আসানসোল: ৫ বছর আগে ২০২০ সালের দুর্গাপূজোর সময় পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে নুনিয়া নদীতে ফেলে বন্ধু খুনের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত দুই ভাইয়ের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো। শুক্রবার আসানসোল আদালতের এডিজে স্পেশাল কোর্টের বিচারক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য এই সাজা ঘোষণা করেন। সাজাপ্রাপ্ত দুই ভাইয়ের নাম হলো রাহুল আকুড়িয়া ও মহঃ ইয়াকুব ওরফে সুশীল। দুজনের বাড়ি আসানসোল উত্তর থানার কাল্লা ইসিএল কোয়ার্টারে। বিচারক এদিন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা ঘোষণার পাশাপাশি ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা দেওয়ার নির্দেশ দেন। এই মামলার সরকারি আইনজীবী বা পিপি হিসেবে ছিলেন চিত্তরঞ্জন দে। আইও বা তদন্তকারী অফিসার হিসেবে ছিলেন আসানসোল দক্ষিণ থানার এসআই গৌতম কর্মকার। খুন হওয়া যুবকের নাম হর্ষবর্ধন চৌহান ওরফে বিট্টু (২৩)। তার বাড়ি আসানসোল উত্তর থানার কাল্লা আইওসি এলাকায়। এই মামলায় আসানসোল আদালতে মামলা চলাকালীন মোট ২৫ জন সাক্ষ্য দান করেন। তার মধ্যে আইও, চিকিৎসক ও অন্যান্যরা ছিলেন। সব সওয়াল-জবাব শেষে বৃহস্পতিবার বিচারক দুই ভাইকে এই খুনের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন।
জানা গেছে, খুন হওয়া যুবক বয়সে বছর খানেকের বড় হলেও সাজাপ্রাপ্ত দুই ভাইয়ের বন্ধু ছিলো। গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে ছোট ভাই মহঃ ইয়াকুব ওরফে সুশীল আসানসোল জেলে ছিলো। শারীরিক সমস্যা হওয়ায় বড় ভাই রাহুল আকুড়িয়া ৭/৮ মাস আগে জামিন পেয়েছিলো।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ১৭ অক্টোবর বিকেলে আসানসোলের কাল্লার আইওসি এলাকার বাসিন্দা হর্ষবর্ধন চৌহান ওরফে বিট্টু দুই ভাই রাহুল আকুড়িয়া ও মহঃ ইয়াকুব ওরফে সুশীলের সঙ্গে নিজের মোটরবাইক করে বেরিয়েছিলো। পরে তারা কাল্লা রোডের একটা শ্মশানে মদ খায়। এরপর সেখান থেকে তারা মোটরবাইকে ঘাঘরবুড়ি মন্দিরে আসে। সেখানে তারা একটা দোকান থেকে সিগারেট কেনে। তারপর তারা মন্দির লাগোয়া নুনিয়া নদীর পাশে বসেছিলো। এরপরে হর্ষবর্ধন চৌহানের মোটরবাইক নিয়ে দুই ভাই এলাকা থেকে চলে যায়। এদিকে ছেলে বাড়ি না ফেরায় হর্ষবর্ধনের বাবা নরেন্দ্রনাথ চৌহান খোঁজাখুঁজি করেন। কিন্তু ছেলের কোন হদিশ পাননি। এরপর তিনি আসানসোল উত্তর থানায় একটি মিসিং ডায়েরি করেন। তিনদিন পরে ২০ অক্টোবর ঘাঘরবুড়ি মন্দির কতৃপক্ষ আসানসোল দক্ষিণ থানায় ফোন করে জানায়, নুনিয়া নদী থেকে পচা গন্ধ বেরোচ্ছে। তাদের মনে হয় কোন মৃতদেহ নদীতে পড়ে আছে। এরপর পুলিশ এলাকায় গিয়ে এক যুবকের পচাগলা দেহ নদী থেকে উদ্ধার করে। পরে নিখোঁজ হর্ষবর্ধনের বাবা ও পরিবারের সদস্যরা সেই সনাক্ত করেন। ২১ অক্টোবর আসানসোল জেলা হাসপাতালে সেই মৃতদেহর ময়নাতদন্ত হয়। তার রিপোর্টে জানা যায়, যুবককে পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে খুন করা হয়েছে ও পরে তার গলায় জুতোর ফিতে বা লেস ফাঁস দিয়ে নদীর জলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। যুবকের বাবা তার লিখিত অভিযোগে দুই ভাইয়ের সঙ্গে বেরোনোর কথা বলেছিলেন, তাই তার ভিত্তিতে পুলিশ তাদের নাম সহ ২১ অক্টোবর এফআইআর করে। দীর্ঘ তল্লাশির পরে ২৪ অক্টোবর দুই ভাইকে এই খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার করে। তাদেরকে পুলিশ রিমান্ডে নেয়।
রিমান্ডে থাকাকালীন দুই ভাই এই মামলার আইও বা তদন্তকারী অফিসারের কাছে সবকিছু স্বীকার করে। তাতে তারা বলে, ঘাঘরবুড়ি মন্দিরের কাছে নুনিয়া নদীর পাশে তিনজন নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বসেছিলো। তখন হর্ষবর্ধন মহঃ ইয়াকুব ওরফে সুশীলের স্ত্রী নিয়ে কুমন্তব্য বা খারাপ কথা বলে। তা শুনে সে রেগে যায়। এরপর সুশীল হাতের সামনে থাকা পাথর দিয়ে হর্ষবর্ধনের মাথায় আঘাত করে। তাতে হর্ষবর্ধন রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়ে। এরপরে রাহুলও পাথর দিয়ে তার মাথার মারে। এরপর মৃত্যু নিশ্চিত করতে তারা তার গলায় জুতোর ফিতে বা লেসের ফাঁস দেয়। দেহ নদীতে ফেলার আগে তারা হর্ষবর্ধনের পকেট থেকে মানিব্যাগ, মোবাইল ফোন ও ট্যাব নেয়। সেই মানিব্যাগে হর্ষবর্ধনের দুটি এটিএম কার্ডও ছিলো। এরপর দেহ নদীতে ফেলে তারা হর্ষবর্ধনের মোটরবাইক নিয়ে সোজা কাজোড়ায় নানি বা দিদিমার বাড়িতে যায়। সেখানে দুই ভাই ভিজে যাওয়া জামাপ্যান্ট ছাড়ে। হর্ষবর্ধনের মোটরবাইকের নম্বর প্লেট খুলে, তা সেখানে লুকিয়ে রাখে। এরপর নম্বর প্লেট বিহীন মোটরবাইক নিয়ে চলে আসে হিরাপুর থানার বার্নপুরের রাঙ্গাপাড়ায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সেখানে সেই মোটরবাইক তারা লুকিয়ে রাখে। একইভাবে দুই ভাই হর্ষবর্ধনের ট্যাব, মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ রেখে দেয়। মামলার তদন্তকারী অফিসার দুই ভাইয়ের কথা মতো সবকিছু উদ্ধার করে।
তদন্তকারী অফিসারকে ঘাঘরবুড়ি মন্দির এলাকায় থাকা লোকজনেরা বলেন, ঘটনার দিন তিনজনকে সেখানে আসতে দেখেছিলো। কিন্তু বেরোতে দেখেছিলো দুজনকে। পুরো তদন্ত ও জেরায় পুলিশ নিশ্চিত হয়েছিল যে, স্ত্রীকে নিয়ে কুমন্তব্য করায় রাগে দুই ভাই এই ঘটনা ঘটায়। সব তথ্য সহ চার্জশিট তদন্তকারী অফিসার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আদালতে জমা দিয়েছিলেন। যার ভিত্তিতে সওয়াল-জবাব শেষে দুই ভাইয়ের সাজা হয়েছে বলে জানা গেছে।










