Press "Enter" to skip to content

‘বিলম্বিত দুপুর’-এ মনুষ্যত্বের স্বাভাবিক দ্বন্দ্বের কথা

বইটির নাম বিলম্বিত দুপুর। এক বিস্ময় জাগানো দুপুর বেলার কথা। লিখলেন ধীমান ব্রহ্মচারী

১)

বিলম্বিত দুপুর বইটি পড়তে পড়তে যে কোন পাঠকের ই বহু ঘটনা ও জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা খুব সহজেই মনে পড়বে। বইটি রচয়িতা কবি লেখক এবং সাংবাদিক সুমন সাধু। প্রকাশ পেয়েছে বাংলা প্রকাশনা জগতের অন্যতম প্রকাশনা ইতিকথা পাবলিকেশন থেকে। তিনটি পর্বে বিভক্ত হয়ে প্রায় আঠারোটি ভিন্ন স্বাদের গদ্যের সংকলন। তিনটি পর্ব অর্থাৎ “নরম আলোর এসরাজ”, দ্বিতীয়ত “বিলম্বিত দুপুর” এবং শেষ পর্ব “আয়ুষ্কাল রচিত”। গদ্য গুলির মধ্যে যেমন রয়েছে ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতার অভিব্যক্তি তেমনি রয়েছে সামাজিক কিছু ঘটনা ও সামাজিক কিছু চরিত্র যা লেখক এর মনকে সার্বিকভাবে নাড়া দিয়েছে। যার ফলেই তিনি এই বই লেখায় উদ্যোগী হয়েছেন।

প্রথমেই বইটির নামকরণ অত্যন্ত আকর্ষণীয় এ কথা বলাই যায়। কারণ বিলম্বিত দুপুর যে শব্দটির মধ্যে আমাদের আপামর মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের দুপুর পরবর্তী বিরাট একটি সময় ও পর্বকে খুব সহজেই আমাদের সামনে তুলে এনেছেন লেখক। এবং এই পর্বগুলি আবার তিনটি পর্বে বিভক্ত। এই পর্বে রয়েছে পাঁচটি ঝরঝরে গদ্য। প্রথম পর্বের প্রথম গদ্যটি ” কী”! — এক অভাবনীয় যেন আত্মকথন হয়ে রয়েছে লেখকের। তিনি লেখার শুরু করছেন এইভাবে – ” কীভাবে যেন একটা আস্ত শহর গিলে নিচ্ছে গ্রীষ্ম। অফিসের ছাদে দেখি লু বয়। মোবাইলের ওয়েদার আপডেট দিচ্ছে আজ ঠিক ৬টা ১০-এ সূর্যাস্ত। তারপর একটা গুম মারা হাওয়া। একা একটা জার্নি। ঠিক সেই সময় কানে বেজে চলেছে নিখিল ব্যানার্জির কী উদাত্ত সেতার। পাশ থেকে অচেনা কেউ বলে ওঠে, “ওহে, নিখিল কি সন্ধেয় শোনা যায়!” কী জানি! কী জানি-টাও তো কী বিস্তৃত। অটোর পথে বর্ণময় ফুটপাতে আরও বিস্তৃত হাওয়া। এই যাতায়াতের পথেই ঠিক একবছর আগে যখন প্রেমে পড়েছিলাম, বারবার সূর্যাস্তের লম্বা স্পেসে ডুবে যেতাম। আর তো বেরিয়ে আসা গেল না! কেন এমন হাওয়া দেয় চারপাশ! মনে মনে ঝটপট হাওয়ার সেলিব্রেশন। কী কান্না এই হাওয়াদের! বাড়ি এসে স্নান সেরে যেই জিরোতে যাই, দেখি চারদিক অন্ধকার করে এসেছে। কবুল করে ফিরে যাচ্ছে পাড়ার বাচ্চারা। রোজ রাতেই একটা অলীক প্রেম আসে বটে। কীভাবে যে বুঝে যায় কী কী বদভ্যাস, কী রঙের বিছানার চাদর। পাশে কেউ নেই কেন? পাশ থেকে কেউ কি ডাকছে? এই একটুকরো চিল শকুনের দেশে একটা বিষ লেপ্টে যাওয়ার হাওয়া। সেই একটা অলীক অধ্যায়, শরীর নেই, মুখে রা নেই, পালিয়ে যাওয়া নেই।…”

এই লেখায় খুব সহজেই আমরা বুঝতে পারি লেখকের দুপুর বেলার একটি জীবনযাপনের আদ্যন্ত প্রক্রিয়া। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো যেন তাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। আর এই ঘটনাগুলি যে খুব বিরাট ভাবে তাকে ধাক্কা দিয়েছে এমনটা নয়। এবং এই গদ্যে তিনি একদিকে যেমন প্রকৃতির খেলা, উত্তপ্ত দুপুরের বর্ণনা, দুপুরের মধ্যে বয়ে চলা জীবন এবং এরই সাথে মৃত্যুর এক কৌণিক সময় নিয়ে তিনি তার জীবন বোধ এবং স্থির কথা শুনিয়েছেন।

আবার এই পর্বেরই একটি গদ্য ” হাসপাতাল বেড “। চমৎকারভাবে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন একটি হাসপাতাল। সেখানে যেমন বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে স্যাটায়ার ভাবে, অন্যদিকে একেবারেই বাস্তবিক জীবনের প্রতিনিয়ত কাজের মুন্সিয়ানা খুব সহজেই তিনি আলোচনা করেছেন। মৃত্যু একদিকে যেমন ভয় ঠিক তেমনি উন্মাদনা রয়েছে সে মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। এই ভাবেই ঘটনা প্রবাহের গতি প্রকৃতি ও তারই সাথে উপলব্ধি নিয়ে রচিত হয়েছে এ অসাধারণ গদ্যটি।

২)

বইটির তৃতীয় পর্ব অর্থাৎ আয়ুষ্কাল রচিত। এই পর্বের প্রথম গদ্যটিতে তিনি আলোচনা করেছেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম এবং শ্রেষ্ঠ ভয়ংকর এক কালের কথা। বিরাট এক মহামারীর প্রকোপে সারা পৃথিবীব্যাপী যে উন্মাদনা এবং ভয়ের শিকার হয়েছে কোটি কোটি মানুষ থেকে উদ্ভিদ ও প্রাণী সকলেই, যেখানে দুর্নিবার প্রকৃতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছে এই বীভৎস্য মহামারী। সেই পর্বেই কত গ্রাম ও শহর থেকে ফিরে আসা মানুষ এবং তাদের নিজের মাটির প্রতি, নিজের বাড়ির প্রতি, নিজের স্ত্রী সন্তান ও মাতা পিতার প্রতি যে আবেগ ও টান তিনি এই লেখায় পুড়ে দিয়েছেন, তা সত্যি সাধারণ পাঠকের কাছে গ্রহণ যোগ্যতা দাবি করে।এগোতে তিনি ২০২০ সালের মর্মান্তিক মহামারী প্রকোপের ফলে ঘটে যাওয়া জীবন সংগ্রামের যে বিরাট লড়াই তাকে খুব সাধারণভাবে আমাদের জন্য বলেছেন। যেভাবে আমরা দেখেছি করোনা কালে লকডাউন এর প্রভাবে কত দূর দূরান্তে থাকা মানুষ থেকে শ্রমিক কৃষক সকলেই কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার স্তব্ধ হওয়ায় আটকে পড়েছে তারা দিকে দিকে। এর ফলে একদিকে যেমন একের অপরের প্রতি যোগাযোগ হয়েছে বিচ্ছিন্ন, তেমনি একে অপরের প্রতি বেড়েছে আবেগ ও ভরসা। অনেকে এমনও হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পরিবহন সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও তারা শুধুমাত্র “নিজের বাড়ি” বা “দেশের বাড়ি” টানে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছেন মাইলের পর মাইল রাস্তা ধরে। একদিকে জীবন মরণের লড়াই আর অন্যদিকে নিজের ভিটেতে ফেরার তাগিদ। এসবই যেন মিলেমিশে একাকার হয়েছে তার লেখায়। যদিও এই গদ্যে আপেক্ষিক ভাবে তিনি সরকার ও তার শাসনব্যবস্থার প্রতি সামান্য বিরুপাত্মক, প্রতিরোধমূলক এবং প্রতিবাদমূলক দৃষ্টিভঙ্গি রেখেছেন। কারণে কথা ঠিক একটি রাষ্ট্র ও সরকার যখন কোন সিদ্ধান্ত দেশের স্বার্থে প্রয়োগ করেন তখন সার্বিকভাবেই সেই স্বার্থ সেই দেশেরই জনসাধারণের পক্ষে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। তাই একজন রাষ্ট্র নায়ক অথবা দেশ বা রাষ্ট্রের আইন থেকে নিয়ম সবটাই গণতান্ত্রিক উপায়ে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শুধুমাত্র মানুষের কথা ভেবেই রাখা দরকার। এই প্রবন্ধেই ইতিহাস বনাম সম্প্রতি আমাদের রেডিকেল সোসাইটির তিনি খুব সার্বিকভাবেই আলোচনা করেছেন। এই পর্বেই তিনি পূর্বের নানাবিধ ঘটনা ও আন্দোলনের প্রতিটি হিসেবে আজকের এই বিরাট পরিবর্তনশীল ও উন্নয়নশীল দেশ বা রাষ্ট্রের নিয়ম নীতি থেকে সার্বিক প্রগতিশীল এবং স্বাভাবিকভাবে শরণার্থীদের ইতিহাস তিনি কতগুলি যৌক্তিকতার মাধ্যমে আমাদের কাছে পেশ করেছেন। এই পর্বের আরেকটি “গদ্য সব মূর্তি নিছক মূর্তি হয় না”। এখানে তিনি খুব সচেষ্টভাবেই একটি রাজনৈতিক দলের কার্যকারিতা এবং তারই সাথে সেই দলের সামাজিক অবস্থান ও উদ্যোগের নানাবিধ দিক আলোচনা করেছেন। আমাদের সারা বাঙালির কাছে ২০১৯ এর ১৪ই মে একটি ‘কালা দিবসের” দিন হিসেবে রচিত হয়ে গেছে ইতিহাস। বাংলা ও বাঙালি জাতির বিশেষ করে বাংলা ভাষার পিতামহ স্বরূপ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘ এর যখন রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে তার মূর্তি ভেঙে চুরমার করা হয় তখন বাঙালি হিসেবে নিজেদের গায়ে কালিমা লিপ্ত করে নেওয়া ছাড়া আর কিছুই থাকে না। এই লেখায় তিনি মূলত একটু রাজনৈতিক ভাবেই লেখার চেষ্টা করেছেন। কারণ এই ঘটনা যা বাংলার ইতিহাসে কলঙ্কিত অধ্যায় তা লেখক মনকে বিশেষ পীড়া দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলির একটি বিশেষ প্রথা যে কোনো রাজনৈতিক স্বার্থে দেশের ও রাষ্ট্রের সর্বস্থানীয়, সমাজ ও মানব কল্যাণকারী মনীষীদের মূর্তি ভাঙ্গার রীতি, যা এক নক্কারজনক ঘটনা বলেই মনে করা হয়। এই ঐতিহাসিক কালাদিন যেন লেখকের ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। যার ফলে ই তিনি এই দেশের বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একরকম আত্মাধিক্কার ঘোষণা করেছেন। যে দেশ -জাতি -ধর্ম -বর্ণ -ভাষা -নর -নারী সবকিছুই একক কেন্দ্রের মধ্যে মিশিয়েছেন, শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌমিকতাব বজায় রাখতে। তা যেন খুব স্পষ্টভাবে এই দেশের নাগরিক ও সিস্টেমের মধ্যে তিনি দেখতে পান না।

এই পর্বের আরো একটি উল্লেখযোগ্য গদ্য “বর্তমান কৃষক আন্দোলন হোক লড়াইয়ের নতুন ভাষা”। একটি কথা আমরা খুব ভালোভাবেই জেনে ফেলেছি যে আজকের সময় দাঁড়িয়ে সবার সভ্যতায় কোন ঘটনা বা কোন ব্যক্তি ও রাজনৈতিক বলে কিছু হতে পারে না। যা কিছু হতে পারে তা সম্পূর্ণই রাজনীতি কেন্দ্রিক। তাই রাজনৈতিক পালাবদল যেকোনো দেশের বা রাষ্ট্রের সংবিধান থেকে দেশ চালনা- সবেতেই এক বিপুল কার্যকারিতার প্রভাব পড়বেই – এবং এই ঘটনায় খুব স্বাভাবিক। এই গদ্যে তিনি ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের বিরাট একটি প্রভাবকে, প্রতিক্রিয়া কে এবং তার সাথে জড়িত সার্বিক রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তা, রাজনৈতিক ধারণা, সামাজিক নিয়ম নীতি — এবং এরই বাইরে সাধারণ মানুষের মানবিক আবেদন এসব কিছুই যেন এই লেখার প্রধান উপজীব্য বিষয়। এই লেখার একটি অংশের লেখক লিখছেন, – “১৯২৭ সালের কথা। প্যারিসে বারব্যুস, রোমা রোল্যার নেতৃত্বে প্রথম ফ্যাসিবাদবিরোধী সম্মেলন। ভারত থেকে একমাত্র সই করেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যদিও বিশ্বশান্তি রক্ষা হয়নি। পশ্চিমের বাতাস আরও বিষিয়েছে। ইতালির আবিসিনিয়া আক্রমণের পর রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ জানালেন কবিতায়। লিখলেন, ‘আফ্রিকা’ —

“এসো যুগান্তের কবি,/

আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে/

দাঁড়াও, ওই মানহারা মানবীর দ্বারে;/

বলো ‘ক্ষমা করো’/

হিংস্র প্রলাপের মধ্যে/

সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।”

খুব উল্লেখযোগ্যভাবেই তিনি এই এই লেখায় জমিদার প্রথা- রাষ্ট্র কেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা – এবং এরই বিপরীতে ফ্যাসিবাদ শক্তির ক্ষমতার কথা নির্দ্বিতায় ব্যক্ত করেছেন। সারা ভারত বর্ষ কৃষি প্রধান দেশ। বিরাট সংখ্যক মানুষ এই কৃষিজ উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত। ফলে কৃষক সর্বদাই তার নিজের কাজকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েই পালন করবে এই তো স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু রাষ্ট্রের চোখ রাঙানি ও অকত্ব অত্যাচার যখনই স্বাভাবিক নিয়মকে অস্বাভাবিক করে তোলে তখনই তৈরি হয় সাধারণের মধ্যে ক্ষোভ। আরে খুব ধীরে ধীরে,  সময়ে সময়ে পঞ্জিভূত হয়ে মহা বিক্ষোভে পরিণত হয়। এই আন্দোলনই তখন গণ-আন্দোলনের রূপ নেয়। প্রতিবাদের ওপর প্রতিবাদ নিয়েই দেশের কৃষক লড়াই করে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে। মানুষের সাথে মানুষের প্রান্ত থেকে নিজের ঘর সংসার সর্বোত্তই ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। হলে যেমন বাড়ে কাজ, তেমনি বারে বিশ্বাস। ভারতবর্ষের মতো দেশের কৃষি হচ্ছে প্রধান এবং মূল মেরুদণ্ড, যা কোনোভাবেই কোন ব্যক্তি বা রাষ্ট্রশক্তির কাছে মাথা নত করে না। অথচ এই শক্তি যখন সার্বিকভাবেই রাষ্ট্রশক্তির কাছে মাথা নত করে পরাজয় স্বীকার করে তখন বুঝে নেওয়া যায় দেশে বা ওই রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়ে গেছে। এখন এই ফ্যাসিবাদকে রুখতেই শুরু হবে গণতন্ত্রের সার্বিক আন্দোলন অর্থাৎ গণ আন্দোলন। আরে আন্দোলনে যখন সাধারণ কালো চামড়ার খেটে খাওয়া মানুষ মুখ হয়ে উঠে আসে তখন লেখকের পূর্ণ আশ্বাস বেড়ে যায়। তিনি নিজেও হয়ে ওঠেন সে কৃষক আন্দোলনের এক বড় শরিক। তিনি হয়ে উঠেন সেই কৃষক আন্দোলনের এক স্বর। লিখতে পেরেছেন তাই –” কৃষক আন্দোলন হোক লড়াইয়ের নতুন ভাষা। যা আদর করে আপনার মুখে ভাত তুলে দেবে আজীবন। ” 

এই পর্বের আরো একটি প্রবন্ধ “কিম কি – দুক এবং একটি বিপন্ন জাহাজ”– যেখানে লেখার শুরুতেই লেখক একটি তথ্যের কথা আমাদের কাছে তুলে ধরেন। 

” (কিম কি-দুকের প্রেমে পড়ি ‘থ্রি আয়রন’ দেখে। মনে হয়েছিল এই তো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভালোবাসার গল্পটি বললেন কিম। ‘স্প্রিং সামার ফল উইন্টার অ্যান্ড স্প্রিং’ দেখার পরেও ঠিক এইরকম অনুভূতি। কী অসহনীয়, নির্মম, অস্থির। অথচ কত ধীর, স্থির, নির্বাক। আসলে কিমের অধিকাংশ কাজ দেখেই মনে হয়েছে এই মহাবিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রেমের চিত্রই আঁকতে চেয়েছেন তাঁর ক্যানভাসে। ২০১৮ সালে কিমের ‘হিউম্যান, স্পেস, টাইম অ্যান্ড হিউম্যান’ দেখানো হয়েছিল কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে। দেখে এসে নিজের অভিব্যক্তি লিখেছিলাম কাঁচা হাতে। দুক-কে স্মরণ করি আরেকবার।) —

মূলত একটি সিনেমার দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর এবং সেই সিনেমার বিষয়বস্তু, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং সর্বোপরি জীবনের এক সাধারন অভিব্যক্তি খুব সুন্দরভাবেই প্রকাশ পেয়েছে যা লেখক এর বর্ণনায় বর্ণিত হয়েছে। একটি জাহাজের লম্বা সফর এই লেখা প্রসঙ্গে উঠে এসেছে। মানুষ এবং তার জীবিকা সর্বোপরি মানুষের অস্তিত্বের সংকট এসব কিছুই এই লেখার মধ্যে লেখক তুলেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি মানুষের সিনেমা দেখার অভিমুখ এবং লক্ষ্যকে খুব সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করার চেষ্টা করেছেন। এই লেখার একটি আলোচনায় তিনি লিখছেন —

” ‘হিউম্যান স্পেস টাইম অ্যান্ড হিউম্যান’ মনুষ্যত্ব এবং আদিমের হাত ধরে চলে। গোটা ছবি জুড়ে আদিম বুনো গন্ধ দর্শকদের নাকে আসে। হিংস্র পৃথিবী, হিংস্র মানুষের মন, হিংস্র ভালোবাসা আমাদের গ্রাস করে। সিনেমার শুরুতে দেখা যায় একটি জাহাজ ভেসে চলেছে, তাতে রয়েছেন প্রচুর যাত্রী। আর সেখানেও বিভাজন, যাত্রীদের একদল শাসক শ্রেণির, আরেকদল শ্রমিক শ্রেণির। যিনি দেশ শাসন করেন, তিনি জাহাজও শাসন করেন নিজের নিয়মে। যাত্রীদের ধর্ষণ করেন, খুন করেন, খাবার বন্ধ করে দেন। বিকৃত মানুষ একসময় খেতে না পেয়ে নিজেদের মাংস খায়। অর্থাৎ মানুষ মানুষের মাংস খাচ্ছে। এইভাবে শরীরে বিষিয়ে যাচ্ছে অন্যের রক্ত। এই ছবিতে মোট চারটে অধ্যায় রয়েছে। হিউম্যান, স্পেস, টাইম এবং আবার হিউম্যান।..” এই লেখা প্রসঙ্গেই তিনি লিখছেন যে, ” ছবিতে দেখানো হয় আধুনিক সভ্য সমাজ থেকে অনেকখানি এগিয়ে আমরা পৌঁছে যাচ্ছি প্রাচীন অসভ্য সমাজে। সাক্ষী থাকছে একটা জাহাজ এবং একটি বোবালোক। লোকটি শুধু হাসেন। মানুষকে খুন করা হলে তাদের শরীরের ক্ষত অংশে তিনি বাদামের বীজ দেন, তার ওপর মাটি দেন। যাতে সেই কত অংশ থেকে গাছ তৈরি হয়।” –কি অভাবনীয় দৃশ্য একবার ভাবুন। যে ঘটনার কথা উল্লেখ রয়েছে তা আমাদের মত সাধারণ মানুষের বোধগম্যের বিষয় হয়ে উঠতে পারেনা। কিন্তু লেখক এই বিষয়কেই তার আলোচনার কেন্দ্রীভূত করে আমাদের কাছে খুব সাধারণ নিয়মেই সাধারণ ভাষায় এবং সাধারণভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এই প্রসঙ্গেই এই ছবিতে চলচ্চিত্রকারের নানাবিধ বিষয় প্রয়োগ নিয়েও তিনি আলোচনা করেছেন। একজন পরিচালক বা একজন শিল্পীর কাজ সর্বদাই নিপুন ও শৈল্পিক। যা এখানে ‘কিম কি দুক ‘ খুব সাধারন ভাবেই আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন। একটি সিনেমা অবশ্যই সেই সময়, সেই জাতি, সেই রাজনৈতিক অবস্থার পূর্ণাঙ্গ দলিল হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। তাই আমরা যখন আজকের সিনেমা বা বিগত ৫০ বছর আগের সিনেমা দেখতে বসি তখন আমাদের মধ্যে এখন বনাম তখন যে উপাদান গুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায় অথবা খুব স্বাধীনভাবেই তর্কে এসে পড়ে – তা অপেক্ষা করার কোন অজুহাতি আমাদের কাছে থাকে না। তাই ‘ হিউম্যান স্পেস টাইম এন্ড হিউমান ‘ নামক যে ছবিটি নিয়ে লেখক আলোচনা করেছেন তা এক কথায় প্রশংসনীয়। অমানবিক এবং তার সঙ্গে মনুষ্যত্বের যে স্বাভাবিক দ্বন্দ্বের কথা তিনি এই আলোচনায় তুলে এনেছেন তা আমাদের কাছে অনেক প্রশ্ন চিহ্নের মতো থেকে যায়। 

সবশেষে এটুকু বলা যেতেই পারে লেখক সুমন সাধু তাঁর এই বইটির মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে শুধু জীবন নয়, সমাজের ঘটে যাওয়া ঘটনা ও চরিত্রের এক ব্যক্তিগত আত্মলোচনা ও অভিব্যক্তিকে আমাদের মতো সাধারণ পাঠকের উপযোগী করে তোলে। 

বিলম্বিত দুপুর / সুমন সাধু / ইতিকথা পাবলিকেশন/ মূল্য ২২৫.০০

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *