Press "Enter" to skip to content

‘ বনবাসিনীর পত্র ‘ – পর্দা প্রথার সময়ের এই ভ্রমণ জার্নাল যেন বাঙালি হিন্দু নারীদের আরণ্যক ভ্রমণ

ধীমান ব্রহ্মচারী

ভ্রমণ শব্দটির মধ্যে মানুষের একটা চমৎকার গল্প সাজানো থাকে। কত স্মৃতি,কত ইতিহাস রয়ে সয়ে বসে সেই চলার পথের গল্পে। ১৩০৬ বঙ্গাব্দ থেকে ১৩১২ ধারাবাহিক একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিল বাঙালি নারীপ্রগতির এক আলোকবর্তিকা নাম বামাবোধিনী পত্রিকা। মূলত বঙ্গ নারীর পদচারণার কাহিনি শুরু হয়েছিল উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়। বইটির নাম বনবাসিনীর পত্র। সম্পাদনা করেছেন দময়ন্তী দাশগুপ্ত। প্রকাশ হয়েছে প্রতিক্ষণ থেকে।

বইটির ভূমিকায় লেখা হয়েছে, ‘…উনিশ শতকে বাঙালি মেয়েরা যখন গল্প-কবিতা- উপন্যাস লিখতে শুরু করেছেন, তখন বিলেতের জেন অস্টেন, ব্রন্টি বোনেদের মতোই তাঁদেরও লেখালেখির মূল বিষয়বস্তু ছিল ঘর এবং পারিপার্শ্বিক সমাজ। লেখাপড়া শিখলে মেয়েরা হয় চরিত্রহীনা নচেৎ বিধবা হবে- প্রবলভাবে পুরুষতান্ত্রিক সেকালের সমাজের এই বদ্ধমূল ধারণাতে চিড় ধরে।…’ এই ধরনের আলোচনা আমাদের বার বার বাংলা ও বাংলা সাহিত্যের বেশ কিছু সময় ও ব্যক্তিত্বদের কাজে নিয়ে যায়। বঙ্কিমচন্দ্র যেভাবে এই বৃহত্তর সমাজের নারীর অধিকার ও মর্যাদার কথা এবং তারও পাশাপাশি কিছুটা প্রচ্ছন্যভাবে নারীর অবচেতনের কথা তাঁর সাহিত্যে বার বার তুলেছেন যা পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্রের হাতে আরও পূর্ণতা পেয়েছে।

নারী স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ..’১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন এবং লর্ড বেন্টিঙ্কের উদ্যগে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ হয়েছিল বটে, কিন্তু বাংলায় বিধবাদের দুরবস্থার কোনও প্রতিকার হয়নি। পরিবারের মধ্যেই শারীরিক মানসিক নির্যাতন ছিল তাঁদের নিত্যসঙ্গী। কৌলীন্যপ্রথার শিকার এদের অধিকাংশই বিধবা হতেন নাবালিকা অবস্থায়, অনেকক্ষেত্রেই একেবারে শৈশবেই। পরবর্তী জীবনে পুরুষ আত্মীয় বা অভিভাবকস্থানীয়দের দ্বারা যৌন নিগ্রহ বা সামাজিকভাবে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও হত প্রায়শই। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অপরিসীম উদ্যোগে বিধবাদের পুনর্বিবাহ আইনত চালু হলেও তা বিশেষ প্রচলিত হয়নি সামাজিক প্রতিবন্ধকতায়।

সেকালের হিন্দু বিধবাদের একটা বড় অংশই কাশী-বৃন্দাবনে গিয়ে শিব অথবা কৃষ্ণের আরাধনায় দিন কাটাতেন। নিরন্তর ঈশ্বরকল্পনা ও সেবার মধ্য দিয়েই তাঁদের অবদমিত যৌনতাও কিছুটা প্রশমিত হত হয়তোবা। পার্বতীপতি শঙ্কর কিংবা লক্ষ্মীপ্রিয় নারায়ণ-এর শ্রীরাধিকাদয়িত গোপীবল্লভ কৃষ্ণাবতার ছিলেন তাঁদের প্রার্থিত সেই পরমপুরুষ।…’ মূলত এই একটি ঘটনা আরও কিছুটা হিন্দু বিধবাদের জন্য খাটে। ভ্রমণ কথাটা বা ভ্রমণের সঙ্গে যুক্ত মানুষ থেকে ব্যক্তি প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই আলাদা আলাদা স্বতন্ত্রতা আছে। এবং এই থাকাটাই স্বাভাবিক। ভারতবর্ষের অনন্য কিছু স্থান যেমন – মথুরা, বৃন্দাবন, কাশী এগুলো বহুকাল আগে থেকেই মানুষের ভ্রমণের এক সুখকর স্থান হিসেবেই বিবেচিত। বরঞ্চ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সব অঞ্চলের স্বাভাবিক কাঠামো ও প্রকৃতির সৌন্দর্য কোথাও কোথাও কমেছে।

বইটিতে আছে দশটি পর্ব। ১ম পর্ব শুরু হচ্ছে এভাবে –‘ এক বৃন্দাবনের মধ্যে ২৪টী বন আছে, তাহার মধ্যে ১২টা বন এবং ১২টা উপবন। প্রেমের পূর্ণ অবতার শ্রীশ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু এবং তাঁহার প্রিয় পারিষদগণ হইতে এই সমস্ত বন আবিষ্কৃত হয়। প্রতি বৎসর ভাদ্র মাসে অসংখ্য যাত্রী বনভ্রমণে বাহির হইয়া থাকেন। এই যাত্রায় ভরতপুরের রাজা বাহির হন বলিয়া এই বন ভ্রমণকে সাধারণ চলিত কথায় “রাজার বন ভ্রমণ” বলিয়া থাকে। রাজার বনযাত্রা ১৫ দিনের মধ্যেই সমাপ্ত হয়। এই বনের যাত্রীগণের অধিকাংশই সাধু বৈষ্ণব এবং কাঙ্গালী। এই যাত্রার ৬।৭ দিন পরে গোকুলবাসী গোঁসাইগণ নিজ নিজ শিষ্য সেবকগণ সমভিব্যাহারে আড়ম্বরের সহিত বন-যাত্রায় বাহির হইয়া থাকেন। এই যাত্রাকে চলিত কথায় ‘গোঁসাইয়ের’ বন ভ্রমণ বলা যায়।..’ পর্ব থেকে পর্বান্তরের বর্ণিত হওয়ার কাহিনি চমৎকার। বৃদাবনে শুধু মাত্র পৌঁছে তার কাহিনি বলা নয়,সেখানকার মানুষ,জীবন,জীবিকা,জাতি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ সবই এই বর্ণনায় অসাধারণ। একটু উল্লেখ করলে দেখা যাবে, ‘ … কিন্তু এক্ষণে কোন কোন স্থান ভগ্ন হইয়াছে এবং সেই সেই ভগ্ন ফাটলের মধ্যে মধ্যে জল-ঢুণ্ডিক প্রভৃতি সর্প বাস করিতে দেখা যায়। তথাচ সেই স্থলে বসিলেই কেমন একটা অপূর্ব্ব ভাবে হৃদয় মুগ্ধ হয়। কুণ্ডের অদূরে মহাত্মা ধ্রুবের তপস্যা স্থান আছে। এই স্থানটী বড়ই মনোরম বোধ হইল। মধ্যস্থলে মঞ্চের ন্যায় উচ্চ স্থান ও চারি দিক্ নানাবিধ পুষ্প, লতা, কণ্টকাদি বৃক্ষে পরিপূর্ণ।..’ পর্ব ছয়। বর্ণনা করা হয়েছে জ্যোতিপুর থেকে লাটাবনের যাত্রা। আসলে বর্ণনা বা কাহিনি ঠিক যে সময়ের মধ্যে লেখা বা বলা হচ্ছে,সেই সময় বাঙালি হিন্দুদের পর্দা প্রথার যে সম্পূর্ণ বিলুপ্তি হয়েছে এমনটা নয়। ‘…এই সময়ে নারীরা যখন ‘ঘোমটা খুলে’ বাইরে যেতে শুরু করলেন এবং অন্দরমহলের চৌকাঠের ‘লক্ষণরেখা’ ডিঙোনো সেই অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করে পত্রিকায় ছাপতেও দিলেন তা ছিল রীতিমতো বিপ্লব। কৃষ্ণভাবিনী দাস, প্রসন্নময়ী দেবী, স্বর্ণকুমারী দেবী, অবলা বসু, সরলা দেবীদের পাশাপাশি অপরিচিত যেসব ভ্রমণলেখিকারা সেদিন কলম ধরেছিলেন তাঁদের সেইসব রচনাও সামগ্রিকভাবে সমাজে নারীর অবস্থান বদলের সূচনারই সাক্ষ্য দেয়।..’

আসলে এই ভ্রমণ কাহিনি নিছক ভ্রমণের কাহিনি নয়। বাংলার সেই সমস্ত নারীরাও একটা সাহস পেয়েছেন এই কাহিনির মধ্যে দিয়ে বেরাতে যাওয়ার এবং অবশ্যই যাঁরা সেই সময় অথবা তারওপর প্রবাসে পা বাড়িয়েছেন হয়তো কেউ মথুরা,কেউ বৃন্দাবন বা কেউ কাশীবাসী হয়েছেন। পর্ব নয় ‘ এ যেমন বর্ণিত হয়েছে কিশোরীকুণ্ড, জটিলাকুণ্ড, পারুলগঙ্গা এবং শ্রী শ্রী রাধকৃষ্ণ বিগ্রহ। উত্তর ভারতের এতো সব সু প্রচিনঞ্চল যেখানে নানা কাজে ও সেবায় সাধারণ বাঙালি হিন্দুরা থাকতেন বা যেতেন তাদের কাছে এই যাওয়ার যেমন বিরাট একটা লোকচক্ষুর বিপরীতে দাঁড়িয়ে থেকে অবস্থানের মতো,তেমনি আবার ঠিক এই সময়ের বাংলার সীমানা শুধু নয়, হিন্দু বাঙালির বাইরে বেরোনো এই যে একটা রৈ রৈ ব্যাপার — এরই বিপরীতে দাঁড়িয়ে এই ভ্রমণকাহিনি পাঠকের কাছে যেমন এক ঐতিহাসিক দলিল, অন্যদিকে যাত্রা পথের কাহিনি যেভাবে আন্তরিকতায় এবং ভ্রমণ কালে লেখিকার সঙ্গে সেই সমস্ত স্থানের মানুষজন বা গ্রামবাসীর কথাবার্তা – পরিচয় পর্ব, আবার কোথাও কোনো গ্রামে চাষিদের ফসল চাষ না হওয়ায় তাদের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটেছে — এই ঘটনা লেখিকার মনকে পীড়ন করেছে। তাই তিনি তাঁর মধুবন থেকে বৃন্দাবন যাত্রার পরিধিতে তাঁদের ওপর ভগবান কৃষ্ণের ভক্তিও বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ অসাধারণ একটি বই যেখানে উনিশ শতকের – ‘ সংবাদ প্রভাকর, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, বামাবোধিনী পত্রিকা, ভারতী ইত্যাদি সেকালের নানান সাময়িকপত্রেই বিভিন্নজনের ভ্রমণকাহিনি প্রকাশিত হত চিঠির আদলে। ঈশ্বর গুপ্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বর্ণকুমারী দেবীর মতো নামকরা লেখক-লেখিকাদের পাশাপাশি প্রকাশিত হত অনাম্নীদের পত্রাকারে লিখিত ভ্রমণকাহিনিও। এর কিছুকাল আগে বামাবোধিনী পত্রিকা-তেই প্রকাশিত আরেক বঙ্গনারীর ভ্রমণকাহিনি ‘বিদেশবাসিনীর পত্র’-এ লেখিকার কাছে ছোটনাগপুরের ‘পচম্বা’ যাওয়াই ছিল বিদেশ ভ্রমণ। সেইরকমই ‘বনবাসিনীর’ কাছে বৃন্দাবনের আশেপাশের বনগুলিতে ভ্রমণই হয়ে উঠেছিল বিশেষ এক যাত্রা।’ সম্পাদক তাঁর সুচিন্তিত মতামত ও প্রচুর তথ্যের মাধ্যমে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে সেই উনিশ শতকের সমাজ কালের এমন এক অনামী মহিলা লেখিকার এক জীবন্ত জার্নাল আমাদের উপহার দিচ্ছেন, এর থেকে পাঠক হিসেবে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে।

বনবাসিনীর পত্র ( সম্পা: দময়ন্তী দাশগুপ্ত) / প্রতিক্ষণ প্রকাশনা / মূল্য ১২৫.০০

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *