রক্তিম ভট্টাচার্য
এত অন্ধকার গর্ত আগে কোনওদিন দেখেনি ও। বড় চাদরের মতো ছাপোষা বাতাসে কেউ যেন ঘন আলকাতরা ঢেলে দিয়েছে। যে অন্ধকারের অনেকক্ষণ চেয়ে থাকলে চোখ সয়ে যায়, তেমন অন্ধকার একেবারেই নয়। নিশ্ছিদ্র, নিরেট জমাট-বাঁধা অন্ধকার; বেশিক্ষণ চেয়ে থাকলে বরং অন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তবুও ও চেয়ে থাকতে লাগল। চোখের পাতাদুটো হাতের আঙুলে করে টেনে ধরে দেখে নিতে চাইল সামনের কুহক। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কিছু ঠাহর করা দুঃসাধ্য। অতএব, এগিয়ে যাওয়াই শ্রেয়; কারণ, ফিরে তাকানোর পথ আর নেই।
গর্তের ভেতর গরম লাগার কথা। ভ্যাপসা গন্ধে গুমোট হয়ে শরীরে অস্বস্তি তৈরি হবার কথা। কিন্তু না। এই গর্ত যেন দুনিয়ার সমস্ত গর্তের থেকে আলাদা। কেউ যেন তৈরি করেছে বাকি পৃথিবীর থেকে এই গর্তকে আলাদা করতে চায় বলেই। ও যত এগোচ্ছে, তত যেন গভীর শীত ওত পেতে বসে আছে, মনে হচ্ছে। বরফের ছুরির মতো একটা শীতল হাওয়া চামড়াকে কেটে ফেলতে চাইছে ফালা ফালা করে। ও যতটা সম্ভব জ্যাকেটটাকে জড়িয়ে ধরে রাখতে চাইল। তাতেও শীত কমছে না। প্রতি পদক্ষেপে যেন তাপমাত্রার পারদ দুই ডিগ্রী করে নেমে যাচ্ছে। ওর মনে হচ্ছে, গর্তের বাইরের পৃথিবীর উষ্ণতা যেন এর থেকে অনেক আরামদায়ক ছিল। কিন্তু, মানুষের রক্তের উষ্ণতার মতো ক্লান্তিকর আর কিছু নেই। ফলত, ওর সহ্য হয়নি। জেনে-বুঝেই এই গর্তে পা বাড়িয়েছে। সেইমতো প্রস্তুতি নিয়ে শীতবস্ত্রও সঙ্গে রেখেছে। তবে এই গভীর গর্তের ভেতরে যে তুষারযুগ এখনও শেষ হয়নি, সেটা ও জানত না।
হিমরাজ্যের অন্ধকারতম রাজধানীতে প্রবেশ করার জন্য ও এগিয়ে চলল আরও সন্তর্পণে। বরফের কুচো হাওয়ায় ভেসে চোখে-মুখে এসে লাগছে। গায়ের চামড়ার রঙ একটু একটু করে নীল হতে শুরু করেছে। গালে হাত দিয়ে বুঝতে পারল, একটু যেন কুঁচকে গেছে। আঙুলের ডগায় উপলব্ধি করা যাচ্ছে শিরার প্রতিটা ভাঁজ। গর্তের ভেতরের অন্ধকার এখনও যথেষ্ট গভীর। সামান্য একটু আলোর উষ্ণতা হয়ত কিছুটা আরাম দিতে পারত। কিন্তু ভাবা মানেই সময় নষ্ট। অতএব, এগিয়ে যেতে যেতেই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার প্রস্তুতি নিতে থাকল ও।
কতক্ষণ হেঁটেছে মনে নেই। কিন্তু সম্ভবত এক যুগ পর ও এসে পৌঁছল সমতল ভূমিতে। হড়কে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু, গর্তের ভেতরের পিচ্ছিল পথ ও যেভাবে পাড়ি দিয়েছে, তার কাছে এটুকু তো কিছুই নয়। ও আগে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বুঝে নিতে চাইল সত্যিই দাঁড়িয়ে আছে কি না। শীতও এখন অনেকটা সয়ে গেছে। ওর গায়ের রঙ এখন পুরোপুরি নীল। শীতবস্ত্র খুলে ফেললেও এর থেকে নীল হবার আর সম্ভাবনা নেই। তবুও, ও অনেকক্ষণ ধরে দেখে নিল চারপাশ। বরফের বড় বড় স্তম্ভ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে একেকটা বড় গর্তের মতো অংশ, ভেতরটা রক্তের মতো লাল। এত নীলের মাঝে রক্তবর্ণ কেমন যেন বেমানান। ওর মনে হল, নিজের শরীরের থেকে খানিকটা নীল দিয়ে লাল অংশগুলো নীল করে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু, তাতে নিজের শরীর লাল হয়ে যাবে আর এমনটা বৃত্তাকারে চলতেই থাকবে। তাই ও এই ভাবনাকে অব্যাহতি দিয়ে খুঁজতে চাইল এখানে কোনও মানুষের চিহ্ন রয়ে গেছে কি না। যদিও, থাকার কথা একেবারেই নয়। কারণ, এই স্থান জীবিত মানুষদের জন্য নয়। ও-ই সম্ভবত প্রথম জীবিত মানুষ, যে এখানে আসতে পেরেছে।
কিন্তু, জীবিত না হোক, মৃত মানুষ তো তুষারের রাজধানীতে অমরত্ব পেতেই পারে!
পেছন থেকে একটা হাত কাঁধে পড়তেই চমকে উঠল ও। আরেকটা নীল রঙের মানুষ! কিন্তু, সে সম্পূর্ণ নগ্ন। মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরোটাই নীল, শরীরের কোনও অংশে কোনও চুলের অস্তিত্ব নেই। সে একদৃষ্টে চেয়ে আছে ওর দিকে। হয়ত মেপে নিতে চাইছে নীলের ঘনত্বের ফারাক।
“কে আপনি?”
উত্তর দিল না আগন্তুক। একবার নিজের দিকে, আরেকবার ওর দিকে পালা করে তাকাতে লাগল। নিজের নগ্নতার জন্য কোনও লজ্জাবোধ যে তার হচ্ছে না, তা স্পষ্ট।
“আপনি কি এখানেই থাকেন? কে আপনি?”
আরেকটু গলা তুলে প্রশ্ন করল ও। যদিও বুঝতে পারল, অত্যধিক ঠাণ্ডায় গলার স্বর প্রায় শোনা যাচ্ছে না নিজের কানেই।
একটু যেন ঠোঁট নড়ল আগন্তুকের। বলতে চেষ্টা করল সে কে। কিন্তু কিছু বোঝা গেল না।
ও বুঝতে পারল পরিবেশটা অস্বস্তিকর হয়ে উঠছে। একজন সম্পূর্ণ নগ্ন মানুষের সামনে সম্পূর্ণ পোশাকাবৃত হয়ে থাকা অপমানজনক। তাই ও ধীরে ধীরে নিজেকে পোশাক-মুক্ত করতে শুরু করল। শেষ সুতোটা অবধি খুলে ফেলা পর্যন্ত আগন্তুক একই ভাবে চেয়ে রইল ওর দিকে। পুরোপুরি নগ্নতায় নিজেকে উন্মোচিত করার পর অবশেষে তার মুখে দেখা গেল তৃপ্তির হাসি।
“এখন আরাম লাগছে?”
আগন্তুকের স্পষ্ট স্বর শুনে চমকে উঠল ও। এবং বুঝতে পারল, ওর সত্যিই আগের থেকে অনেক বেশি আরাম লাগছে। তুষারপ্রদেশের প্রবল শীত যেন ওর গায়েই লাগছে না। সম্পূর্ণ নীল শরীরে হাওয়া যেন আদরের প্রলেপ বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। তাপমাত্রা পরিবর্তনে যেখানে যেখানে স্বল্প ক্ষতস্থান তৈরি হয়েছিল, সেসব যেন কেউ জাদুবলে পরিষ্কার করে দিয়েছে। ও বিস্ময়ে অভিভূত হল, এবং একই সঙ্গে ভীষণ খুশিও হল।
“হ্যাঁ, আরাম লাগছে সত্যিই। কিন্তু, আপনি কে?”
স্মিত হেসে আগন্তুক জানাল, “আমি আসলে কেউ-ই নই। আপনিও কেউ নন। এটা সভ্যজগত নয় যে প্রত্যেককে একটা পরিচয় নিয়ে ঘুরতেই হবে। এখানে আমরা কেউ-ই কেউ নই। প্রত্যেকেই তুষারযুগের মানুষ। আরও ভালো করে বললে, নায়িকা। তুষারযুগের নায়িকা।“
“নায়িকা? নায়িকা কেন?”, কৌতূহল গাঢ় হয়ে উঠল ওর চোখে।
আসলে আমরা এখানে প্রত্যেকে একা থাকি। একসঙ্গে থাকি, কিন্তু একা। আর এখানে কোনও পুরুষ নেই। আমরা সবাই নারী। এই একটাই পরিচয় নিয়ে বেঁচে আছি সবাই।
ওর মনে খুশির দোলা আরও প্রাণ-চঞ্চল হয়ে উঠল। ও একদিন খুঁজেছিল এমন এক প্রদেশ, যেখানে কোনও পুরুষ থাকবে না কখনও। শুধু নারী আর নারী। সেখানেই মুক্তি, সেখানেই প্রাণোচ্ছল আনন্দ।
ওর মনের কথা পড়ে নিয়েই যেন আগন্তুক বলল, “কিন্তু জানো তো, পুরুষ না থাকায় আমাদের এই প্রদেশে উষ্ণতার বড় অভাব। সারা জীবনই প্রবল শীতে আমাদের জীবন। কোনও বৈচিত্র্য নেই। তবে, শান্তি আছে। লড়াইও আছে, যুদ্ধও আছে। রোগ-অসুখ আছে, রাজনীতি আছে। আর, গান আছে। মাতালের মতো, নদীর মতো, আকাশের মতো গান আছে। গাইবে তুমি?”
ওর মুখে কোনও কথা জোগাচ্ছে না। প্রশ্নের পর প্রশ্ন ভিড় করে আসছে মনে।
“পুরুষ নেই তো আনন্দের কথা। কোনও দুঃখ নেই, জ্বালা-যন্ত্রণা নেই, শারীরিক নির্যাতন নেই। তাহলে কষ্ট কীসের? লড়াই-ই বা কীসের?”
আগন্তুক এবার হাসতে শুরু করল। অট্টহাস্য। নিঃসীম নৈঃশব্দ্যের মতো হাসি। চিৎকারের মতো হাসি। গর্জনের মতো হাসি।
“তুষারযুগে অরক্ষিত আর সুরক্ষিত – এই দুই শব্দের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই। যে ভালোবাসা, সে-ই হত্যা। যে শিকল, সে-ই শঙ্খনাদ, যে অতৃপ্তি, সে-ই মহৎ, আর যে পুরুষ, সে-ই নারী। বলেছি না, আমরা সভ্যজগতের অধিবাসী নই, যেখানে পুরুষ আমাদের শত্রু। আমাদের প্রদেশে সবাই সবার শত্রু এবং বন্ধু। এই ধূসর কল্পলোকে তোমায় স্বাগত।“
যেন বহুযুগের ওপার হতে ভেসে এল আগন্তুকের গলার স্বর। প্রায় অস্পষ্ট, অথচ তীক্ষ্ণ আর্তনাদের মতো তীব্র।
চোখ ভিজে এল ওর। তবে কি ওর স্বপ্নের প্রদেশ অধরা? ওর কি এখানেও কেউ থাকবে না? সেই নিরবচ্ছিন্ন লড়াই নিয়েই বাঁচতে হবে আবারও? কী লাভ হল এত সংগ্রাম করে এখানে এসে? এর থেকে তো বাইরেই সে ভালো ছিল।
“আর ফেরার উপায় নেই। এবার চলো, যেতে হবে। আমাদের সময় সমাসন্ন।“
বলতে বলতে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে শুরু করল আগন্তুক।
কুহকের অলীক রাজ্যে নতুন জীবন শুরু করতে যাবার আগে ও একবার নিজের ফেলে দেওয়া পোশাকের পকেট থেকে ধারালো ছুরিটা বের করে নিল। বরফের কুচোয় মুহূর্তে সফেন হয়ে উঠল। চকচকে আলোয় আরও ঝলসে উঠল ধাতব ফলাটা।
এবার ও এগিয়ে চলল হিমশীতল মায়াপ্রদেশের আগন্তুকের হারিয়ে যাওয়া পথে।
Be First to Comment