Home / প্রবন্ধ / জননী যন্ত্রণা: স্মৃতির নদীপথে হারানো পুজোর আবাহন

জননী যন্ত্রণা: স্মৃতির নদীপথে হারানো পুজোর আবাহন

এক হারানো সময়ের ফিরে আসা গন্ধ—অভাবের মধ্যেও আনন্দে ভরা গ্রামীণ পুজোর স্মৃতি, প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা শৈশব আর আজকের শহুরে জীবনের নির্মম বিচ্ছিন্নতা। গাঙভেড়ির সাদা মাটি, শিশিরভেজা ধানের পাতায় সোনালি রোদ—সবকিছু মিলিয়ে গড়ে ওঠা স্মৃতির নদীপথ। প্রকৃতি ধ্বংসের যন্ত্রণা রুখতে মায়ের কাছে প্রার্থনা জানালেন উৎপলেন্দু মণ্ডল

আমাদের সে এক সময় ছিল। পুজোর পরে বৃত্তি পরীক্ষা। সাতসকালে বিনে পয়সায় অরুণ মাস্টারমশাইয়ের কাছে যেতে হতো। আমাদের বাড়ি থেকে বেরোলে গাঙভেড়ি থেকে এক রকম একটা জল ছবি দেখা যেত। চারপাশে অভাব, তবুও পুজো আসছে।

প্রত্যন্ত বাদা অঞ্চল যেন অপেক্ষা করত। মাস্টারমশাই বসিরহাটের লোক। সুন্দর লুঙ্গি আর গায়ে এক্সারসাইজ গেঞ্জি । সতীশ মোড়লের দলিজ ঘরে আমরা সবাই। মাঝখানে নদী। ছাত্রবন্ধুর পাতায় চোখ রেখে দেখতাম ওপারে কোন দেশ! আসার সময় কেরীদের বাড়ি ছাড়িয়ে, হেমন্তের শিশির, ধান গাছের পাতায় শিশিরের রঙে সোনার আভা, ধরতে গেলে গলে যায়। বাঁদিকে হেতাল বাগান। ওখান থেকে গুলবাঘা বেরোয়।

গতবছর পাঠশালায় পড়েছি এবার ফ্রি প্রাইমারিতে ভর্তি করে দিয়েছিল, না হলে আর বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়া যাবে না। সামনে পরীক্ষার ভয়। গাঙভেড়ির মাটি যেন সাদা বাতাসা, এখন ভাটিঘা। জল অনেক নিচে। গরিব-গুর্বো লোক প্রাতঃক্রিয়া সেরে গাংভেড়িতে বসে, গায়ে ছেঁড়া গামছা আর পেটে খিদে। ঠাকুরবাড়ি পেরিয়ে সুইজ গেট। এখনো জল বেরোচ্ছে শোঁ শোঁ করে। এই জায়গাটা ভয় করে, যদি মাচাল ঠাকুর ডেকে নেয়। অনন্ত জলরাশির মধ্যে আকাশের ছায়া এখানেই বিল মাছেরা ঘোরাফেরা করছে। নদীতে পিটেল পুলিশ নৌকা নিয়ে ঘোরে। পুজোর সময় বনকাটা বেড়ে যায়।

অরুণ মাস্টারমশাই পুজোর সময় বাড়ি চলে যাবে, ডাউনের পুজো পুজো নয়। কলকাতার গল্প স্যারের মুখে । আমাদের চোখ ছাত্রবন্ধুর পাতায়। সামনের এই পথ দিয়ে দিদিরা আসবে। মা হাতগোনে আর কতদিন বাকি। কোন কোন বার দিদিরা আসে না, মা আফসোস করে। তোর বড়দির মাথায় তেল নেই, ঘরে অভাব।

অভাব তখন কোথায় নেই । তবুও দিদিরা আসত। ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় করে ঠাকুর দেখা রাঙাবেলে, মোল্লাখালি, হেতারবাড়ি । এখানে ঠাকুর দেখতে গিয়ে দর্শনের সময় পকেটের সব পয়সা থালায় দিয়ে দিয়ে ছিলাম। আর কখনও পুজোয় পয়সা দিইনি। ছোটবেলায় জমানো পূণ্য এখন ভেঙে খাচ্ছি।

মেঘ ভাঙা বর্ষায় যখন কলকাতার বাসা বাড়িতে বসে দিন কাটচ্ছে, তখন পুজোয় ফিতে কাটা হয়ে গেছে। অদূর দর্শনে টুকরো টাকারা অনুষঙ্গ দেখেছি। জলে ভেসে যায় কার শব। গোটা কলেজ স্ট্রিট জলে ভাসে পুজো সংখ্যা, বাঙালির মননের ফসল। মা কি এবার আমাদের উপর অপ্রসন্ন ? হবেই তো যেভাবে গাছপালা কেটে শহর বানিয়েছি, তা এখন হাতে হাতে ফল পাচ্ছি।

গড়িয়া কামডহরিতে বেশি বৃষ্টি হয়েছে। এখানে এক সময় বিভূতিভূষণ জোৎস্না দেখতে যেতেন। থাকতেন সোনারপুর। তাঁর সেই বাসা বাড়ি এখন বিশালাকায় ফ্ল্যাট। গোটা রাজপুর, হরিনাভি ,গড়িয়া আর জোৎস্না দেখা যায় না। একসময় এসব জায়গায় বনজঙ্গল দেখা যেত। মাটির তেজ ও দারুণ। পাশে আদি গঙ্গা সেখান দিয়ে গেছে মেট্রো। আদি গঙ্গার সমাধি, জল ,নদী পূর্বাশ্রমের কথা মনে করতে এই মেঘ ভাঙা বৃষ্টি ও হয়তো পূর্বাশ্রমের পথ রেখায় হাঁটছে । জল এখন একা একা কথা কয়। তার সব পথ রুদ্ধ। কবি কিটস তাঁর নাম জলের দাগে লিখতে চেয়েছিলেন আমরা কী দিয়ে লিখব!

সমস্ত ইকোসিস্টেম ভেঙে জলপথ ভেঙে নির্মাতার সব পদ অতিক্রম করে এখন দ্বীপের মধ্যে বসে আছি‌। মা আসুক, আমাদের সুমতি ফেরাক।

ছবিতে দমদম পার্ক সর্বজনীনের পুজো। ছবি: রাজীব বসু

Tagged:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *