হেমন্ত সরখেল
নন্দদার স্কুলে নতুন টিচার। বয়সের মাঝখান থেকে হঠাৎ টুপ করে খসে পড়েছেন যেন খেজুর কাঁটায়। এই পৃথিবীটা যে ব্রহ্মাণ্ডে সর্বাধিক নিকৃষ্ট জায়গা এটা সবসময় বুঝিয়ে দেন হাবেভাবে লস্টপ্রপার্টি সিট। এটাই আমাদের দেওয়া নাম। সকলেরই একাধিক নাম থাকে এই রঙ্গদেশে। একটি আসল, অপরটি কৃতকর্মের দোসর। লস্টপ্রপার্টি বাবুর নামটি শুধু তর্জমার প্রতিফলক, হারাধন থেকে লস্টপ্রপার্টি। স্কুলে প্রথমদিন এসেই হম্বিতম্বি। বিনোদা ভাবে কেন বেঁকে বসেছেন? ধুলোরা কি এবার আলমারির নাগরাই হবে? গ্লোব কেতরে কেন? ছড়ি রাখেন না? সব ছাত্রই কি বৃত্তিপ্রাপ্তযোগ্য? একটাও গাধা নেই, যাকে মানুষ করতে হবে? তাহলে তো ওনার স্কুলে কোন কাজই রইল না!
ঝোড়ো ইনিংস উপহার দেওয়ার পর কাঠের চেয়ারে বসলেন। ক্যাঁঅ্যাঅ্যাচ করে কেদারা কহিল- বাপু, তানপুরা সামলে! রাবণের দশ মাথাও একটি ঘাড়কে আশ্রয় করে বহাল তবিয়তে ছিল, তারা ঘাড়ের মালিককে চিনতো। তবে, না তুমি তোমার বহুভঙ্গ প্রকোষ্ঠসমূহ চেন, না আমার চার্জবাহককে! এমন করে বডি ফেললে তোমার সত্যই বিদ্যালয়ের পথ অবরুদ্ধ হবে। আমি নিজেকেই ছেতরে দেব, চিকিৎসাসদন, লজ্জা ইত্যাদি ইত্যাদি। লস্টপ্রপার্টি বদনে আরো নীরসতা এনে নন্দদাতে মুখাতিব হলেন। বোঝা গেল, পরিবেশ পছন্দ হয়নি।
– আমি আমার মতো আসবো যাবো। অমুকবাবু, তমুক বিভাগের যিনি আমলা, আমার জুটির ভাই। কাজে কাজে কাজেই, আমি কোন দায়িত্বে থাকবো না। স্পোর্টসে রুচি নেই, সংস্কৃতি বলতে বুঝি শুধু খাওয়া। গাধা ছাড়া পড়িয়ে মজা পাই না। মানুষকে মানুষ করার কোনো মানেই হয় না। ওতে কৃতিত্বও নেই। এমতাবস্থায় আপনি উইদাউট এল পি সি পে দিতে থাকুন। গতস্কুলের ভাঙা চালের টিনের দাম কমিটি হিসেব করছে। ওটা হয়ে গেলেই, এল পি সি চলে আসবে। আর, মিড ডে মিলের ব্যাপারটা আমিই দেখবো। ওটা আপনাকে আমার হাতে ছেড়ে দিতে হবে। তবে রিপোর্ট যেমন পাঠাচ্ছেন, তেমনই পাঠাতে থাকবেন। আমি আবার অঙ্কে বরাবরই উইক। অতএব খাতা দেখা, প্রশ্ন তৈরী করা অথবা কোনো ক্লাসের ক্লাস টিচার বানিয়ে দিলেন, সেটা যেন করবেন না। বোঝা গেল?
নন্দদা চিনলেন, চলমান জতুগৃহ কাকে বলে! ভাবলেন, ঘুড়ি উড়ুক, লাটাই তো রইলই।
গোলা। ক্লাস থ্রি। গোলা মানে আগুনের গোলা। বড়ো হয়ে গেলেই বিপদ, এই সারমর্ম প্রস্ফুটিত হতেই তিন বছর ধরে একই কামরায় আছে। এবং নন্দদার জন্য সব করে। করতেও পারে। ওর জন্যই সমস্ত বারোয়ারি চাঁদার চাপ থেকে মুক্ত উনি। ওরও আসল নাম একটা আছে হয়তো, সেটি ওর উচ্চ বেগের কারণে বিদ্যালয়ে দেহ রেখেছে।
তা, সে এসে খবর দিয়ে গেল, আজকাল চাল বেশী লাগছে, ডাল ঘন হচ্ছে। সব্জি ঝাল ধারণ করে ব্যক্তিবিশেষের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত। নন্দদা সবটাই বুঝলেন। বিশ্বস্ত বাতাসেরাও ঘন হচ্ছিল কানে। ফিসফাস। বলদ সর্বদাই কলুর অনুগত। সন্ধেতে প্রায়ই দামুর মা এসে ঘুরে যায়। এতো হুকুম যে আর সহ্যি হয় না কো বাপু!
রবিবার গোলা সাথে রইল। যখন প্রপার্টির অধিষ্ঠান দেখতে নন্দদা সে গ্রামে চুপচাপ উপস্থিত হলেন তখন আমাদের আলোচ্য হারাধন বাবু একমাচ্ছাদিত বস্ত্রখন্ডটির খুঁটে বুনো আলু বাঁধছেন। খানিক দূরত্বে ক্ষেতের আলে হরা-ভরা তৃণে মুখ ডুবিয়ে তেনার পোষ্য গো। কামিজে টান পড়তেই নন্দদা ইশারা পেলেন গোলার। পেছিয়ে এসে বাঁক নিয়েই সামনে সটান প্রায় ভঙ্গুর ঝোপড়িতে ক্যাঁচোর ম্যাঁচোর। লুটোপুটি, মৃত্তিকাশ্রিত মনুষ্যশাবকদল। ডালিমগাছে ঝুলছে তাদের ছেঁড়া গেঞ্জি ইত্যাদির সাথে প্রাত্যহিক ব্যবহৃত শান্তিনিকেতনী ঝোলা। দেখেই চেনা গেল। পারিবারিক এ হেন আদুল নৈসর্গিকতা মন প্রাণ হরণের আগেই আবার কামিজে টান। বুকে পাথর নিয়ে ফেরৎ এলেন নন্দদা। দেখে এলেন, বুঝে এলেন। লস্ট কেন লস্ট।
এর পরের ইতিহাস খসড়া। একদিন ছকে বাঁধা গোলা স্কুলের বাইরে পায়ে পা বাঁধিয়ে ইচ্ছাকৃত শয্যা নিল। শান্তিনিকেতনী থেকে শষ্যাদির কিয়দ্দংশ টুঁকি দিয়ে জানান দিল হাল-হকিকৎ। গভর্নমেন্টকে দেওয়া নন্দদার রিপোর্টে লেখা ছিল না, সুবৃহৎ পারিবারিক অবয়ব রক্ষার্থে লস্টপ্রপার্টিবাবু হাতটানে অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন, যাহার সহিত ক্ষুন্নিবৃত্তিও বিষমাবস্থায় প্রকট একটি অনুচ্চারিত বিষয়। আরও লেখেননি – উনি অভাবী, স্বভাবী নন। তাও শিক্ষা বিভাগ তাঁর অ-বলা কথাকে কুসদৃশকথা মেনে নিয়ে প্রপার্টিকে অন্যত্র ট্রান্সফারের সিদ্ধান্ত নিল।
গোলা কহিল- এখন আর রান্নাগুলান ঝাল হয় না।
নন্দদা হাই তুলে পা টান করতে করতে বললেন- দরজার কাছেই থাকবি, বড্ডো ঘুম পায় এই দুপুরভাতের পরে। এখন আর জ্বালাস নে!
———
খুব সুন্দর লেখা।