Press "Enter" to skip to content

পাঠকের চোখে: নির্বাচিত কবিতা/ নিখিল পানডে

ভজন দত্ত

না, কোনো বোদ্ধা সমালোচক, মাতব্বর কবিতাপণ্ডিত হিসেবে এই প্রতিক্রিয়া লিখন নয়। আমি সেরকম কেউ নইও। একজন কবি তার সৃজনসম্ভার যখন কোনো একজন মানুষের কাছে পাঠান কোনোরকম প্রত্যাশা ছাড়াই, তখন, সেটা পাঠ করে কিছু না লিখলে অপরাধ হয়। হ্যাঁ, আমি অতি সাধারণ একজন পাঠক হিসেবে, পাঠকের চোখে যা দেখলাম, হৃদয় দিয়ে যা উপলব্ধি করলাম তারই সামান্য কিছু তুলে ধরলাম আমার মতো সাধারণ মানুষের কাছে। পড়ে দেখতে পারেন, হয়তো আপনার ভাবনার সঙ্গে মিলে গেলে মিলে যেতেও পারে দুয়েকটি বাক্য।
আসুন তবে গতানুগতিক গৌরচন্দ্রিকা সরিয়ে পড়া শুরু করা যাক —-

কবি নিখিল পানডে তাঁর আত্মকথনে জানিয়েছেন ১৯৮০তে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। তারপর! তারপর থেকে ২০২৩ অব্দি কবি থামেননি। মিছিলের শেষ হলেও তাঁর হাঁটা শেষ হয়নি, কবির কলম চলমান। তাঁর চেতনার আলোকে ছড়িয়ে ছড়িয়ে তিনি চলেছেন মহাকালের দিকে কিন্তু এখনো নবীন কিশোরের মতোই তাঁর কবিতা ও অণুগল্পে বিচরণ। লিটল ম্যাগাজিন উপত্যকায় সমাজ সচেতন সমাজবন্ধু নিখিল পানডে এক অতি পরিচিত নাম, সেখানেই তাঁর ‘সপ্রেম সহবাস’।

২০২৩-এর ৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছে কবির ‘নির্বাচিত কবিতা’। না, তিনি ‘সমগ্র’ কিংবা নির্বাচনের আগে ‘স্ব’ শব্দটি বসাননি। বইয়ের ভূমিকা নয়, ‘আত্মকথন’, সেখান থেকেই আমরা জানতে পারি, তাঁর ৬৩ ‘গ্রীষ্মবর্ষাবসন্ত’ দেখা জীবনের মধ্যে ( কবির জন্ম – ১৩৬৭, ২৫ বৈশাখ) ৪২ বছরের কাব্যজীবনে তিনি মোট ৩৮৩টি কবিতা লিখেছেন। ভাবা যায়! এরকম হিসেব কজন কবি রাখতে পারেন! সেই ৩৮৩-এর মধ্য থেকে ২৮০টি কবিতা তিনি এই ‘নির্বাচিত কবিতা’য় রেখেছেন ২৫৩টি পৃষ্ঠায়। যদিও কবি আত্মকথনে উল্লেখ করেছেন কবিতা আছে ২৭৫ টি। কিন্তু পাঠক হিসেবে পাঁচটি তো বেশিই পেলাম, এই আনন্দ। গ্রন্থটি মোট ৩৩৬ পৃষ্ঠার, ২৫৩ পৃষ্ঠা কবিতা, বাকি পৃষ্ঠাগুলিতে আছে বিভিন্ন সময়ে লেখা ও প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলির ভূমিকা এবং ঐ সকল কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে আলেচকদের আলোচনা, যা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। যা, এই বইটির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। কবিতা পাঠের শেষে কিংবা আগে এই আলোচনাগুলি পাঠককে সমৃদ্ধ করবে।

কাব্যস্রষ্টা কবি ও দার্শনিক নিখিল পানডে-কে সত্যিই যাঁরা জানতে চান, এমনকি কোনো গবেষক যদি তাঁকে বিষয় ভেবে গবেষণা করতে চান, তাহলে হলফ করে বলতে পারি, সময়ানুক্রমিক এবং বিজ্ঞানসম্মতভাবে তাঁরা আলোচ্য গ্রন্থটি থেকে গবেষণার উপাদান সহজেই পেয়ে যাবেন। যে কাজ করতে একজন গবেষককে পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করতে হয় তার অনেকখানিই পাওয়া যাবে গ্রন্থটি থেকে । থাক, সেকথা। আসুন আমরা বরং বইটি দেখি। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত। এক অলৌকিক ফুলগাছ, যার কাণ্ড মেরুন রঙের। হাল্কা মেরুনে জলরঙের প্রেক্ষাপটে ফুলগুলি সাদা ও হলুদ রঙের। সেটিকে বাদ দিয়ে দেখলে মনে হবে নির্বাচিত কবিতার ওপর ঠিক যেন একটি ছাতা! বিরাট-বিমূর্ততা নয়, সহজ সরল চিরন্তন ভাবনার প্রচ্ছদের সঙ্গে মানানসই নামাঙ্কন সামগ্রিক ভাবে প্রচ্ছদটিকে বিশেষ করে তুলেছে। যার ভেতর স্রষ্টার ভাবনা ও দর্শকের ভালো লাগা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এরপর বইয়ের বাঁধাই, কাগজ, মুদ্রণ সম্পর্কে বলি, প্রকাশক কোয়ালিটির সঙ্গে আপোষ করেননি। যতটা ভালোর প্রত্যাশা তার থেকেও ভালো।

কবির এই কাব্যগ্রন্থ থেকে পাঠক জানতে পারেন, ১৯৮৬তে প্রকাশিত হয় ‘মানুষের ভেতর মানুষ’ নামাঙ্কিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ । তারপর একে একে এসেছে ‘আমৃত্যু এই নির্বাসনে’ (১৯৯১) , ‘কোন্ পথে অসীমের বাড়ি’ (১৯৯৪), ‘ভুল ঠিকানা’ (১৯৯৮), ‘অমৃত নয় গরল’ (২০১০), ‘বর্ণমালার পাঠক্রম’ ( ২০১২), ‘অন্য ভুবন’ (২০১৩), ‘ভূর্জপত্রে আঁকিবুঁকি’ (২০১৮), এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে লেখা নির্বাচিত অগ্রন্থিত কবিতা।

এরপরও কবি লিখেছেন, ‘কিছুই হলো না এ জীবনে আর ‘ ! কাব্যগ্রন্থটির শেষ কবিতার শিরোনাম। কবিতায় তিনি বলেছেন,

“কিছুই তো হলো না এ জীবনে আর
ছিপ নিয়ে শুধুই বসে থাকা অনন্ত কোলাহলে
ভাবি, ভাবতেই থাকি কূল-কিনারা কিছুই
পাই না খুঁজে… “

পাঠক হিসাবে এখানে আমার কোনো কথা নেই। কি কথা বলা যায় তাই ভাবছি, এতকিছুর পরও একজন কবি যখন বলেন, লেখেন ‘কিছুই তো হলো না এ জীবনে আর’, তখন বলতে ইচ্ছে করে, এর বেশি কজনাই বা পায় পেয়েছে কি কেউ,শুধু শুধুই কি ওঠে শীর্ণ নদীর বুকে ঢেউ !

