Press "Enter" to skip to content

মহালয়া মানেই শিরে সংক্রান্তি

রক্তিম ভট্টাচার্য

দেখতে দেখতে আবার একটা মহালয়ার ভোর, আর আমাদের মতো হুতোম প্যাঁচাদের ঘুমের দফারফা। না না, হুতোম প্যাঁচার অনুষঙ্গটা যে কালীপ্রসন্ন সিংহের মতো পাণ্ডিত্যের সঙ্গে তুলনার অর্থে বলছি না, সহজেই অনুমেয়। আসলে আমাদের প্রজন্ম মূলত যেরকম রাত্রিবিলাসী, সারা রাত সামাজিক মাধ্যমে মুখ গুঁজে ভোর তিনটে পঞ্চান্নয় যে উঠতে হবে এবং রেডিও’র ছবি স্ট্যাটাসে না চেপকালে যে এলিট সমাজে মান থাকবে না- তা বোঝাতে বোঝাতেই কাবার। আসলে “মহিষাসুরমর্দিনী” শোনার চেয়ে দেখানোর ইচ্ছে বহুগুণে প্রবল- অগত্যা, হোয়াটসঅ্যাপ খুলে রেডিও’র সামনে ক্যামেরা অন করে রেডি! আরও কাজ থাকে বই কী! অনুষ্ঠান শেষ হবার পর কারা কারা শুনল কাউন্ট করা, তাদের সঙ্গে কোথায় আজ খেতে যাওয়া হবে তা নিয়ে আলোচনা করা, যারা যারা ভোরে উঠতে পারল না, তাদের নিয়ে খানিক রসিকতা করে অষ্টমীর প্ল্যান কষতে শুরু করা – এসব নানাবিধ ব্যাপার। আবার বেলা গড়ালে আসে “শুভ মহালয়া” নিয়ে তর্ক-বিতর্ক। মহালয়া শুভ না অশুভ, কর্ণের পিতৃপুরুষ জল পেলেন কি পেলেন না, মহালয়া আর দেবীপক্ষ এক না আলাদা, মহালয়ার সঙ্গে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের যোগ কতখানি- এসব নিয়ে লম্বা লম্বা হ্যাজ জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যমে এই এলো বলে!

এতক্ষণ পড়তে পড়তে শিওর মনে হচ্ছে, কোনও বাংলা চ্যানেলে পরিচিত বুদ্ধিজীবী ইন্টেলেকচুয়ালদের মতো বর্তমান বাঙালি সমাজের ছ্যাছ্যাক্কার করার জন্য লেখালেখি। আজ্ঞে না, আসলে ব্যাপার হচ্ছে, হুজুগে মানুষ যেমন মাইক পেলে ছাড়তে পারে না, তেমনই আমরাও ওই একবার কিছু একটা লেখার সুযোগ পেলে এদিকওদিক টানাটানি করতে ছাড়তে পারি না। হচ্ছিল মহালয়ার কথা, তা নয় বাঙালির বদভ্যাস নিয়ে কচকচানি! কিন্তু বিষয় হচ্ছে, এই মহালয়া আদতেই যে শুধুমাত্র একটা অনুষ্ঠানকে ঘিরে সমগ্র বঙ্গকুলের আবেগ নয়- তা খানিক বোঝা দরকার বটে।

আসলে মহালয়া হচ্ছে একেবারেই সেই রথের ছাতার মতো, যা এলে বোঝা যায় সত্যিই এবার পুজো আসছে। আমরা যখন কলেজে পড়তাম, বার্ষিক পরীক্ষার পর আসল রেজাল্ট বেরোনোর বিজ্ঞপ্তির আগে একটা ‘ফেক’ নোটিশ আসত। ওটা এলে বোঝা যেত, এবার শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত নামার কারণ ঘটতে চলেছে। এখানেও ঠিক তাই। মূলত, বিশ্বকর্মা পুজোর পর থেকেই যে তোড়জোড় শুরু হতে থাকে শহর এবং মহানগরী-সংলগ্ন মফঃস্বলগুলোতে, শুধুমাত্র সান্ধ্যকালীন ঘেরাটোপ ছেড়ে মধ্যাহ্নভোজের পর থেকেই ভিড় ঘনিয়ে উঠতে থাকে জামা-কাপড়ের দোকানগুলোতে- তার এক ‘কালমিনেশন পয়েন্ট’ বলা যেতে পারে এই মহালয়ার সময়টা। ভোর থেকে খানিকটা সময় বাদ দিলে আরেকটা ছুটির দিনের মতোই, তবু যেন বাতাসে, মেজাজে ছড়িয়ে পড়তে থাকে “জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমনবার্তা”।

মহালয়া এলেই বাড়িতে একটা শোরগোল শুরু হয়। স্মৃতিজীবী হয়ে আমরা পুরনো দিনের নস্টালজিয়াকে ঝালিয়ে নিতে শুরু করি। বাড়ির পুরনো মানুষদের এই সময় স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসার সময়। ধুলো-ঝুলে ভরপুর কাঁটা-দেওয়া রেডিও একবার আড়মোড়া ভেঙে নেয়, আমরা খুঁজে নিই আকাশবাণী কলকাতার চ্যানেলের তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য। ব্যক্তিগতভাবে ইডেন উদ্যানের পাশের এই বাড়িটায় চাকরি করার সুবাদে বুঝতে পারি, আকাশবাণী ভবনের প্রতিটি সিঁড়ির মধ্যে রোমাঞ্চ লুকিয়ে আছে। রেলিং দেওয়া ঘোরানো সিঁড়ি দিয়েই একদিন উঠে যেতেন প্রবাদপ্রতিম বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বা পঙ্কজ কুমার মল্লিক, বাণী কুমারের মতো কিংবদন্তিরা। আমাদের কাছে মূল চ্যালেঞ্জ থাকে, ঠিক সময়ে উঠে রেডিওটা চালানো, আর প্রায় দেড় ঘণ্টার কাছাকাছি অনুষ্ঠানটা মন দিয়ে পুরোটা শোনা। প্রতিবারই ঘুম থেকে উঠতে উঠতে “তব অচিন্ত্য” হয়েই যায় প্রায়। তারপর ঢুলতে ঢুলতে মোটামুটি ঘুম তাড়ানোর ছক কষার আগেই শুরু হয় প্রায় অশ্রুসিক্ত উচ্চ-মন্দ্র নাদে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে সেই অবিশ্বাস্য স্তোত্রপাঠ- যার কারণে এই “মহিষাসুরমর্দিনী” ভারতীয় বেতার ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত সবথেকে বেশি-দিন ধরে চলা অনুষ্ঠান।

অনেকেই জানেন, মহানায়ক উত্তম কুমারকে দিয়ে একবার এই অনুষ্ঠানের ভাষ্য-পাঠ করানো হয়েছিল। খুব অল্প সময়ের জন্যই তিনি পাঠ করেন, বাকি সময় পাঠ করেন ছন্দা সেন, পার্থ ঘোষের মতো কিংবদন্তীরা। অপূর্ব সুরমূর্ছনা তৈরি করেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। কণ্ঠ দেন মান্না দে, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। উত্তম-হেমন্ত সোনার জুটি! হিট আদিকাল ধরে চলে আসা সেই ‘একঘেয়ে’ স্বাদ থেকে তবে বোধ হয় মুক্তি। কিন্তু ফল? এমনই অবস্থা দাঁড়ায়, অল ইন্ডিয়া রেডিওকে জনসমক্ষে ক্ষমা চেয়ে দুর্গাষষ্ঠীর দিন সেই পুরনো ‘একঘেয়ে’ অনুষ্ঠান পুনঃসম্প্রচার করতে হয়। আসলে, এই অনুষ্ঠানের যে প্রাচীনতা, লেগে থাকা ঐতিহ্যের ছোঁয়া – শুধুমাত্র আইকন কালচারে ভোগা এবং হীনম্মন্যতাগ্রস্ত বাঙালিদের কাছে আবেগের এলোপাথাড়ি সুড়সুড়ি নয়, তার মধ্যে যেন মিশে আছে মা দুর্গার সুপ্রসন্ন আশীর্বাদ। এই “দেবী দুর্গতিহারিণী” অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। এখানেও ছিল চমৎকার ভাষ্য, ছিল অপূর্ব পাঠ আর তেমনই সুরের মেলবন্ধন- কিন্তু কোথাও গিয়ে ভদ্র-মল্লিক-কুমারের ত্রিশক্তি জোটের যে লাবণ্য আপামর জনসাধারণের কাছে লহমায় সাজিয়েছিল মা মহামায়ার চিন্ময়ী-মৃন্ময়ী রূপ, তার প্রকাশ এখানে ঘটেনি।

মহালয়া শুধু শোনার নয়, দেখারও বটে। দূরদর্শনের মহালয়ার এক মেজাজ ছিল বটে, কিন্তু সাধারণত জনপ্রিয় টেলি-চ্যানেলের ছোটপর্দার পরিচিত মুখদের মহামায়া-চরিত্রে অভিনয় দেখে অসুরও বোধ করি কুণ্ঠিত হয় হত হতে। কিন্তু, নিরুপায় সেও। অন্তত, আম-বাঙালির, বা বিশেষত, ছোটদের মনে হাসি জোগাতে এই ভূমিকা তার বরাদ্দই থাকবে প্রতি বছর।

মহালয়া – দেবীপক্ষের আবাহন। পিতৃপক্ষের সমাপন হয়ে মা দুর্গার মর্ত্যভূমে আগমন। শুধু কি তা আমাদের জন্যই? নাকি নিজের জন্যও? মা এই সময় নিজের বাড়ি ফেরেন। ফলত, সব মিলিয়েই খুশির আবহের শুভ সূচনা নিঃসন্দেহে। কিন্তু, মহালয়ার আগের দিন থেকেই ইদানীংকালে একটা ঘোর দ্বন্দ্ব সামাজিক মাধ্যমে সোচ্চার। মহালয়া শুভ না অশুভ? ব্যাপারটার শুরু হয় আবারও সেই হুজুগে বাঙালির হোয়াটসঅ্যাপের শুভেচ্ছা থেকে। নিজের জন্মদিন থেকে চৈতন্যের জন্মদিন, সূর্য ওঠা থেকে শুরু করে বাড়িতে খাঁটি কলমিশাকের রান্না – সব ব্যাপারেই একটা শুভ-বার্তা ঝুলিয়ে না দিলে আমাদের চলে না। তো সেখানেই, “শুভ মহালয়া”-র বার্তা কেমন একটা অশুভ ইঙ্গিত বহন করে বলে একাংশ মনে করেন। কী যুক্তি এর পক্ষে? একবার দেখে নেওয়া যাক।

শাস্ত্রমতে মহালয়ার সঙ্গে দুর্গাপুজোর কোনও সম্পর্ক নেই। বরং মহালয়া হল প্রয়াত পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ শ্রাদ্ধ করার দিন। পণ্ডিতদের অনেকের মতে, মহালয়া পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মের তিথি বলে নির্দিষ্ট হওয়ায় একে ‘শুভ’ বলে গ্রাহ্য না করাই ভালো। এই তর্পণ প্রথার সঙ্গে আবার রামায়ণের, মতান্তরে, মহাভারতের খানিক যোগ আছে। রামায়ণ অনুসারে, হিন্দু ধর্মে কোনও শুভ কাজের আগে প্রয়াত পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা অর্পণ করতে হয়। লঙ্কা জয়ের আগে এমনটাই করেছিলেন রামচন্দ্র। সেই থেকে মহালয়ায় তর্পণ অনুষ্ঠানের প্রথা প্রচলিত। আবার মহাভারতের ব্যাখ্যা আলাদা। সেখানে বলা হচ্ছে, মৃত্যুর পর কর্ণের আত্মা পরলোক গমন করলে তাঁকে খাদ্য হিসেবে সোনা ও রত্ন দেওয়া হয়। দেবরাজ ইন্দ্রকে কর্ণ এর কারণ জিজ্ঞাসা করেন। তখন ইন্দ্র বলেন যে দানবীর কর্ণ সারা জীবন সোনা মণিমাণিক্য দান করেছেন, কিন্তু প্রয়াত পিতৃপুরুষদের উদ্দেশে কখনও খাদ্য বা পানীয় দান করেননি। তাই স্বর্গে খাদ্য হিসেবে তাঁকে সোনাই দেওয়া হয়েছে। তখন কর্ণ জানান যে তাঁর পিতৃপুরুষ কারা, কোন বংশে তাঁর জন্ম, তা কিনি জানতেন না। সেই কারণে কখনও পিতৃগণের উদ্দেশে খাদ্য দান করেননি। এরপর দেবরাজের নির্দেশে কর্ণ ষোল দিনের জন্য মর্ত্যে ফিরে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করেন। এই পক্ষই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়।

এবার এর বিরুদ্ধ মতানুসারে বলা হয়, মহালয়া কথাটি এসেছে ‘মহৎ আলয়’ থেকে। হিন্দু ধর্ম অনুসারে পিতৃপক্ষে প্রয়াত পিতৃপুরুষরা তাঁদের বংশধরদের হাত থেকে জল নিতে মর্ত্যলোকে আসেন। এই পনেরদিন এখানে কাটিয়ে মহালয়াতেই তাঁরা জল গ্রহণ করে তৃপ্ত হয়ে ফিরে যান। অনেকের মতে প্রয়াত পিতৃপুরুষদের জল ও পিণ্ড প্রদান করে তাঁদের তৃপ্ত করা হয় বলেই মহালয়া একটি পূণ্য তিথি। একে অশুভ মনে করার কোনও কারণ নেই। আবার অনেকে, স্রেফ দুর্গাপুজোর আবাহন-সূচক বলেই মহালয়াকে পবিত্র সময় বলে মনে করেন।

এই বিতর্কের শেষ নেই। তাই আমরা বরাবরের মতো সহজ, ডিপ্লোম্যাটিক মধ্যপন্থা অনুসরণ করি। দিনকাল এমন, তর্ক, বা বলা বাহুল্য, প্রতর্কের যুগ এখন প্রায় নেই বললেই চলে। সেক্ষেত্রে, হাসি-মুখে শুভেচ্ছা এলে প্রতি-শুভেচ্ছা জানানো- এই দিয়েই চলে যাচ্ছে আজকাল।

সব-মিলিয়ে, মহালয়ার দিন শুধু মহালয়ার স্বীয় তাৎপর্য-ই নয়, তাকে ঘিরে বঙ্গকুলে যে মহিমার সঞ্চার – তা নেহাত কম নয়। নিছক একটা ছুটির দিনের মতো কাটাতে চেয়েও এই যে গা-ঝাড়া দিয়ে পুজোর পরিকল্পনা করার জন্য ছোটাছুটি – এও বা কম কী! অতএব, মহালয়া মানেই শিরে সংক্রান্তি। হে ল্যাদখোর বাঙালি! তোমাদের শ্রেষ্ঠ উৎসব সমাগত। ওঠো, জাগো, প্যান্ডেলের লাইনে না পৌঁছনো পর্যন্ত থেমো না।

মহালয়ার বিতর্কসূচক অংশের তথ্যসূত্র:

১। ‘শুভ মহালয়া’ কথাটি হিন্দু রীতিতে ঠিক না ভুল? – শ্রমণা গোস্বামী

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *