান্ত নদীর পারে, বসন্তে বিছিয়ে রাখা মাঠের ধানের গায়ে, শীতের সকালের ঘাসের গায়ে, রাতের খোলা আকাশের অন্ধকারের গায়ে – এই পথ গুলো দিয়েই তো কবি হাঁটছেন,যাচ্ছেন কথা বলছেন মনের মধ্যে। কিন্তু সে সহ্যও আর কতক্ষন? ৮ পংক্তির কবিতা লিখছেন কবি সন্তর্পণে। নিঃশব্দে। কেউ জানেন না। জানে তাঁর আত্মা। তিনিই একমাত্র তাঁর সঙ্গে আছেন। প্রায় পর পর দুদিন তাঁকে সঙ্গ দিয়েছেন। প্রায় দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে এক সাধক করে যাচ্ছেন সত্যের সাধনা, সুন্দরের রূপ। আজকে তাঁকে হতে হচ্ছে অপমানিত, লাঞ্ছিত। সত্যিই এই অপমানতো এক প্রকারের বধ। কিন্তু তাতে কি কিছু যায় আসে? এই ‘ ভূয়সী প্রশংসা ‘ শুনতে শুনতে আর কোনো কিছুই মর্মে ভেদ করতে পারে না। সেই শোনার জন্য শ্রবণেন্দ্রিয় হয়ে যায় কঠোর। কোনভাবেই এই নিন্দার বারি বর্ষণে কখনও অস্তিত্ব শেষ হবে না। তাই তিনি বলেন —

‘রটনা ঘুরুক বাড়ি বাড়ি

ঘুরুক নিন্দাও-

ওগো সদালাপী মিথ্যাচার

ভালো চাও তো প্রাণ নিয়ে পালাও!’ 

এই শেষ লাইনই কি একটা শেষ দাড়ি নয়? যে সারা জীবন আর সময় ধরে মথ্যার অপপ্রচার করে গেলেন বা যাচ্ছেন,তাকেও তো থামতে হবে। তাকে কে থামাবে ? সময়ের হাওয়া কল না সততার মাফকাঠি? এই পংক্তিতেই কবি যেন দিশেহারা এবং লাগামছাড়া হয়েছেন। সাবধান করেছেন বিপরীতে থাকা রটনাকারী ব্যক্তিকে। 

(খ)

জয় গোস্বামী। ছবি : সন্দীপ কুমার

সাধারণত একটি কবিতার বইয়ের উৎসর্গ পত্র থাকে শুরুর দিকে। এই বইতে আছে একটু অন্য ভাবনা। আমার মনে হয়েছে,আসলে এটি এভাবে সাজানোর কারণ নির্দেশনামা। এবং সাবধান বার্তা। একজন কবির শক্তি, কবির আত্ম চিন্তা এবং সৃষ্টি সম্পূর্ণই হল তাঁর কবিতা। তাই উৎসর্গ পত্রে তিনি লেখেন — 

‘তোমার কাছেই রেখে যাই

আমার ঔরস।

যা ছন্দের ধারায় ঝরেছে

মৃত্তিকায়- সে-মৃত্তিকা মানেনি বয়স।

জানতাম না ছিলে ঋতুমতী।

না জেনে ভরলাম

উত্তপ্ত সম্পূর্ণ ব্রহ্মতেজ-

ভেসে গেল রোমাঞ্চিত গ্রাম।

তোমারই নামকরণে ধৃত হোক, ধৃত

ভবিষ্যৎ তার!

ধন্য হোক কাব্যযোনিপথ-

অমৃতে উৎসর্গ-ধন্য ঘৃত!

ধনধান্য ভরা প্রতিভার

অগ্নিমাতা, লেলিহান জয়ধ্বনিপথ

বলছে শেষপৃষ্ঠা স্পর্শ করে:

‘কী ধন্য কী ধন্য যে তোমার

স্বাধীন ইচ্ছায় বেছে নেওয়া

এ-গর্ভধারণ অধিকার!’

এই রেখে যাওয়া ঔরস’ই তো কবিত্বের স্পর্ধা। প্রতিরোধের দেওয়াল। ঐতিহ্যের অঙ্গীকার। যা কবি নিয়ে বইছেন দিনের পর দিন। কাল পেরিয়ে আজ তিনি ঘর সাজান ছন্দের, ইট গাথেন শব্দের, তিনি ভালোবাসেন সেই কবিতা লেখার রীতিকে, ভালোবাসার প্রেয়সী কবিতাকে। তাই কবিতাকে নিয়েই তাঁর জীবন পরিক্রমা। কথার মধ্যে, শব্দের মধ্যে, কাজের মধ্যে, প্রেমের মধ্যে এমনকি আগামীর মধ্যেই এই ‘কবিতার ঔরস ‘ দিয়ে যেতে চান। আসলে এই কবিতাকে মাথায় আনা তাকে, রেখে লালন করাটা একরকমের গর্ভজাত মাতৃত্বের সুখ। এক মায়ের গর্ভধারণের যে সুখ কবির কবিতা লেখাও একই সুখ। দুজনেই জন্ম দেন। প্রাণ দেন। লালন করেন। আদর করেন। যত্ন নেন। সেই সন্তান যেমন তাঁর পিতার ঔরসের পরিচয় ও মর্যাদা বহন করে নিয়ে যায়। একজন কবির প্রথম শর্ত তাঁর কবিতা। তিনি হাজার ঝড় ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে কবিতা যাপন করেন। চরম যন্ত্রণায় তিনি আনন্দ উপভোগ করেন একটি কবিতার জন্ম দিয়ে। এক ঋতুমতী নারী নারীত্ব প্রাপ্তিলাভ করে যেভাবে অন্তঃসত্ত্বা হন, কবিও তেমনই কবিত্ব লাভ করেন। তখন বাহ্যিক কোনো স্বর – বিদ্বেষ – আস্ফালন – অপমান – যন্ত্রণা বা লাঞ্ছনা কোনোভাবেই তাকে স্পর্শ করতে পারে না। তাই কবি সাগ্রহে উচ্চস্বরে তীব্র প্রতিবাদে জানান, তিনি –

‘ওগো সদালাপী মিথ্যাচার/ভালো চাও তো প্রাণ নিয়ে পালাও!’ ‘

ঔরস – জয় গোস্বামী/ প্রকাশক – সুমন গুণ (বান্ধবনগরের কবিতা)/ মূল্য -৫০.০০

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *