যে শব্দ ব্রহ্ম থেকে উৎপন্ন হয়ে আমাদের মনকে আহুতি দেয় নৈসর্গিক আহ্বানে। সেই শব্দ কখনও ‘হাঁ ‘-এর মত করে আমাদের অভিমানকে করে মায়াবী। লিখলেন ধীমান ব্রহ্মচারী
এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কবি অয়ন চৌধুরী’র অসামান্য একটি কবিতার বই নাম “হাঁ ” প্রকাশ পেয়েছে ধানসিড়ি প্রকাশনা থেকে। প্রায় ৭২ টি কবিতা নিয়ে তৈরি হয়েছে এই বইটি। জীবন অস্তিত্ব এবং সমাজের থেকে বিপ্লবের প্রতিবাদের স্পৃহা যেন এই কবিতার বইকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দেয়। বইটি সম্পর্কে বলা আছে এই বইয়ের কবিতাগুলি আমাদের জীবন দর্শনের এক আশ্চর্য মায়ার আবহাওয়া তৈরি করেছে। অর্থাৎ এই বইয়ের কবিতাগুলি যে শুধুমাত্র কাব্যিক চেতনায় দীপ্ত তা কিন্তু নয়। এই কবিতাগুলির মধ্যে রয়েছে আমাদের জীবনের আদর্শের এবং জীবনের নানা দর্শনের ফেলে আসা বা গ্রহণীয় বিশেষ দিক। এ কথা না বললেই নয় একজন কবি মাত্রই শিল্পী আর শিল্পী মাত্রই সমাজের প্রতি দেশের প্রতি তাঁর দেখার চোখ সম্পূর্ণই ভিন্ন ধর্মী হওয়াই স্বাভাবিক যে সাধারণ চোখ দিয়ে আমরা বস্তু ও পার্থিব জগতের সব কিছুকে খুব সহজেই উপলব্ধি করতে পারি, শিল্পী ও ঠিক এভাবেই এবং যদিও এই দেখার গভীরতা ও বোধের দার্শনিকতা অনেকাংশে অনেকটাই সুদূরপ্রসারী। বইটির কবিতাগুলি পড়তে পড়তে এক এক সময় মস্তিষ্ক ভার হয়ে আসে, কত গভীর দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যালোচনা না থাকলে এই ধরনের বই লেখা সম্ভব নয়। জীবনকে দেখা ও দর্শনের সঙ্গে তাকে পর্যবেক্ষণ করা খুব সাধারণ কাজ নয় বলেই ধরে নিতে পারি। বইটির ১৩ নম্বর কবিতা “মুহূর্ত বিপ্লব “। এই কবিতাটি পুরোটা এখানে তুলে আনি। –
মুহূর্ত-বিপ্লব

১
সে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠে বলেছিল কেউ মাথায় হাত রেখে ডেকেছে। তারপর পোড়া গন্ধ। বিষাক্ত ধোঁয়া, যেন রক্ত পুড়ে যাচ্ছে কোথাও, যেন খেতভর্তি শস্য ছাই হয়ে গেল। আগুনে আগুন লেগে ঝলসে উঠল মাঠ। তবু সে কাঁদেনি, তবু সে বুক দিয়ে আগলে রাখতে চেয়েছে এক-একটি দানার ভিতরের নির্ঘুম ভয়টুকু।
রাস্তায় নেমে এসেছে শাসকের কামান। বুক দিয়ে রুখে দেয় গোলা-গুলি যারা, তারা আজ আর ক্ষুধার্ত নয়। তাদের বাঁ-পায়ের গোড়ালির কাছে ক্ষত ও উপাসনা লেগে আছে। আমাদের বিশ্বাসের মতো আরও যা কিছু বিশ্বাসঘাতক…
একজন মানুষ হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠে দুঃস্বপ্নের মতো এই যুদ্ধ দেখেছিল। তার ভিতর কাঁপছে। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে থাকা শিশুর মুখের মতো নিষ্কলঙ্ক এই অন্ধকার কেটে কেটে এগিয়ে আসছে আগুন। তার ঘর, তার যুবতি বউ ও এই সামান্য শিশুসহ সে এই অন্ধকারে পড়ে গেছে। একটা কয়েকশো ফুট নীচু টানেল যেন। গলা বাড়িয়ে চিৎকার করলেও আগুনের শোঁ শোঁ শব্দ তার চিৎকারের উপর এসে আছড়ে পড়ছে। ফাটিয়ে দিচ্ছে তার দেহের বিকার। মুখ ভেঙে তুলে আনছে রক্ত…
