Press "Enter" to skip to content

শনিবারের গল্প/ স্মৃতির সুটকেস

রাজশ্রী মণ্ডল

আজকের চায়ের টেবিলে রুচি এক ঘোষণার মতো বলল, “আজ ঈদের ছুটি, বুঝলে! তাই ভাবছি সবাই মিলে ঘর পরিষ্কারের কাজে নেমে পড়ব। তবে সবাইকে সাহায্য করতে হবে।” ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলল, “সবাই কিন্তু হাতে হাতে কাজ করবে। আজ বিশেষ কিছু রান্না করব না, শুধু কাঁচা লঙ্কা দিয়ে পাতলা মুরগির ঝোল আর ভাত।” শ্বশুর-শাশুড়িও তাতে সম্মতি দিলেন।

শাশুড়ি বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। সবার আগে তো আলমারির ওপরে রাখা সেই বিশাল সুটকেসটা নামিয়ে পরিষ্কার করো।”

রুচিও তাতেই রাজি। ছেলেকে দিয়ে সুটকেসটা নামিয়ে আনা হলো। খুলতেই ছেলে এক পুরনো জরিপাঞ্জাবি বের করে জিজ্ঞেস করল, “মা, মনে আছে? সরস্বতী পূজায় দাদান আমাকে প্রথম এই পাঞ্জাবিটা দিয়েছিল। তখন আমি মাত্র পাঁচ বছরের ছিলাম। এটাই ছিল আমার প্রথম পাঞ্জাবি।”

রুচি মাথা নাড়িয়ে স্মৃতি মনে করল। ঠিক তখনই রূপসা এগিয়ে এসে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “ওমা! ভাই কিছু দেখাচ্ছে?”

রুচি হাসতে হাসতে বলল, “সুটকেসটা একটু গুছিয়ে নিচ্ছি।“

রূপসা তখন সুটকেসের মধ্যে হাতড়ে কিছু খুঁজতে থাকে এবং এক সময় একটা বেতের টুপি পেয়ে যায়। উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল, “মা, মনে আছে? এই টুপিটা আমি কিনতে চেয়েছিলাম! তুমি কিছুতেই কিনে দিচ্ছিলে না, তাই আমি রাগ করে কাকিমনির হাত ধরে হোটেলে চলে গিয়েছিলাম। তারপর পরের দিন যখন সবাই সমুদ্রস্নানে নেমেছিল, কাকিমনি এসে পিছন থেকে আমার মাথায় টুপিটা পরিয়ে দিয়েছিল। সে আনন্দ আজও বলে বোঝানো যাবে না।”

এদিকে রুচির শাশুড়ি এসে বললেন, “রুচি, আমি একটু জলখাবার বানিয়ে নেব?”

রুচি উত্তর দিল, “মা, একটু অপেক্ষা করো। সৌম্য বাজার থেকে কচুরি, তরকারি আর মিষ্টি আনতে গেছে।”

ঠিক তখনই শাশুড়ির চোখে পড়ে একটা সুন্দর অ্যাপ্লিক করা শাড়ি। তাকিয়ে জানতে চাইলেন, “এই শাড়িটা এখানে এলো কী করে?”

রুচি মুচকি হেসে বলল, “আমার বিবাহবার্ষিকীতে আপনি দিয়েছিলেন। একদিন জুতোর হিলে শাড়িটা এমনভাবে পেঁচিয়ে গিয়েছিল যে অনেকটা ছিঁড়ে যায়। তাই পরে আর পরিনি, ফেলে দিতেও মন চায়নি। কারণ এটা আপনার দেওয়া। তাই ঠিক করেছিলাম রিপু করিয়ে রেখে দেব।”

শাশুড়ি হাসলেন। রুচি আরও বলল, “দেখুন মা, আমি রিজু আর রূপসার জন্য একই রকম দুটো সোয়েটার বানিয়েছিলাম, যত্ন করে রেখে দিয়েছি। যদি সম্ভব হয়, ভবিষ্যতে ওদের ছেলেমেয়েদের দেব।”

এদিকে রিজু সুটকেস থেকে একটা রিমোট ট্রেন বের করে আনন্দে বলে উঠল, “এটা তো দাদান আমাকে জন্মদিনে দিয়েছিল! পাঁচ বছরের জন্মদিনে দোকানে নিয়ে গিয়ে বলেছিল, ‘তোমার যেটা পছন্দ হয়, সেটাই নাও।’ আমি এক গাড়ি দেখিয়ে বলেছিলাম, ‘দাদান, এটা চাই।’ কিন্তু দাদান বুঝেছিল, এটা খুব সাধারণ গাড়ি নয়। তাই সন্ধ্যায় এসে এই ট্রেনটা দিয়েছিল আর বলেছিল, ‘সকালের গাড়িটা তোমার পছন্দের ছিল, আর এইটা আমার পছন্দের। তাই দুটোই তোমার!’”

এমন সময় সৌম্য বাজার থেকে ফিরে বলল, “সবাই জলখাবার খেয়ে নাও। রুচি, আমার জন্য এক কাপ চা করে দিও।”

রুচি রান্নাঘরে চলে যায়। সৌম্য তখন সুটকেসের মধ্যে একটা স্বচ্ছ ফাইল খুঁজে পায়। হাতে তুলে দেখে, সেটা রুচির চাকরির যোগদানপত্র! অবাক হয়ে বলল, “এই স্কুলটাই তো তুমি চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছিলে! কিন্তু চাকরিটা নিলে না কেন?”

যোগদানপত্রের তারিখ দেখে সৌম্যের মনে পড়ে, ওই সময় তার বড় একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। মনে মনে ভাবল, “তাই বুঝি রুচি চাকরিটা করেনি!”

ঠিক তখনই রুচি এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে বলল, “ওটা পরিস্থিতির ব্যাপার ছিল, এখন আফসোস করার কিছু নেই। বরং তুমি একটু দই মেখে দাও, বিল্লা দই-মসলা তৈরি করে দিচ্ছে। আমি তারপর মাংসটা চাপিয়ে দেব।”

রূপসা তখন সুটকেস থেকে একটা অঙ্ক খাতা বের করে বলে, “মা, এটা কি সেই খাতা, যেখানে আমি ‘পচা দিদান’ লিখেছিলাম?”

রুচি হাসল, “হ্যাঁ! ক্লাস এইটে যখন তুই খুব কম নম্বর পেয়ে দিদানের কাছে বকুনি খেলি, তখন রাগ করে এটা লিখেছিলি। কিন্তু যখন মাধ্যমিকে নব্বই পেলি, তখন দিদান বলেছিল, ‘এই খাতা আর কাউকে দেখাস না, রূপসা লজ্জা পাবে!’”

রূপসা হেসে বলল, “তাই বলে তুমি রেখে দিয়েছিলে?”

রুচি বলল, “স্মৃতিগুলো তো এভাবেই জমিয়ে রাখি!”

এবার রূপসা আরেকটা সমুদ্র-নীল পাঞ্জাবি বের করে বলল, “মা, এটা রিজুর না?”

রুচি বলল, “হ্যাঁ! তোর দাদু ভাই একবার গুরুদেবের আশ্রমের মেলা থেকে রিজুর জন্য এনেছিল। এটাই ছিল প্রথমবার, যখন উনি কারোর জন্য সঠিক মাপের কিছু কিনে এনেছিলেন। তাই যত্ন করে রেখে দিয়েছি।”

রুচি আরও বলল, “এই বইটা মনে আছে? এটা আমি আমার প্রথম টিউশনের টাকা দিয়ে তোমাদের জন্য এনেছিলাম। তোরা তখন এত খুশি হয়েছিলি যে নাওয়া-খাওয়া ভুলে রং করেই যাচ্ছিলি!”আরে তারপরেই চোখ পড়ে শুটকেসের কোনে পড়ে থাকা একটা ছোট্ট কাজুর বাকসটা।এই বাক্সটা রুপসা তোর বাবা ফ্লাইট থেকে নিয়ে এসেছিল ,সেই বছর প্রথম অফিসের একটা কাজে। তোর বাবার প্রথম ফ্লাইট চাপা ।কিন্তু ফ্লাইটে চেপে প্রচন্ডভাবে বাড়ির সবাইকেমিস করছিল ,ফ্লাইটে যে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট দিয়েছিল তাতে ছিল একটা কাজুর বাক্স। সেই বাক্সটা তোর বাবা তোদের জন্য নিয়ে এসেছিল। সেদিন তোর বাবাকে আমি চিনলামএকটু অন্যরকম ভাবে ।আগে কোনদিনও ভাবিনি এতটা আবেগপ্রবণ তোদের বাবা ।কিন্তু ওই ঘটনাটা আমাকে অন্যভাবে ভাবতেশিখিয়েছিল ।যাক সেসব অনেক দিনের কথা। এই বলে সুটকেসটা বন্ধ করেরুচি।আস্তে আস্তে গিয়ে বসে সৌম্যর পাশে।

স্মৃতির পাহাড় জমতে জমতে সৌম্য হাসতে হাসতে বলল, “তাহলে সুটকেস গুছিয়ে নেওয়া হয়ে গেল?”

রুচি মুচকি হেসে বলল, “গুছানো নয়, স্মৃতির পসরা সাজালাম! বরং তুমি আমার জন্য আরেকটা বড় সুটকেস কিনে দিও, তাতে করে আবার একদিন স্মৃতির আনাচে-কানাচে ঘুরে আসব।”

সৌম্য হেসে বলল, “হুকুম মেম সাহেব!”

One Comment

  1. Mousumi ghosh Mousumi ghosh May 17, 2025

    ভালোলাগলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *