রুমেলা রায়
২৩ এপ্রিল, ১৯৯২—এই দিনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ভারতীয় সিনেমার মহীরুহ সত্যজিৎ রায়। তবে আজও তিনি বেঁচে আছেন তাঁর ছবির মধ্য দিয়ে। আজও তিনি রয়ে গেছেন তাঁর ছবির ভাষায়, দর্শনের গভীরতায় এবং সৃজনশীলতার অসাধারণতায়। শুধু ভারতেই নয়, হলিউডের পরিচালকরাও এখনও তাঁর পরিচালনার কৌশল থেকে শিক্ষা নেন।
সিনেমার পর্দায় সমাজ, রাজনীতি ও নারীর অবস্থান নিয়ে গভীর বার্তা দেওয়াই ছিল তাঁর ইউএসপি। ফিল্ম স্কুলে না পড়েও তিনি যেভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ শিখেছিলেন এবং ‘পথের পাঁচালী’ দিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন ফেলেছিলেন, তা আজও বিস্ময় জাগায়।

তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী—পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, শিল্পী, সঙ্গীতকার, লেখক, এমনকি বইয়ের প্রচ্ছদ ও পোশাক পরিকল্পনাকারীও। মৃত্যুশয্যায় তাঁর হাতে উঠেছিল ‘অস্কার অনারারি অ্যাওয়ার্ড’—যা আজও একজন ভারতীয় হিসেবে একমাত্র তাঁর প্রাপ্তি। এছাড়াও ৩৭টি জাতীয় পুরস্কার, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।
সত্যজিৎ রায়ের ছবিগুলো শুধুই বিনোদন নয়—তাতে ফুটে উঠেছে সময়ের সত্য। ‘জলসাঘর’, ‘চারুলতা’, ‘দেবী’ থেকে ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’—প্রতিটি ছবিতে সমাজের বাস্তব চিত্র গভীরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। নারীচরিত্রগুলোর ভাবনা, সংগ্রাম ও আত্মপরিচয় নিয়ে তাঁর কাজ আজও অনন্য। ‘মহানগর’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘চারুলতা’ এই উদাহরণগুলির মধ্যে অন্যতম।
সমালোচকদের মতে, তিনি ছিলেন ‘দৃশ্যের কবি’। সংলাপ নয়, তাঁর ক্যামেরা ও দৃশ্যবিন্যাসই ছিল গল্প বলার প্রধান হাতিয়ার। ‘নায়ক’-এর স্বপ্নদৃশ্য হোক বা ‘চারুলতা’-র নিঃশব্দ মুহূর্ত, সবেতেই বুনেছেন গভীর অর্থ।
শুধু সমাজ নয়, রাজনীতি ও অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়েও তিনি বক্তব্য রেখেছেন ছবির মাধ্যমে। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘গণশত্রু’, ‘জন অরণ্য’—প্রতিটি ছবিই একেকটি রাজনৈতিক ভাষ্য।
সঙ্গীতেও ছিল তাঁর দক্ষতা। ‘তিন কন্যা’ থেকে শুরু করে বহু ছবিতে নিজেই সুর দিয়েছেন। ধ্রুপদী ভারতীয় সঙ্গীত এবং ওয়েস্টার্ন ফর্মের অপূর্ব মিশ্রণ ছিল তাঁর স্বাক্ষর।
চারুলতার পরে তিনি ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যান—’গুপি গাইন বাঘা বাইন’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘সীমাবদ্ধ’, ‘নায়ক’, ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ প্রভৃতি ছবিতে তিনি প্রমাণ করেন, তাঁর কল্পনা ও নির্মাণশৈলীর কোনও সীমা নেই।
আজও তাঁর ছবি শুধু স্মৃতির পাতায় নয়, নতুন প্রজন্মের চলচ্চিত্রচর্চার পাঠ্যবইতেও জায়গা করে নিয়েছে। সত্যজিৎ রায় মানেই সময়কে ছুঁয়ে যাওয়া এক শিল্পীর নাম, যাঁর আলোয় পথ চলে ভারতীয় সিনেমা।



Be First to Comment