ধীমান ব্রহ্মচারীর শেষ পান্ডুলিপি দেওয়া থাক, মিশর সভ্যতাকে কাব্যগ্রন্থ পড়ে ফেললেন দেশিক হাজরা
মানব জগতের এক চেনা দৃশ্য গুলির মধ্যে ঘটে যাওয়া প্রতিদিনের ঘটনায় ক্ষীন হয়ে থাকা লম্ফ কিংবা প্রদীপ ছেড়ে যে আলোর সভ্যতার দিকে হেঁটে চলেছি, নিজের উজ্জ্বলতা এবং প্রফুল্লের চাহিদা পূরণের আশায় ইতিহাসকে শুধুমাত্র বইয়ের পাতায় লুকিয়ে রাখার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ভুলে যাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের আংশিক অবনতির কারণ। একটি অংশে স্পষ্ট এই পরিচয়গুলি ধরে শুরু হচ্ছে এই কবিতা সিরিজটি “শেষ পান্ডুলিপি দেয়া থাক, মিশর সভ্যতা কে”।
এই কবিতার বইটি যে একটি সম্পূর্ণ সিরিজ নিয়ে তৈরি, তা মনে করার একটি কারন হলো, এমন কিছু এক, দু’লাইনের কবিতা এই বইয়ে খুঁজে পেয়েছি যেগুলির সংযোগস্থল হিসেবে কাজ করেছে দুটি কবিতার মধ্যস্থলে, এই পদ্ধতি একটি সিরিজকে সম্পূর্ণরূপে বেঁধে রাখতে ব্যবহার করা হয়, একক রূপে তেমন গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বহন না করলেও সম্পূর্ন সিরিজটির প্রতি বড় আকারের মূল্যবোধ বহন করে শেষ পর্যন্ত, এবং শেষেই আত্মসমর্পণ।
“কেউ কথা বলবেন না
নিস্তব্ধতা সারা রাত ধরে এখানে পাহাড়া দেয়”(পৃ:১৫)
প্রচ্ছদ এঁকেছেন তনময় দাশগুপ্ত, খুব সাধারণ প্রচ্ছদ ক্যালিগ্রাফি দিয়ে শুধুমাত্র বইটির নামকরণ টিকেই মান্যতা দেয়া হয়েছে বলে মনে হয়। প্রতিটি কবিতাকে জীবন দিয়ে আরো ভাবান্বিত ও উজ্জ্বল করে তুলেছেন অ্যাবস্ট্রাক্ট অলংকারে মনীষা সাহা। মানব সভ্যতার এক করুণ দৃশ্য এই কাব্যগ্রন্থটি বহন করে চলেছে তা বুঝে নিতে এতটুকু দ্বিধা হয়নি। কবির সেই অনুভূতি ও আবেগ তার কবিতা বহন করে চলেছে অপার সততার সাথে।
তিনি লিখছেন লিখেছেন…
“চোখে ছিল ঘুম
রক্ত প্রবাহ ছিল শিরায় শিরায়,
অন্ধকার পেরিয়ে যে চোখ সূর্যাস্তের আলোয় উঠছিল জ্বলে,
সে চোখ আজও স্থির,
তছনছ হয়েছে সময়ের বাঁক, কেউ ফিরে আসেনি সেখানে
যাদের হাত রিক্তস্বপ্নালু চোখে ছিল বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন,
এখন যারা হাতিয়ার করেছে ভাষা,
তারা আজ শুনশান রাস্তার মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে গুণছে সময়ের মাফকাঠি
স্তব্ধতায় ছিল যে অস্থির চোখ, যে চোখে ছিল হাজার রহস্য, রহস্যের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে হাঁপিয়ে ওঠে ক্ষীণ রহস্যভেদ…সে কাল গেছে ঘুচে, সে বাঁক আজ অন্ধকার, চারিদিকে চোখ ঘুরছে, শিকার হচ্ছে শিকারীর হাতে, অন্ধকার অন্ধকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে করছে টেবিল বৈঠক-
জঙ্গলে নেমেছে বৃষ্টি,
চারিদিকে অবিরাম বৃষ্টি,
বৃষ্টির জলে ভেসে যাচ্ছে মাটির ওপর পরে থাকা রক্ত,
ভেসে যাচ্ছে এই স্নিগ্ধ মাটির গন্ধ,
শুকনো পাতা শুকনো ডাল-পালা
শুকনো গুঁড়ির ওপর ঘরবাসি উইপোকার দল,”(পৃ:৭…)
বন্দুকের ব্যবহার না শিখেই যে সভ্যতা নিজের পতন লুকিয়ে রাখেছিলো লোভ, লালসা, অহংকারের চিহ্নে। তার থেকে আজও কী শিখিনি কিছু! এখন তো বন্দুকের ব্যবহার শিখেছি অথবা তার থেকেও ধারালো অস্ত্রের মোক্ষম প্রয়োগ, প্রয়োজনে ব্যবহার করেছি। তবুও কি সভ্যতার উন্নতির উন্নয়ন করতে পারি। এই কাব্যগ্রন্থ জুড়ে যে প্রশ্নটি বারবার সামনে এসেছে তা হল— মানুষের ক্ষয় কি আসল সভ্যতার উন্নতি?
পরিবেশ আমাদের নিত্য দিনের প্রয়োজনীয়তা, তা ভুলে যে অট্টালিকার ওপর বসে বইয়ের পাতায় ইতিহাস পড়তে পড়তে নখের ডগে উপোকা মেরে ফেলার মজা পাই। এই সময় কে সভ্যতার আর এক পতনের শুরু বলে মনে করছেন কবি। কবি, কবিতাটি শেষ করলেন…
… ক্লান্তিহীন শ্রম দিয়েছে যুদ্ধের মাদক
লাশের বিছানা বস্তুত হচ্ছে থেকে থেকে
আজাদ প্রখরির লাঠির শব্দ দিয়ে জানান
রক্তের ক্ষরণ হোক”(পৃ: …৯)
অদ্ভুত এক শ্রমের কথা বলছেন কবি। ক্লান্তিহীন শ্রম” এতকাল ধরে জেনেছি সমস্ত শ্রম ক্লান্তি ঢেকে আনে। এই শ্রম’ শব্দটি কে, কিভাবে কবি বোঝাতে চেয়েছেন! যে শ্রম শুধু পরিচালিত করে! যার দ্বারা পরিচালিত হয় একটি ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত সমাজ। গড়ে ওঠে এক শ্রেণী যাকে যাকে শেখানো হয় শুধুমাত্র অর্থের মাধুর্যতা। অর্থের কুমির হয়ে ওঠে, যা পদে পদে এই 2024 এ দাঁড়িয়ে দেখতে পাই। মানব সভ্যতার ইতিহাসে পরিবেশের প্রতি দুর্ব্যবহার নতুন নয়, অনেক মহত্বের উবাচ পথের ধুলোয় পড়ে থাকে তবু বদলায় না অথবা বদলানো অভ্যাস থেকে অনেক আগেই সরে এসেছি এমন দুর্বল সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছি যার প্রয়োজন এই পৃথিবীতে নেই তাই পৃথিবী ফিরিয়ে দিয়েছিলো দু’হাজার উনিশ-কুড়ি সাল। এই সময়কাল কে কবি লিখছেন …
“পিছন ফিরে যদি তাকাই
দেখি হাজার হাজার মানুষের সারি
এরা সবাই মৃত।
জানা গেছে
এক ভয়ানক মহামারী এদের প্রাণ কেড়েছে,
এখন শুধুই মৌনতা,
চোখে চোখে ভয় আর থেকে থেকে কোণায় জমছে জল।” (পৃ:৯)
তবু কী থেমেছি, কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে ভেবে দেখেছি! বহন করে এগিয়ে নিয়ে যাব এক সভ্যতা কে পেছনে ফেলে আর এক সভ্যতার দিকে হেঁটে যাওয়ার আগে। এই সমস্ত কিছু আঁকড়ে এক ভয়ংকর চিত্র কবি লিখছেন এক অপেক্ষার কথা। লিখছেন—
“এখন মানুষই মানুষের মাংস খাবার অপেক্ষায়
রাষ্ট্র দিয়েছে আদেশ, বলেছে—
বাঁচবেন তবে একটি শর্তে, ‘সারাদেশে দেওয়া হচ্ছে তালা’
শুরু হবে কারফিউ
তারপর দেওয়া হবে ঘরবন্দির নির্দেশিকা
মারণ মহামারী কেড়ে নেবে আমাদের সব
স্থবির হয়ে পড়ে থাকবে মানুষ বিরাট শহরের ফুটপাত জুড়ে, কালের নিয়ম মেনে যারা বেঁচে যাবে, তারা কেউ ছোঁবেনা দেখবেনা মারাবেনা,
নিথর লাশের চোখ নিষ্পলক হয়ে থাকবে মহাকালের দিকে…”
(পৃ: ৯-১১)
পাঠক প্রিয় কাব্যগ্রন্থ যেন একটি ধোঁয়া ভরা কুয়ার মত, পাঠক তাঁর নিজ দর্শন তাঁর অস্থিরতাকে বারবার বালতি ফেলে কুয়ো থেকে তুলে নেয় নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী। এই চঞ্চল প্রক্রিয়া যে কাব্যগ্রন্থ যত বেশি বার ধরে রাখতে পারে তাই কালজয়ীতে রূপান্তরিত হয়। কবিতা যে ইতিহাস ধরে রাখে না এই বইটি পড়ার পর আমি মনে করি না কবিতা যুগ যুগ ধরে বয়ে নিয়ে চলে একটি সময় কাল মুহূর্ত। যা কবি দেখে আসে। চলে যাওয়া কালের ভেতর। যার দর্শন আগামীকালকে বর্ণিত করে নানা উবাচ এর মাধ্যমে অথবা ছাপিয়ে যায় ভবিষ্যৎ বাণী।
কাব্যগ্রন্থটি পড়তে পড়তে মনে হয়েছে কবি শুধুমাত্র মিশর সভ্যতাকে একটি উন্নত সভ্যতা হিসেবে ধরে নেয়, তারপর বারবার আধুনিক থেকে আধুনিক হয়ে উঠেছি। কিন্তু একটি উন্নত সভ্যতা তৈরি করতে পারিনি। শুধু মাত্র অর্থ ও ক্ষমতা নিয়ে এই আধুনিকতা কতদূর পর্যন্ত চলবে তা নিয়ে চিন্তা কবিতার ভেতর লক্ষ্য করা যায়। কবিদের মধ্যে রাত একটি স্বপ্নময় দৃশ্য কালো সৌন্দর্যে ভরা অম্লান ভাবনার প্রদর্শনী। যত রাত বাড়ে তত এই প্রদর্শনীর প্রভাব কবির ভাবনায় ঢুকে পড়ে এবং উজ্জ্বলতা ছাপিয়ে যায়। এখানেও ঠিক তাই হয়েছে শহরের আদব কায়দায় যে রাত দেখতে অভ্যস্ত, সেই রাত কবি বিষন্ন ভাবে দেখছেন। ভুরু কুঁচকানো বিরক্তিকর আবহাওয়া। এক জায়গায় লিখেছেন —
“রাত অনেক হয়েছে
আমি তোমার কথা আর ভাবছি না
আমি ফিরে যাচ্ছি একটা যুদ্ধের রণক্ষেত্রে
যেখানে রাজা অইদিপাউস হেরে গেছে- দেবী অ্যাপেলো তাকে নির্বাসন দিয়েছেন- রাজ্য চ্যুত রাজা হারিয়েছে সব
আমি তাকেই আমার ক্যাবের হীরো বানিয়েছি
এবার যুদ্ধ হবে রাজ রাস্তায় এখনকার কালে- বাতাসে বারুদের গন্ধ আর নিশানায় থাকবে আমার সাইক্লোপসরা”(পৃ:২১)
নাম হীন এই দীর্ঘ কবিতাটির মতই, রাত যেন আরও বেশি দীর্ঘ
হতে চলেছে কবির কাছে তার চিন্তা ভাবনার বাঁদ ভেঙ্গে কোন এক প্রবাসীর দোরগোড়ার কড়া নাড়ে। সেখানেই তার জীবনের যত ভোরের অরাজকতার বাস, এখানে সাজানো দাবার গুটির মতো যুদ্ধক্ষেত্র এক মহানায়কের মতো অধিষ্ঠান। পরাজিত আবার একই সঙ্গে জেতার সম্ভাবনাময় আলোয় সজ্জিত শীর্ষ।
“রাত হয়েছে অনেক
আমি ডায়েরির পাতা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলেছি
রাস্তায়- হঠাৎ একপশলা বৃষ্টিতে জলে ভেসে যাচ্ছে
আমার মার্কসবাদী স্বপ্নের ইস্তেহার পত্র, যেখানে
আমার শৈশব জুড়ে রয়েছে শুধু স্বপ্ন দেখার দেশ-
আর
মন মাতানো গান, নয়তো একটা লোডেড পিস্তল।”(পৃ: ২৩)
কবিতার জন্ম শুধুই শব্দবন্ধ দিয়ে তৈরি হয়! তা বোধহয় হয়না, শব্দ কেবলই একটি প্রকাশ মাধ্যম। কবি নিজেই সেই কবিতার মূল চরিত্র হয়ে দাঁড়ায় ভাবনায় বোধের আয়না তৈরি করেন। কখনো কখনো অবলা তুচ্ছ প্রেমিক অথবা ইংরেজি সিনেমার ভয়ানক ভিলেনের মতো নিজেকে কবিতা তুলেয় ধরে। এবং শেষ পর্যায়ে নিজের ভুলগুলিকে এক এক করে পাঠকের সামনে প্রকাশ করে চলেন কবিতায়। অত্যান্ত একটি ক্ষীণ গলার স্বরে অনুগত হয়ে এমনই এক কাব্যিক বোধ দেখতে পেয়েছি কবি কাছে, কবি লিখছেন-
“যাতে এই বিরাট একটা সভ্যতায় অসৎগুলোকে নিয়ে
আমি চিরকালের জন্য মাটি চাপা
দিয়ে রাখতে পারি, যে মাটিতে আমি কোনোদিন
জল দেব না, ওরা হাজার বছর ধরে মাটি চাপা পড়ে
কঙ্কাল হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যাবে…
যাতে আর কোনো রক্তের স্রোতে মানুষকে মরতে না হয়
যাতে কোনোদিন কেউ রক্তের হোলি খেলতে না পারে
ধর্মাবতার আমাকে রাজদণ্ড দিন”(পৃ:২৫)
আবার, সোনালী রাংতা মোরা শুধুই দৃশ্য, যে সব বেপরোয়া
চরিত্র কবির আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে নীল শিখার মত, গুটিকয়েক জাল বুনে ফেরে সময়ের তাগিদে কবিকেও তো
খেতে হয় ভাত, মুড়ি, ডাল। কাব্যিক দন্ড ফেলে দিয়ে কবি কলমে শুধু ফুটে ওঠে সহজ প্রত্যয় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই। এই সাধারণ একটি বিষয় হয়ে আসে অতি অসাধারণ ঘটনা আর প্রেক্ষাপট
এমন সহজ কবিতাতেই পাঠক সময়ে অস্থির হয়ে ওঠে
“পাণ্ডুলিপির পাতায় তারা কেমন যেন চরিত্র হয়ে উঠছে
আমাদের কলকাতা শহরের আনাচেকানাচে
যেভাবে পোষ্টার লেপে দিয়ে যায় কোন এক পেশাদারী”(পৃ:২৭)
কবি জীবনানন্দ দাশ এর কাব্যগ্রন্থ ঘিরে যে বাংলার অন্য রূপ আমরা বারবার দেখে এসেছি, তা শুধুমাত্র ইতিহাস হয়ে পড়ে আছে, হারাতে হারাতেই। এই আবহমান কালে সেই হারিয়ে যাওয়া বাংলার মুখের জন্য কবির লেখায় বারবার উঠে আসেছে যে হতাশা, যন্ত্রনা, আকুতি কাব্যগ্রন্থে বুঝিয়ে দিয়েছেন নানা ভাবে। আবারও সেই আফসোস তুলে ধরেছেন এক “আধুনিক কাব্য ভাবনার প্রথিকৃৎ” এর কাছে। তিনি কী শুনবেন, যদি ঘটনাচক্রে জীবিত দশায় কবির একবার সাক্ষাৎকার ঘটে এই মুহূর্তেই কিংবা স্বপ্নে, চিৎকার গুলি বলবেন ‘তাঁর চলে যাওয়ার পর এই বাংলার দুর্দশা ঘিরে বেড়ে উঠছে প্রজন্ম বেড়ে উঠছে ইতিহাস। এমনই এক দাবী ধরা দিবে, জীবনানন্দ দাশ কবির একান্ত আপনের কাছে, কবি বলবেন —
“তবে কি সেই বোধ? যা ‘জীবনের গভীরতা প্রকাশে’
বার বার থমকে যায়!
নয়তো এই অন্তীম জীবনের পথে একটু সময় জিয়ে বলা—
‘হায় চিল, সোনালি ডানার চিল’ যে কিনা আমার মৃত্যুকে বয়ে
নিয়ে এসেছিল এই সন্ধের আকাশে।”(পৃ:৩১)
বিপ্লব শব্দটি যতটা উগ্র ঠিক ততটাই করুণাময় হয়ে ওঠে যখন পিছন ফিরে তাকাতে হয় এবং সম্পূর্ণ একা মনে হয়। যে সমাজ ব্যবস্থায় চলাফেরা করছি আজ যা অভাব বোধহয় নিজের ভেতর নিজেকে এই অভাব ধীরে ধীরে কেড়ে নিয়েছে। অনেক জীবনের কেড়ে নিয়েছে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা। অস্বীকার করার উপায় নেই এই অভাব সৃষ্টিতে স্বয়ং নিজের হাত ও পরোক্ষভাবে কাজ করে। যে মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষায় একটু একটু করে বাঁচতে থাকি, সময় পেরিয়ে আফসোসের হাত ধরে ওঠা বসা, ভাবি মুক্তি কোথায়! এই মুক্তির খোঁজে আবার কবি ফিরে আসে ঘরে আবার শুরু হয় সময়ের চাহিদা পূরণ কবি লিখছেন—
“আমি মুক্তি পেতে চেয়েছিলাম বিকেল ঠিক পৌনে চারটে নাগাদ ফসিলের আস্তারণ সরিয়ে ভাবলাম এবার ঘরে ফিরতে পারব—”(পৃ: ৩৩)
নিশ্চিত ঘুমের প্রয়োজনে কেউ হয়তো জেগেছে সারারাত ভেবে দেখেছি দেখিনি বোধহয় চাদর কুঁচকে গেলে ঘুম ভেঙ্গে কপালে জাগে বিতৃষ্ণা, আর একটু সময় দিলেই স্বপ্নের পূর্ণতা হয়। আজন্ম কবিরা কবিতায় ভেবেছে অন্য কারোর জন্য ভেবেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অন্যের ভালো এই উদারতা কোন নাম হয় নাকি জানানেই। আজীবন কবি ভেবেছে—
“আমরা পৃথিবীর সব কালো দাগ গায়ে মেখে
চিরকালের সীমারেখা মুছে দিতে চেয়েছিলাম
হয়নি।
সব অন্ধকারের প্রবেশ পথে বসিয়েছিলাম আলো
সারারাত হয়তো কারোর আশা টিম টিম করে জেগেছিল
সীমান্তে বন্ধুক হাতে
সীমান্ত থেকে না ফিরে আসার কোন শঙ্কায়,
যেখানে প্রতিনিয়তই বাজে শেষের ঘন্টা”(পৃ:৩৫)
মানবিক এই আলোর পৃথিবীতে মানবিকতার ক্ষরণ, যুদ্ধ বিরোধী সৈনিকের কপালেও জোটে দানবিক মৃত্যু। এখানে আর অস্ত্রের ব্যবহার হয় না এখানে কেবল আগুন যা হিতাকাঙ্খী পুড়িয়ে ফেলা হয় খুব সহজে। তারপর যে রাষ্ট্রীয় লাশের ওপর দিয়ে ইতিহাসে হেঁটে চলে যায় উন্নত সভ্যতা’ পোস্টারে লিখে লাগিয়ে রাখে বুকে, না চাইলেও তোমাকে জোর করে দেখিয়ে নেবে তারা দেখো উন্নত সভ্যতার আধুনিক উন্মোচন মিথ্যে রাজনীতির এই যে
ব্যবহার। সাধারণ মানুষ একের পর এক সকাল থেকে রাত দিন যেভাবে পরিচালিত হয়, তাতে শুধু রাজার সিংহাসন বদলায় বদলায় না পড়ে প্রজাদের দিন বদলের গান—
“লাল- নীল- হলুদ- সবুজ- কমলা,
চলছে জুয়ার লড়াই, দেশ কে নেবে বল?
সাহেব- বিবি- গোলাম?”(পৃ:৩৯)
একটি ইচ্ছে একটি স্বপ্ন একটি আকাঙ্ক্ষা বারবার এই কাব্যগ্রন্থ জুড়ে উঠে আসছে, তবে অন্য রূপে। কখনো একজন সাড়া শহর জুড়ে পোস্টার চেটানো সাধারণ মানুষ, কখনো ক্ষমতার সিংহাসনে বসা অপরাধী হয়ে কবি বারবার নিজের রূপকে পরিবর্তন করে গেছে। যারা বেরিয়েছে আলোর সন্ধানে তাদেরকে ইচ্ছে করেই ক্ষমতা অন্ধকারের পথ দেখিয়েছে। পাঠককে বিভিন্নভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে একই প্রশ্নের মুখোমুখি। যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে কবিতাগুলি, লড়াই করতে হবে, জেনে রাখো লড়াই করতে জানতে হবে। একদিন হয়তো আমরা এক অনন্য স্বাধীনতার ইতিহাস লিখব যেখানে অন্ধকারের কোন আলাদা দৃশ্য নেই শুধু কালো রঙের আলো—
“শুধু পৃথিবীর ললাট ছুঁয়ে শান করবে আলোর ফোয়ারা…”(পৃ:৪১)
কাব্যগ্রন্থে যত শেষের পাতায় চলে যাচ্ছি ততই কবি হতাশা জনক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রতি একটি ক্ষীণ আলোর আসা দেখা যায়। মানব সভ্যতা আশা রেখেই তো চলে গেছে বহুদূর আশা ছিল চাঁদে যাওয়ার, আশা ছিল মঙ্গল আবিষ্কার করার। আশা থেকেই তো নতুন সৃষ্টির মূল খুঁজে বার করা । ক্ষমতার প্রতি আশা রাখে কবি লিখে চলেন দিনের পর দিন কবিতার খাতা, একদিন বদলাবে একদিন হয়তো এমন এক ক্ষমতার সামনে এসে দাঁড়াবে এই সাধারণ মানুষ আর চতকের মত হাঁ করে বসে থাকবে না। হাসবে খিলখিল করে হাসবে প্রাণের হাসিটুকু।
ইতিহাসের প্রতিটা সভ্যতার পতন দেখেছে যাঁরা, তাঁর এও জানেন সেই পতন কিভাবে নতুন সভ্যতাকে কে দিয়ে গেছে তার মূল্য চুকিয়েছে মৃত্যু ঋণ। কবি স-মেধায় বুঝিয়ে দিয়েছে প্রতিটি কবিতা আমাদের ভুল আমাদের ক্ষমা হীন কর্মকাণ্ডের ছায়া।
কাব্যগ্রন্থ : শেষ পান্ডুলিপি দেওয়া থাক, মিশর সভ্যতাকে
কবি: ধীমান ব্রহ্মচারী
প্রকাশনা : খসড়া খাতা
Be First to Comment