Press "Enter" to skip to content

অন্ধ স্কুলে আজও ঘণ্টা বাজে

দেবারতি মিত্র। সংগৃহীত ছবি

উৎপলেন্দু মণ্ডল

ভারতে ৭৫ তম গণতন্ত্রের উৎসবে, সাহিত্যে, সংবিধান রচনায় নারীদের অবদান কম নয়। কিন্তু বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতায় মেয়েদের মধ্যে যে কয়েকজন কবি স্বাক্ষর রেখেছেন প্রয়াত দেবারতি মিত্র তাঁদের অন্যতম। প্রথম কবিতা কৃত্তিবাসে, তারপর দেশ ইত্যাদি পত্রিকায়।

রবীন্দ্র-পরবর্তী কবিতায় জীবনানন্দ যেভাবে বাঁক পরিবর্তন করেছিলেন তারই উত্তরসূরীরা হলেন কৃত্তিবাসীরা। স্বয়ং কবি উৎপলেন্দুকুমার বসু স্বীকার করেছেন তাঁরা জীবনানন্দের সন্তান। এই পরম্পরা মেনেই দেবারতি মিত্রের কবিতা। তাঁর কবিতায় শুধু প্রত্যাহিক জীবনযাপনই নয়, কবির নিত্যস্থ জীবন প্রবাহমানতার দৃষ্টি আলাদা করে পাঠকের মধ্যে সঞ্চারিত করে।

দোপাটি ফুলের মত রোদ্দুরে/ পুবের বারান্দা ভার যাওয়ার আগেই /কে আমাকে জাগিয়ে দিল /আঁকাবাকা দীঘির জলে ঘুম ভাসা মাছ সাদা মেঘ/ হাঁসেদের ঢেউ /পৃথিবীর আরামের নিঃশ্বাস। ভোর বেলাকার গলন্ত নীল আর উড়ন্ত বাতাসের প্ররোচনায়/ আমার দামবদ্ধ কেটলিতে স্বপ্ন উথলে উঠলো/ চা ঢালা হলো/ পেয়ালারা আজ হাসিতে ভরতি/ লিকারের মতি গতি না বুঝেই দুধ চিনি/ চড়া আলোর সঙ্গে আকাশের লালচে আবার মত মিশে যেতে লাগলো…. (সকালের গার্হস্থ্য)

তথাকথিত নারী স্বাধীনতা সেখানে নেই বরং আছে সুন্দর কোন দূর দেশের পারির আহ্বান। মনে হয় তিনি পাড়ি দিচ্ছেন আমাদের মহাজগতের বিভিন্ন গ্যালাক্সির অস্তিত্বের সঙ্গে যেন তার পরিক্রমণ। ১৯৭৮ সালে সবে বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদল কিন্তু সেভাবে তাঁর কবিতায় প্রভাব পড়েনি। এবছরই তাঁর কাব্যগ্রন্থ “যুবকের স্নান” নামক কবিতা। কবির বয়স বাড়ার সঙ্গে কবিতা যাপন ও পাল্টে যায়। আমাদের প্রকৃতির চারপাশের মহাপ্রকৃতি তার সঙ্গে লীলায়িত এক একটি যেন মুহূর্ত । আমার অনন্ত স্বয়ম্বর ,অনন্ত বিবাহ সে শুধু তোমার সঙ্গেই। চন্দ্র সূর্য বায়ু চিরকাল সাক্ষী আমি ছেলেবেলা থেকে একটি করে নক্ষত্র গেঁথেছি ব্রহ্মাণ্ড আমার বরণমালা স্বামী ,আমি দময়ন্তী, তোমাকে আলিঙ্গন করে জীবনের যত কান্না আজ কেঁদে নিতে চাই।

দেবারতির প্রথম কাব্যগ্রন্থ “অন্ধ ইস্কুলে ঘন্টা বাজে”, সেই ঘন্টার আওয়াজ খুব বেশি অনুরণন তোলেনি। তখন কবিতার পাঠক ছিল। কিন্তু কবি ক্রমশ বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তিনি বিপ্লব নয় বরং বিষাদ ও হাহাকারের অস্তিত্ব নিয়ে ও এক অহৈতুকী ভূমিকা সর্বত্র। তিনি কবিতা সমগ্র ভূমিকায় লিখেছিলেন__

কবিতায় কোন চৌকো আকৃতির রত্নভারতী সিন্দুক নয়, দিগন্তের দিকে ঢেউ খেলানো অদৃশ্য বাতাসকেই আমি খুঁজি যদিও জানি তার দেখা পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

আধুনিক বাংলা কবিতায় এই কবি নির্বাসিত থেকেছেন। আগামী দিনে হয়তো নবীন পাঠক তার প্রিয়তম নেমেসিস ছেড়ে তাঁর কবিতার পাঠক হবে।

জলের মতো কবিতা তিনি লিখতে চাননি। কবিতার মধ্যে যা সচরাচর মহিলা কবিদের মধ্যে দেখা যায় না তিনি তাঁর সাধনা করে গেছেন । নিজেই বলে গেছেন আমার কবিতায় সমস্যা যেমন আছে তেমনি সমস্যা বিহীন নিষ্কলঙ্ক সৌন্দর্যের কথা আছে। সাধারণত নিজের জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই আমার বেশিরভাগ কবিতার জন্ম ।আমার মনের গড়নই যেন দুঃখী ।কবিতার ব্যাপারে আমি প্রতি পদে জীবনের উপর নির্ভর করি। জীবন আমাকে লিখিয়ে না দিলে আমার পক্ষে এক লাইন ও লেখা সম্ভব নয়। আমার স্টিমুলি দরকার। সুনীল শক্তিরা যে কনফেসন দিয়ে কবিতা জীবন শুরু করেছিল, অনেকটাই সেই রকম কিন্তু অন্যভাবে। সৌন্দর্যের এক অন্যতর বিভা তার গায়ে ।

মালার্মের একটি চিঠি (বন্ধুকে লেখা) তিনি লিখেছেন ‘সৌন্দর্য বিষয়ে একটি গ্রন্থের সূচনা করলাম আমার মন অসীমের মধ্যে সঞ্চারিত হচ্ছে আর তাই অসীমের তরঙ্গ অনুভব করতে পারে’ । অথচ পঞ্চাশের কবিরা যার সন্তান বলে স্বীকার করতেন সেই জীবনানন্দ লিখেছিলেন সৌন্দর্য রাখিছে হাত ক্ষুধার বিবরে। ক্ষুধা নয় আগামী দিনের কবিতার পাঠক সমালোচকরা যদি সত্যান্বেষী হন তবে দেবারতির কবিতায় বাঙালি নারী বিদগ্ধতার অন্য বিভা খুঁজে পাবেন।

না তিনি সেই ভাবে নারীবাদী কবি নন। নিজেই বলেছেন আমি তো নারী হিসেবে কবিতা লিখি না। তাই কবিতায় নারীর দৃষ্টিকোণের কথা কখনো ভাবিনি। আমি সচরাচর পুরুষদের স্নেহের ও করুণার চোখেই দেখি । আমার চেয়ে দুর্বলতর শ্রেণি বলেই তাদের মনে করি। আমার কবিতায় পুরুষের কাছে আনন্দ চেয়েছি। আমার কবিতায় পুরুষ স্বপ্নের মতন, তারা চিরকাল স্বপ্ন হয়ে থাকবে।

সে কারণে তিনি কুড়ি বছরের বড় কবি মনীন্দ্র গুপ্তকে হয়তো বা বিয়ে করেছিলেন । তিনি সে সময় ‘পরমা’ নামের বাৎসরিক একটি কবিতা সংকলন বার করতেন। নিজে কবি সুতরাং কবি দম্পতি নিজেদের মতো করে কাব্যচর্চা করতে পারতেন।

কবি দিবারতির ঈশ্বর ,হয়তো বা পুতুল ঈশ্বর সেখানে লিবিডো প্রবল ।কবিতায় লিখছেন_

আমার সর্বোচ্চ নিংড়ে খা তুই রাক্ষস
মা যেমন অহরহ তর্জন করতে করতে
সন্তানের মুখে তুলে দেয়, গুদে ভরা স্তন
কিরকম আমি তোকে দেব পুতুল ঈশ্বর কিম্বা
ঘুমন্ত উরুর একখানি
স্তব্ধগর্ভে
টেনে নিল দূর পাহাড়ের জন্ম দেশ
মিশে আছে সে সূর্যের স্মৃতি অলসতা
পাতায় পাতায় ঢাকা ঘন বন জঙ্গলের মেঘ।

তার কবিতার ভুবনে প্রেম অপ্রেম বিশ্বায়ন সবই আছে। ১৯৬৫-১৯৭১ এই সময়কালে যে কবিতা লিখেছেন তাতে নির্জনতাই প্রবল। ‘আমার প্রথম বই’ শীর্ষক গদ্যে কবি লিখেছেন বেশি চড়া টক ঝাল নুন মিষ্টি জীবন আমার কোনদিনই নয়। তখন তো আরো অন্তরালে নিবৃত জীবন কাটাচ্ছি নিয়ম করে কলেজে যেতাম না। বন্ধুবান্ধব বিশেষ কেউ ছিল না। কেন জানিনা একটা সময়ে পরে বাড়ির সকলের সঙ্গে থেকেও একলা হয়ে যেতে লাগলাম। শুধু নিজের মধ্যে বসবাস আর গভীর বিশদ আচ্ছন্নতা হয়ে গেল।

আসলে কবি প্রথম থেকেই একটু অন্যরকম নির্জনতা প্রিয় ,সে কারণেই মনের গহনে বার্তা উচ্চারিত হয় । সেই কবে গৃহশিক্ষক কবিতার খাতা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তারপর কৃত্তিবাস ,দেশ, সেই সময়ের প্রতিনিধি স্থানীয় পত্রপত্রিকায় লিখে গেছেন। প্রথম কাব্যগ্ৰন্থ কবি শম্ভুরক্ষিতের তদারকিতেই হয়েছিল। কিন্তু পাঠক সামান্য। তার কাব্য সমগ্র নামি প্রকাশনালয়া থেকেই বেরিয়েছে। কবিতার পাঠক কবেই বা বেশি ছিল!

দেবারতি সেই কবি যিনি নেপথ্যে বিচরণ করার আগেও লিখেছেন। লেখাই তার সন্তান। ব্যক্তি জীবনে নিঃসন্তান। স্বামীর মৃত্যু দেখেছেন । আবার একলা হয়েছেন । শুধু একটাই বলার, কবি দেবারতির সেই ভাবে মূল্যায়ন হয়নি। ভাগ্যিস তিনি facebook-এর কবি নন। ফেসবুকে অনবরত ব্যবহৃত করে তাঁকে কবি কীর্তি অর্জন করতে হয়নি। তাঁর অনুজ অনেক কবিকে দেখেছি তাঁকে ফোন করতে। সন্তানপ্রতিম কবিরাও তাঁর সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পেতেন। বলতে চাইছি অনেক কবির আশ্রয়স্থল ছিলেন তিনি। বিজ্ঞাপনে ঢেকে দেওয়া কবিদের থেকে তিনি সেকারণেই আলাদা।

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *