শ্রয়ণ সেন
“এটা নিশ্চয়ই তিলোত্তমার জন্য?”
সে দিন উত্তরবঙ্গগামী এক দুরপাল্লার ট্রেনে সহযাত্রী আমার হাতে কালো ব্যান্ডটা দেখে প্রশ্ন করলেন। সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লাম। ওঁর মুখ দেখে বোঝা গেল উনি বিষয়টার সঙ্গে সহমত জ্ঞাপন করলেন।

আসলে গত দু’মাসে ন্যায় বিচারের দাবিটা আমাদের জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গিয়েছে। আর ঠিক সেই কারণে এ বার দুর্গাপুজোর আবহও অন্য রকম হতে চলেছে।
তিলোত্তমা বলি বা অভয়া, এই মেয়েটা আমাদের সবাইকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে। এটা ঠিক যে ধর্ষণ করে খুনের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ভারতে আগে হয়েছে। আমরা নির্ভয়াকাণ্ড দেখেছি, হাতরাসকাণ্ড দেখেছি, উন্নাওকাণ্ড দেখেছি, তেলেঙ্গনার সেই ঘটনাটি দেখেছি। কিন্তু এবারের ঘটনার প্রেক্ষিত সম্পূর্ণ আলাদা। এবারের লড়াই পচন ধরা একটা গোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। হাসপাতালের হুমকি সংস্কৃতি যা এই ব্যবস্থারই একটা অংশ।
এই পরিস্থিতিতে বাঙালি হিসেবে গর্বও অনুভব করছি। কারণ কলকাতার মানুষ তথা বাঙালিই পেরেছে একটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই ভাবে গণআন্দোলনে সামিল হতে। নির্ভয়াকাণ্ডের পর, এই ধরনের গণবিক্ষোভ আর কোনো ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। উন্নাওকাণ্ডেও এমন প্রতিবাদ হয়নি, যেখানে এক বিধায়কের সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু বাঙালি জেগে উঠেছে।
এই লড়াই এটা একটা ব্যবস্থা, একটা দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলানোর জন্য লড়াই।

কথায় বলে ভয় জিনিসটা সংক্রামক। কিন্তু বাঙালির এই গণজাগরণে কিন্তু সাহসও সংক্রামক হয়ে উঠেছে। নইলে ১৪ আগস্টের মেয়েদের রাত দখল করার একটা ছোট্ট আহ্বান এভাবে স্ফুলিঙ্গের মতো বেড়ে উঠল কী করে! আসলে দীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ একে একে বেরিয়ে আসছে এবার।
এবারের লড়াই গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে বদলে ফেলার লড়াই। তাই এই সমাজের একটা ছোট্ট অংশ হওয়ার ফলে আমারও কিছু দায়িত্ব এসে যায়। তাই সেই ১৪ আগস্টের রাত দখলের দিন থেকেই কিছু করার চেষ্টা করে গিয়েছি।
নিজের পেশার কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরতে হয় আমাকে। ১৪ আগস্টও কলকাতায় ছিলাম না। ছিলাম মহারাষ্ট্রের নাসিকে। কিন্তু সেখানে থেকেও সেদিন কলকাতার দিকেই নজর ছিল। কলকাতার তথা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শহরে আয়োজিত সেই বিদ্রোহ সে দিন অনুপ্রাণিত করেছিল আমাকেও। নিজের মতো করে নাসিকে এক প্রতীকী রাত দখল করেছিলাম কয়েকজনকে নিয়ে। তার পরের একমাস যেখানেই গিয়েছি ন্যায় বিচারের দাবি থেকে সরে আসিনি। বরং এই বিচারের স্বর আরও আরও জোরালো হয়েছে।
আরজি করের ঘটনার দু’মাস কেটে গিয়েছে। অতীতে আমরা দেখেছি কোনো না কোনো ভাবে এই ধরনের ঘটনাকে ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়। অন্য খবরের আড়ালে চলে যায় এই ধরনের ঘটনার পর আর আমরা পুরো বিষয়টাই ভুলতে বসি। এবারও সেই রকম চেষ্টা যথেষ্ট হয়েছে। কিন্তু তাও অন্য খবরের আড়ালে এটা চাপা পড়ে যায়নি। বরং আরও জোরালো ভাবে জেগে উঠেছে সেই স্বর।
কয়েকজন তরুণ-তরুণী পরিস্থিতি বদলানোর জন্য না-খেয়ে আন্দোলনে নেমেছেন, আর আমি উৎসবে থাকব?

আমরা এখন দেবীপক্ষের মধ্যে রয়েছি। দুর্গাপুজো শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সত্যি বলছি, এ বার পুজোয় মেতে থাকার সেই মুডটাই পাচ্ছি না।
হ্যাঁ পেশার কারণে পুজোতে বেরোতে হবে, বিভিন্ন বনেদি বাড়ির ঠাকুর দেখতে হবে। কিন্তু প্যান্ডেলে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখার সেই তাগিদটাই নেই। যখনই উৎসবে মেতে ওঠার কথা মাথায় আসবে, খালি মন চলে যাবে অভয়ার দিকে এবং অভয়ার জন্য যাঁরা অনশনে নেমেছেন তাঁদের দিকে। কয়েকজন তরুণ-তরুণী পরিস্থিতি বদলানোর জন্য না-খেয়ে আন্দোলনে নেমেছেন, আর আমি উৎসবে থাকব, এটা হতে পারে না।
নিজের মতো করে প্রতিবাদেও থাকব এ বার পুজোয়। বাঁ হাতে একটা কালো ব্যান্ড পরে রেখেছি আগে থেকেই। সেটা পরেই নানা জায়গায় ঘুরছি গত কয়েক মাস। পুজোতেও তার ব্যতিক্রম হবে না। জানি না এটা কতদিন পরে থাকতে হবে, তবে আমি তা পরে থাকার জন্য প্রস্তুত।
এই লড়াই কিন্তু কোনো কাউকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য নয়। বরং এটা একটা ব্যবস্থা, একটা দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলানোর জন্য লড়াই।
আশা করি এই গণজাগরণের পর এমন একটা দিন আসবে যে দিন থেকে:
১) মেয়েদের নাম নিয়ে গালিগালাজ করা (এখনও অনেকেই সেটা করছেন) বন্ধ হবে।
২) রাস্তাঘাটে মেয়েদের কোনো অস্বস্তিকর ছোঁয়ার মুখে পড়তে হবে না।
৩) গভীর রাতে একটা মেয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্তে কাজের জায়গা থেকে বাড়ি ফিরতে পারবে। অথবা কাজের জায়গায় কাজ করতে পারবে নিশ্চিন্তে।
৪) ‘ডিভোর্সের জন্য মেয়েরাই দায়ী’ জাতীয় মন্তব্য বন্ধ হবে।
৫) মেয়েরা সিগারেট খেলে তাদের চরিত্রের বিচার করা হবে না। শুধুমাত্র স্বাস্থ্যের দিকটাই প্রাধান্য পাবে।
৬) কে কী পোশাক পরল, সেই নিয়ে অন্যরা কোনো মাথা ঘামাবে না।
তারপরেই প্রকৃত উৎসব শুরু হবে…
একদিন সূর্যের ভোর
একদিন স্বপ্নের ভোর
একদিন সত্যের ভোর আসবেই।



Be First to Comment