কবিতার প্রথম লাইনেই খুব স্পষ্টভাবেই কবি বা শিল্পীর হঠাৎ যেন ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে কারোর হাত যখন তার মাথার ওপর রাখা হচ্ছে। এবং তারপরেই দেখতে পাওয়া যায় চারিদিকে ধোঁয়াটে গন্ধ অর্থাৎ পুড়ে যাওয়ার গন্ধ। এই গন্ধে মিলেমিশে আছে পোড়া রক্ত, মিলেমিশে আছে খেদ ভর্তি পোড়া শস্য, মিলেমিশে আছে আগুনে পুড়ে যাওয়া ঝলসানো মাঠ — এতকিছু উপেক্ষা করেও একটি প্রাণ অর্থাৎ একজন শিল্পীর চোখে ঘুম নেই। আর এই ঘুম না আসার কারণ সম্প্রতি এই বিষ বাষ্প মিশে গেছে মহানগর বা শহরের প্রতিটি বাতাসের অণুকনায়। এখানে একজন জনৈক ব্যক্তি বা মানুষকে কবিতায় নিয়ে এসেছেন কবি স্বয়ং। আর এই কবিতার সামগ্রিক প্রেক্ষাপট সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি জন্ আন্দোলন অথবা গণবিপ্লব অথবা ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। তাই যুদ্ধ পরবর্তী সমাজ এবং সমাজের প্রতিটি মানুষ থেকে মহিলা অর্থাৎ নরনারী প্রত্যেকেই যেন দিশেহারা। কিভাবে মিলে উঠতে পারে তাদের চেতনা, তাদের পুরনো চিন্তা অথবা তাদের ফেলে আসা জীবন ? এই কবিতায় খুব সচেতন ভাবেই আক্রমণাত্মক ভঙ্গি উপেক্ষা করেই কবি কিন্তু সদর্পে প্রতিটি মানুষের মনের ভেতরে ধাক্কা দিয়ে নতুন প্রশ্ন জন্ম দিয়েছেন। এবং এই প্রশ্ন যে শুধুমাত্র সমাজে বেঁচে থাকা মানুষের প্রতি তা কিন্তু নয়। এই প্রশ্ন চিরন্তনকালের বৈপ্লবিক নিয়ম, অথবা এ প্রশ্ন যুগ যুগ ধরে আসা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের বিরুদ্ধে। একের পর এক যুদ্ধের দামামা কবি মন কে করে যেন বিচলিত। কবিতার শরীর ছুঁয়ে কবি শপথ করতে চান তাঁর উপলব্ধি এবং তাঁর জীবন দর্শনের প্রাপ্য ইতিহাস। দীর্ঘদিন ব্যাপী সৃষ্টির রহস্য থেকে পৃথিবীর জন্ম সর্বত্রই হয়েছে সংগ্রাম থেকে বিপ্লব। আর এই বিপ্লব আজ নয় সভ্য সমাজ নির্মাণেরও প্রথম এবং সর্বশেষ পন্থা হয়েই টিকে এসেছে এই পৃথিবীর বুকে। অথচ শিশুসুলভ ও শান্ত এবং সুকমল চিন্তা যুক্ত একজন শিল্পী মনের বাস্তবিক যে দিক আমরা প্রতিটি মুহূর্তে উপলব্ধি করতে পারি যে, তিনি পারেন না কখনো সময় রক্তের ফোয়ারা দেখতে। তিনি চান না এক জাতি অথবা সমাজ গোষ্ঠীর মধ্যে তাদের রক্তক্ষয়ী লড়াই। তিনি শুধু চান সৌভাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যবোধ নিয়েই একে অপরের সঙ্গে গলা কোলাকুলি করছে। অথচ তিনি যখন দেখেন হাজার বিপ্লবের প্রতিবাদের সামনে চিৎকার ও আত্মচিৎকার শুধুমাত্র বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ কোথাও যেন প্রতিরোধহীন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে না থাকে প্রতিবাদের ভাষা না থাকে পর্যাপ্ত প্রতিহত করার সাহস। তাই এই কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয় সাহসের এক সার্বিক ও সমষ্টি প্রয়াস যেকোনো সাধারণ মানুষের চিন্তাকে করবে আরো দৃঢ়। প্রথম পর্বে এই কবিতা যেভাবে একটি পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছে কবিতাটির দ্বিতীয় পর্বে কবির চিন্তার ক্লাইম্যাক্স অসাধারণ বাঙ্গময়তায় শেষ হয়েছে। যেকোনো ঘটনা বা ইতিহাসের যেমন একটি সূচনা পর্ব থাকে তেমনি থাকে তার পরবর্তী স্থিত পর্ব। এই কবিতার দ্বিতীয় পর্বটিকে স্থিত পর্ব বলেই চিহ্নিত করব। কারণ একদিকে বিপ্লব ও বিদ্রোহের ঘোষণা যে পর্বে কবি করেছেন এই পর্বে এসে কবি হয়েছেন স্তিমিত স্থির এবং শান্ত। এবং এই পর্বে কিন্তু কবি সাধারণ মানুষের জন্য একবার ভবিতব্য কে সামনাসামনি প্রস্তুত করেছেন। তাই কবি সরাসরি কিছু কথা এখানে তুলেছেন :-
” তোমাকে যে মায়ের আঁচল আগলে রেখেছিল নিজের চারপাশে, তাকে তুমি যদি ছিন্ন করে ফ্যালো তবু এ মাটি কেঁপে উঠবে না আর। সে তার সমস্ত ভালোবাসা জলের সমীপে নিমগ্ন ঋষির মতো নামিয়ে এসেছে। তার চোখ, উরু, নাভি ও যোনির কাছে সমস্ত ঘাস আজ মৃত কণ্টক, ধারালো অস্ত্রের সূচ্যগ্র এসো হাত রাখো, ক্ষতবিক্ষত হও, নিজেকে কুপিয়ে কুপিয়ে মারো শেষ বিন্দু নিঃশ্বাসের আগে নিজেরই রক্তে নিজের প্রচ্ছায়ার সৎকার করে ফ্যালোতবু এই নীরবতা আজ অন্তিম রহস্যের গণ্ডি পেরিয়ে আরও ঋজু হয়ে উঠবে তবু কোমলতা আর দুর্বল হবে না এই মুহূর্ত-বিপ্লবে…” এই নীরবতা নিয়েই কবি চেষ্টা করেছেন রহস্যের গণ্ডি পেরিয়ে যেতে। এই বইয়ের আরো একটি “কবিতা মৃত মানুষের মন ও সাদা ফুল “। এই বইয়ের প্রতিটি কবিতায় পড়তে গেলে নতজানু হয়ে যেতে হয়। অসাধারণ শব্দচয়ন, অভাবনীয় বিষয় ভাবনা, তীক্ষ্ণ প্রশ্ন সবকিছুই প্রতিটি কবিতাকে করেছে স্বতন্ত্র। সারা বইয়ের মধ্যেই প্রতিটি কবিতার মধ্যে যেন একটি অদৃশ্য সুতো দিয়ে প্রত্যেকটি কবিতাকে জুড়ে দেয়া হয়েছে। যে কবিতাকে প্রতিস্পর্ধী করে আমরা এগিয়ে যেতে পারি বৃহত্তর লক্ষ্যে, সেই কবিতার নির্মাণ কবি করেছেন একটু একটু করে তাঁর শ্লাঘা ও চেতনাবোধ দিয়ে। তাই বিপ্লবের সঙ্গে তিনি সম্ভাবমিকে যুক্ত করেছেন খুব সাধারণ ভাবেই। উল্লেখিত কবিতাটি এখানে এ প্রসঙ্গে একটু বলে ফেলি –
“মৃত মানুষের মন ও সাদা ফুল”
এ অন্ধকারটুকুও কেটে যাবে একদিন লেবুপাতায় উড়ে এসে বসবে জোনাকি আলো পিণ্ড তার নামিয়ে এসেছি ঘাটে, মৃত মানুষের মন শান্ত করতে মন্ত্রোচ্চারণের মিথ্যে খেলায় মেতেছি। সামান্য অস্থিভস্ম ছাড়া আর কিছু বাকি নেই, আর কোনো মন, দেহ বা সমন এ বিশ্বচরাচরের কোথাও লেগে নেই-এই সত্যটুকু জেনে গেছি বলেআজ এতখানি শূন্যগর্ভ মেঘ ভেঙে পড়ল বাড়ির উঠোনে- শ্বেতচন্দন, তুলসীপাতার নরম স্পর্শ সে ছুঁতে পারেনি। প্লাস্টিকে মুড়ে দেহ চলেগেছে দূরে। এই মাটি তার শেষ ঘ্রাণটুকু পেল না বলে এখনও চোখেমুখে শোক আগলে রেখেছে রাত্রি নিবিড় হল, নিভৃতবাসে দু-একটি সাদা ফুল অশ্রুর মতো ফুটে আছে!–
বইটির সামগ্রিক কবিতাগুলি পরপর পড়লে যেকোনো পাঠক একটা জার্নি কল্পনা করতে পারবেন। এই কবিতা খুব সহজেই আমাদের মন্ত উচ্চারণের মতো একটি স্বতন্ত্র স্বর নির্মাণ করতে সহযোগিতা করে। ঘটনার পর ঘটনা, এবং দৃশ্যকে যেভাবে নির্মাণ করেছেন কবি, তা সত্যি অংশীকার্য। এই কবিতায় কবির স্বাভাবিক ও স্বতন্ত্র স্বর শোনা যায়। একটি নিস্তেজ মৃতদেহ যেভাবে ফুলের স্পর্শে প্রাপ্তি লাভ করে স্বর্গের অথবা একটি মৃতদেহ যে দেহ কিনা মৃত্যুর পর পঞ্চভূত জিম্মায় বিলীন হয়ে যায় অথবা একটি মৃতদেহ যার না আছে স্বর না আছে স্পন্দন, আছে শুধুমাত্র তার বাহ্যিক দেহ। এই দেহের স্পর্শেই পড়ে থাকে কবির নিজস্ব চেতনা ও আদর্শ। এই মৃত মানুষের মন এবং একটি সাদা ফুল একই মুদ্রার দুই পিঠ। এক দেহ শান্ত নিস্তেজ ও শ্বেতশুভ্র বস্ত্র পরিহিত ঘুমন্ত মানুষ আর একইভাবে বৃক্ষ-প্রাণ থেকে পড়ে যাওয়া অথবা বৃক্ষ-প্রাণে গজিয়ে ওঠা একটি সাদা ফুল। দুটি তার কোমল ও সুগন্ধ দিয়ে জয় করতে পারে জীবিত মানুষের স্পৃহা ও স্পর্ধা। তাই এই কবিতাগুলিতে যেন বহু যুগ ধরে মৃতের মধ্যে মননের, জীবিতর মধ্যে প্রাণের, অন্ধকারের মধ্যে আলোর এবং মৃতের মধ্যে জীবনের সন্ধিহান খুব সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়।
সারা বইটির বেশ কিছু কবিতা যেমন- কারফিউ, জেহাদ, শব্দের নিয়তি, ইনসমনিয়া, ধোঁয়ার পৃথিবী, তখন শ্রাবণ মাস, সার্কাস জীবন – প্রভৃতি কবিতাগুলি যেন আমাদের প্রেম ও জীবন দর্শনের প্রধান আখড়া হয়ে দাঁড়ায়। যে জীবনকে উপেক্ষা করে ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় আমাদের সত্তা, ঠিক সেই সত্তাকেই কবি তার সুচিন্তিত এবং কবিশক্তির মধ্যে দিয়ে আমাদের মস্তিষ্কের ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে চান চেতনা প্রবাহ। এই প্রবাহের মধ্যেই তাকে আমাদের নিয়তিশক্তি এবং জীবন শক্তির দুই উপাদান। আমরা যখন নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম অথবা একে অপরের পেছনে ভোজালি ধরে নিতে পারি, আবার মৃত লাশের পোড়া গন্ধ নিয়ে যে বিজয় উল্লাস করতে করতে আমরা পাড়ি দি আরম্বরপূর্ণ সামাজিকতায়, কবি এই দুইয়ের দ্বন্দ্বের বিপরীতেই আমাদের অবস্থানের কার্যকারণ বলতে পারেন নির্দ্বিধায়। তাই আমরা সাধারণ পাঠক যখন এই বইটি পাঠ করি তখন আমাদের মনের মধ্যে চেতন ও অবচেতনের খেলা চলতে থাকে সুক্ষ্মভাবে। আমরা বুঝে নিতে পারি আমাদের জীবন অলিন্দের স্পন্দন। আমরা শিখে নিতে পারি আগামী যুদ্ধের প্রস্তুতি। তাই শব্দের ঝংকার ও নিরবিচ্ছিন্ন আত্মচিৎকার আমাদের প্রকৃত জীবন দর্শন চিনিয়ে দিতে ভুল করে না। এই বই তারই যেন বাস্তব দলিল।
হাঁ / অয়ন চৌধুরী/ ধানসিড়ি প্রকাশনা / মূল্য ১৭৫.০০




Be First to Comment