কবি যেভাবে তাঁর কাব্যগ্রন্থ থেকে কবিতা নির্বাচিত করে পরপর পাঠকের কাছে নিবেদনের অর্ঘ্য হিসেবে সাজিয়ে দিয়েছেন তেমনটি আর কজনাই বা পারেন! থাক সেকথাও। আসুন আমরা আরেকটু গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করি। কবি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মানুষের ভেতর মানুষ’ থেকে রেখেছেন মাত্র সাতটি কবিতা। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আমৃত্যু এই নির্বাসনে’ থেকে আছে কুড়িটি কবিতা। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কোন্ পথে অসীমের বাড়ি’ থেকে আছে ছাব্বিশটি কবিতা। চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘ভুল ঠিকানা’ থেকে আছে, একুশটি কবিতা। পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘অমৃত নয় গরল’ থেকে আছে, সাতান্নটি কবিতা। অনুরূপ ভাবে, ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ বর্ণমালার পাঠক্রম’ থেকে আছে সাতাশটি, সপ্তম কাব্যগ্রন্থ ‘অন্য ভুবন’ থেকে রয়েছে চৌদ্দটি, এবং অষ্টম কাব্যগ্রন্থ ‘ভূর্জপত্রে আঁকিবুঁকি’ থেকে আছে সাতষট্টিটি কবিতা এবং একচল্লিশটি অগ্রন্থিত সাম্প্রতিক সময়ে লেখা কবিতা দিয়ে তিনি সাজিয়েছেন নির্বাচিত কবিতা। কবির থেকেই ভাষা ঋণ নিয়ে বলি, সার্থক এই ‘আত্মযজ্ঞ’-এর আয়োজন।

নির্বাচিত কবিতায় কবির সৃজনকালটি মনে রাখা দরকার, ১৯৮৬ থেকে ২০২৩, প্রায় চারটি দশকের প্রথম তিন দশক এরাজ্যে বামফ্রন্টের শাসন। ধরে নেওয়া হয়েছিল, জমি আন্দোলনের শেষ। শিক্ষার আঙিনায় প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের আগমন, পাশফেল তুলে দেওয়া, প্রাথমিকে ইংরেজি তুলে দেওয়া, বিদ্যালয়ে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত ফি মকুব করা, কলকারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের দাপাদাপিতে শিল্পের নাভিশ্বাস, সরকারি আয়োজনে বাৎসরিক তিন-চারটি ধর্মঘট-হরতাল উৎসব, পার্টিনেতাদের ভয়ংকর দাপাদাপি থেকে কৃষিকে ভিত্তি করে শিল্পের ওপর গুরুত্ব আরোপ করার পর থেকেই ‘চক্রান্ত’ । তারপর আবার কারখানা তোলার জন্য অন্যরকম জমি আন্দোলন, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, মাওবাদীদের হাতে সাধারণ মানুষের নিত্যদিন খুন হওয়া, বিধানসভা ভাঙচুর, অশান্ত পাহাড়,জঙ্গল এবং শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ২০১১তে। যে বামফ্রন্ট মনে করত তারা অপরাজেয়, অপ্রতিহত তারাই নৈর্ব্যক্তিক ভোটে পরাজিত হলো। তারপর থেকে আরেক ইতিহাস। কত কেলেংকারি, সততার প্রতীক থেকে অনুপ্রেরণা হয়ে উদ্যোগে ভয়ংকর সব কেলেঙ্কারির প্রকাশিত। একজন কবি,লেখক যে সময়ের মধ্যে দিয়ে তার সৃজনশীলতার চর্চা করেন তা উঠে আসে অনেকখানি। ১৯৮৬-তে ‘সময় ভালো যাচ্ছে না’ শিরোনামে কবি লেখেন,

” আজকাল শিরদাঁড়া টান রেখে
পরপর কয়েকটা মাইলস্টোন পার হতে হলে
মানবিকতার টুঁটি ধরা চাই, আর চাই
মিথ্যার প্রতিশ্রুতি ঠাসা খাসা এক ঝাঁপি।” (পৃষ্ঠা – ২১)

পাঠক, এ যেন সেই সময়ের কবিতা, বামফ্রন্টের ন’বছরের রাজত্বের পরেও সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির হতাশা যেন ফুটে উঠেছে ঐ কটি পঙক্তিতে। আবার পড়ুন তাঁর লেখা থেকে কয়েকটি কবিতার উল্লেখ করলাম, যেখানে পরিবর্তন বোঝা যায়। নীরব যাত্রা (২১৬), ‘একটি অরাজনৈতিক কবিতা’(পৃষ্ঠা ২২১), ‘রাষ্ট্র যখন’ ( পৃষ্ঠা ২৩৭), ‘মৃত্যু পরব’ (পৃষ্ঠা ২৪৯)। যদি পড়েন তাঁর লেখা দীর্ঘ কবিতা ‘তাপবিদ্যুৎ কারখানা গ্রন্থিত যন্ত্রণা’ তবে সেইসময়ের রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থাটা বুঝতে পারবেন, কবি লিখেছেন,

“দুর্বিনীত জনেরা কেউ কেউ জোট বেঁধে
নবম নির্মীয়মান কারখানার ভেতর থেকে
মূল্যবান যন্ত্র সামগ্রী কিছু উধাও দিয়েছে করে
ম্যাজিকের মত, তার সাথে —
ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে রক্ষকের দল
…..
শ্রমিক ইউনিয়নের ভূমিকায় শ্রমিকেরা
দিকে দিকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, টাকার বিনিময়ে
বড় বড় কোম্পানির কাছে ইউনিয়নের স্বার্থ
জলাঞ্জলি দিয়ে টপমোস্ট নেতা কিছু
বিক্রি করেছে তাদের মাথা, টাকার বিনিময়ে
লোকাল শ্রমিক ছেড়ে ঢুকিয়েছে বাইরের লোক “
দুর্গাপুর স্টিল থার্মাল পাওয়ার স্টেশন তৈরির সময়কার,পরিবেশ, পরিস্থিতি, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অবস্থার কথা নিদারুণ ভাবে ধরা পড়েছে কবিতাটির প্রতিটি পঙক্তিতে।
কবিতার শেষ চারটি পঙক্তি এরকম —

“যে গ্রামের শ্মশানও দাহ হয়ে গেছে চিরতরে
ঐ আন্ডারটেক গভর্নমেন্ট ডিভিসির
— ডি এস টি পি এস
কারখানার — জ্বলন্ত ফার্নেসের তলে…

হায়! আমি আজ ছয় সপ্তাহ বেড রেস্টে আছি।”

কবিতা কি, কাকে বলে, কেমন তার ছন্দ এসব নিয়ে পৃথিবীর সকল পণ্ডিত ও সাধারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে অজস্র দ্বন্দ্ব ও ধন্দ। বেশি কিছু না, হাতে ছোঁয়ানাড়া ফোন থাকলে একটু গুগল ঘেঁটেই দেখতে পারেন। আমি সেসব কিছু বলছি না, সেসব বলার ‘ধক’-ও রাখি না। আমি শুধু জানি, আমার হৃদয়ে ধাক্কা পাওয়ার কথা, ভালো-মন্দ লাগার কথা। কবি যখন লেখেন,

প্রতি রাতে লুট হয় আমার স্বদেশ
আমি এক লুটেরা দেশের নাগরিক
হতভাগ্য কবি!
কবিতা-নীরব যাত্রা (পৃষ্ঠা ২১৬)— তখনও আমরা কি করে নীরব থাকি! তিনি আবার ‘স্লোগান যখন কবিতা হয়ে যায়’ কবিতায় লেখেন, প্রশ্ন করেন, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়েন, তখনও পাঠক চুপ করে পাতা উল্টে চলে যেতে পারেন অন্য একটি কবিতায়। কিন্তু মনে রয়ে যায় সেই চিরন্তন বিস্ময় ,
‘রাষ্ট্রের জিহবা কত ক্রোশ লম্বা!’

আমি তাই কবিতার বিশাল সমুদ্রে খুঁজে ফিরি সেই সকল উপলখণ্ড, পেলেই তাকে জড়িয়ে ধরে বাঁচি। কেন না, এ জীবনে বেঁচে থাকা কঠিনতর জেনেও আমরা বাঁচতে চাই। বাঁচতে বাঁচতে কবি নিখিল পানডের ‘নির্বাচিত কবিতা’ বইটি একটু একটু করে পড়েই না হয় বাঁচি, বিন্দাস কবিতায় বাঁচা কি ‘এরেই কয়’!

নির্বাচিত কবিতা / নিখিল পানডে / প্রকাশক – তুহিনা, কলকাতা -৬, মূল্য – ৪০০, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ৩৩৬

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *