রাজশ্রী মণ্ডল
চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা পড়ার আগে বেল বেজে ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল ফোনে ভেসে ওঠে বইসইয়ের নাম। ছায়াকে দরজা খুলতে বলে, ফোনটা ধরতে প্রকাশকের আবদার, দিদি দুটো দিন বাকি পুজোসংখ্যা বেরোতে, ‘প্লিজ দিদি কবিতাটা একটু তাড়াতাড়ি হোয়াটসঅ্যাপ করো’। ‘আচ্ছা বেশ’ বলে ফোনটা কাটতেই, দেখি দরজায় দাঁড়িয়ে আছে অপালা। ‘কিছু বলবি’ বলতেই সে তড়িঘড়ি এসে আমার পাশে বসেই আবদার, ‘কাকিমণি একটা কালো শাড়ি তাড়াতাড়ি বার করে দাও তোমার শাড়িগুলো থেকে। মহালয়ার আগের দিন কলেজে একটা আগমনীর অনুষ্ঠান হবে।
অনুষ্ঠান শুনেই জিজ্ঞাসা করে ফেললাম, ‘পুজোর কোন গানে নাচ করবি’?

‘কি যে বলো কাকিমণি’, বলে সে আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়? ‘এবার আর পুজোর গান নয়, এবার প্রতিবাদের গান ,এবার আর প্রদীপ হাতে নয়, মশাল হাতে প্রতিবাদের উপস্থাপনা থাকবে’।
বুঝতে পারলাম মায়ের আগমনের আনন্দ কোনোভাবেই ম্লান করে দেয়নি প্রতিবাদী মনকে। বললাম, ‘তা বেশ কী করেছিস’।
‘এ বার আমাদের উপস্থাপনায় থাকবে একটা নাটক। তাতে অভিনয়ের সঙ্গে নাচ, গান থাকবে’।
‘ঠিক আছে’ বলে আলমারি থেকে কালো শাড়ি বের করে দিলাম। শাড়িটা ওর হাতে তুলে দেওয়ার সময় ওর দীর্ঘশ্বাসে দীর্ঘ দেড় মাসের প্রতিবাদী উষ্ণতা যেন আমাকেও ছুঁয়ে গেল। অপালা চলে যেতে চুপ করে কিছুক্ষন বসে রইলাম। তারপর নিজের লেখাটা হোয়াটসঅ্যাপ করে দিলাম। বিগত কয়েক দিনে খবর সোশ্যাল মিডিয়া, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, সবার মুখে সবার কার্যকারিতায় শুধু যেন আপোষহীন লড়াইয়ের এক অদম্য মানসিকতা লক্ষ্য করেছি। এমনকি ছায়া যে প্রতিদিন আমার বাড়িতে কি রান্না হবে কিংবা জামাকাপড় কাচা বা বাসনকোসন ছাড়া কোন কথায় যার মুখ দিয়ে বেরোয় না, সেও বলে ফেলল, ‘দেখেছো দিদি এবার দুর্গা মা ও বড় রেগে গেছে। না হলে বাপের কালে কোনদিন শুনেছো সকালবেলায় সন্ধিপুজো আর ভোররাতে মায়ের অঞ্জলি। এবার সবটাই অদল বদল। একেই বলে ঘোর কলি। সব অসুর এই কলিতে মরবেই’।
ভাবতে ভাবতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে বুঝিনি, কিন্তু বিকেলে বোনের সঙ্গে মাঠের ধারে হস্তশিল্পের মেলায় দেখা করার কথা ছিল। পৌঁছে দেখি বোন তখনও আসেনি মেলায় এদিক-ওদিক ঘুরে দেখি খুব সুন্দর কিছু হ্যান্ডব্যাগ। তবে হাতে নিতে দেখি, তাতেও প্রতিবাদের রেখা সুস্পষ্ট। তারই মধ্যে একটা ক্যাপশন, খুব মনে ধরল! “রামধনুর সাত রং কিন্তু প্রতিবাদের একটি রং”। সত্যি এরকম একটি অমানবিক এবং হিংসাত্মক ঘটনা আজও যেন প্রতিটা মানুষকে আরো বেশি করে মানবিক করে তুলেছে। শ্রেণী-বর্ণ নির্বিশেষে আজও সব মানুষই যেন মনুষ্যত্বের ধর্মকে বেছে নিয়ে তাদের মত ও পথকে এক করে ফেলেছে। ইতিমধ্যেই জড়িয়ে ধরে বোন। হাতটা টেনে বলে, ‘তাড়াতাড়ি চল। বৃষ্টি নামবে’।
তড়িঘড়ি একটা টোটো ধরে পৌছে যায় মাসিমণির বাড়ি। তাদের পাড়ায় ঢুকে দেখি এক আশ্চর্য জিনিস প্রতিটি গলিতে দেওয়ালে ঢাক, কাশফুল, ঘট মায়ের আদি রূপের ছবি। তারই মধ্যে প্রতিবাদের বিভিন্ন চিহ্ন মশাল, মোমবাতি, কলম আরো কত কিছু আঁকা। মাসির পাড়ায় ওদের বাড়ির পুজোটাই একমাত্র পাড়ার পুজো। চুঁচুড়া শহরের খানিক দূরে সুগন্ধা ছাড়িয়ে একটু গ্রামের দিকে ওদের বাড়ি। মাসির বাড়ি পৌঁছাতে মাসির জিজ্ঞাসা? ‘পাড়ায় ঢুকে কি লক্ষ্য করলি’?
আমরাও সমস্বরে বলে উঠলাম, ‘কিগো মাসি কী ব্যাপার’! মাসি জানায় এবার তাদের বাড়ির পুজো শুধুমাত্র ঘটে হবে কিন্তু উৎসবের আবেশ থাকবে প্রতিটি বাড়ির দেওয়ালে প্রতিবাদের আদলে। মাসি স্কুল শিক্ষিকা এবং বরাবরই প্রতিবাদী। মাসি বিয়ে হয়ে এসে থেকে বনেদি শ্বশুরবাড়ি সব আভিজাত্য ধরে রেখেছে। কিন্তু গোঁড়ামিকে স্বচেষ্টায় অনেক বছর আগে বিসর্জন দিয়েছে।
আজ সারাদেশ তিলোত্তমার প্রতিবাদে রাস্তায়। সেখানে মাসির বাড়ি গলিতে যে এমন দৃশ্য থাকবেই তাতে হতবাক হওয়ার কিছু নেই। তাই ফেরার পথে দুই বোনে আলোচনা করি আর ভাবি বোধ হয় উৎসবের মধ্যে অন্যরকম উৎসব কোনদিন এইভাবে দেখব ভাবতেও পারিনি। হয়তো মানুষের সহ্য ও ধৈর্যের বাঁধ সত্যি সত্যি ভেঙে যায় অমানবিক অন্যায়ের জলোচ্ছ্বাসে, আজকের সমাজ তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
ঘরে ফিরে দেখি টি টেবিলের ওপর রাখা একটা উপহার। উপহারের উপরে লেখা ভালোবাসায় সুধা। বুঝলাম পাগলিটা আজ এসেছিল না বলে । না বলে আসা আর সারপ্রাইজ দেওয়া আমার ছোটবেলার বন্ধু সুধার স্বভাব। কিন্তু আজ এসে সে হয়তো নিজেই সারপ্রাইজ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। মেয়েটার শিল্পী সত্তা ছোট থেকেই প্রশংসনীয়। আজকাল ক্লে দিয়ে এত সুন্দর জুয়েলারি বানায় কি বলব। মোড়ক খুলতেই দেখি একটা পেন্ডেন্ট দুর্গা মায়ের মুখের আদলে। মায়ের মুখটা দ্বিখণ্ডিত তার একদিকে পরাজয়ের অশ্রু অন্যদিকে লজ্জার গ্লানি। অদ্ভুত সৃষ্টি সুধার। উৎসবে তার শিল্পী সত্তা প্রতিবাদের ভাষা ভোলেনি। বরং শিল্পের মাধ্যমে আরো বেশি করে প্রকাশ করেছে মনে মনে ভাবলাম। ঈশ্বর উৎসবের আলোয় এ কোন গ্রহণের ছায়া ফেলেছে কে জানে? এই অন্যায়ের ছায়া থেকে পৃথিবী খুব শীঘ্রই যেন মুক্তি পায়। ভাবতে ভাবতে অস্থির মনে ফিরে আসে।
মনে পড়ে যায় কত্তা বাড়ি ফিরে আঁকতে বসবেন তাই সমস্ত সরঞ্জাম রেডি করে ফেললাম। তাগিদটা আমারই বেশি ছিল একটা সাদা শাড়ি পুজোর মতো করে তাকে এঁকে দিতে বলেছিলাম। ওই শাড়ি পড়ে অঞ্জলি দেব। সেও রাজি কারণ, আঁকার থেকে বোধ হয় সে বেশি কিছু ভালোবাসে না। আমি সব রেডি করে রাখলাম। তিনি অফিস থেকে ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেরে দরজা বন্ধ করে নিজের কাজে মনোনিবেশ করলেন। আমিও পাশের ঘরে উসখুস করতে লাগলাম , সারারাত ঘুম এল না। ভেবে ভেবে কুল পেলাম না, সকালে আমার শাড়িটা ঠিক কিরকম সাজে সেজে উঠবে ! ভোররাতে চোখ লেগে এসেছিল, ঘুম যখন ভাঙল দেখি সকাল আটটা বেজে গেছে। দৌড়ে গেলাম, ঘর খুলে দেখি কত্তামশাই আঁকার শেষ করে ঘুমিয়ে পড়েছে। পাশে পড়ে আছে আমার সাদা শাড়িটা। যার উপর মায়ের দুটো আলতা মাখা হাত এবং তার উপর কালো কালো অক্ষরে লেখা –
“যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানম অধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥
পরিত্রাণায় হি সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাম।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥”
এই সিরিজের চতুর্থ কিস্তি পড়ুন এখানে: উৎসবে সামিল হওয়ার মনটাই নেই!




Be First to Comment