শারদোৎসবের আনন্দের মাঝেও গ্রামীণ জীবনের পরিবর্তন, হারানো ঐতিহ্য আর আলো-অন্ধকারে ভরা বাস্তবতার কথা তুলে ধরলেন উৎপলেন্দু মণ্ডল
বাজল তোমার আলোর বেণু দিয়ে শুরু হয়েছিল…
তারপর আলো আর অন্ধকারে, জল আর আগুনের সেতু বেঁধে দিলেন দেবী। কলকাতা, কল্লোলিনী কলকাতা সেজেগুজে উঠল। কে বলবে কদিন আগে বাংলার পুজো সংখ্যার আপাত শান্তিকল্যাণ হয়ে গেছে। ৬০০ টাকা মূল্যের হরপ্পা পত্রিকা ল্যামিনেশন সহ গড়াগড়ি খাচ্ছে। জল ভেজা হয়ে পাউরুটি। বাণিজ্যিক কাগজেরও একই অবস্থা। ক্ষতি হয়েছে কাপড়ের দোকানও। বালিগঞ্জ স্টেশনে কোমর জল।
তবুও পুজো সংখ্যা আসে, যায়। বাঙালি বড় পার্বন,মাইকে মাইকে গান, পথেঘাটে উৎসাহী যুবক-যুবতী। হাল ফ্যাশনের কেতা দুরস্ত। আকাশ ছেয়ে শরতের মেঘ। হেমন্তের হাতছানি। জীবনানন্দের বড় প্রিয় ঋতু, শিশিরের শব্দে মা প্রত্যাগমন করে। গ্রামে বাদা অঞ্চলে ধান গাছে থোঁড় হয়ে গেছে আর কিছুদিন পরে মাছরাঙ্গা দেবে। অন্ধ তামিলনাড়ুতে যারা কাজ করতে গিয়েছিল তারা ফিরেছে। আবার অনেকে ফেরেনি।
প্রত্যন্ত সুন্দরবনে ও দেবী স্ব-শরীরে হাজির। সেখানেও আলোর জেল্লা। আগে, বড় জোর হ্যাচাক লাইট। তাতে এত শ্যামাপোকা মরত না। কলকাতায় অধিক দীপনমাত্রার আলোয় লক্ষ্মীর বাহনরা পলাতক। নীলকন্ঠ পাখি আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ আশ্বিনের চরাচরে কত পাখি না আসা-যাওয়ার কথা ছিল। তাল গাছে, খেজুর গাছে বাবুই পাখির বাসা কত দেখেছি। চড়াই কোথায় থাকতো কে জানে। হেমন্তের শিশির ভাঙা রোদে গেঁতি ধান পাকলে ওরাই ভীড় করত। সবার পেটে তখন খিদে। নতুন ধানের চালে অদ্ভুত সুগন্ধ।
৪০ বছর আগের দেবী আর নেই। উনো জমি দুনো করতে গিয়ে শস্য বিপর্যয়। বিপর্যয় মায়ের আরাধনায়। কোথায় সে পুজপাট, কোথায় ভক্তি! আছে শুধু আনন্দ মিছিল। সে মিছিলে তিলোত্তমা, তামান্নারা চাপা পড়ে যায়। পুজোর মন্ডপ থেকে আলোকসজ্জা দেখে আনন্দ ও অবাক হওয়ার পালা। যেখানে অপু-দুর্গাদের চাকরি নেই, সেখানে নিশ্চিন্তিপুর থাকে কি করে। এই সব অমোঘ প্রশ্ন নিয়ে বঙ্গীয় জীবনে পুজো। আমরা আবার স্বাভাবিক নিয়মে ফিরে আসব।
বিপ্লব বিষাদে দিন কেটে যাবে। বাঘ আর বাঘিনী নিয়ে জঙ্গল বাড়বে। মানুষ জঙ্গল করতে যাবে নাহলে দক্ষিণ ভারত তে দেশছাড়া হবে। তাও প্রত্যেক বছর পুজো হয় বলে সবাই ঘরে ফেরে।
এই আসা-যাওয়ার পথ এর ধারে আবাদ করা গ্রাম, যা ছিল বনাঞ্চল, তা এখন আধা শহর। দিগন্তের পারে ইলেকট্রিক খুঁটি। সন্ধ্যা হলেই আলো, সে আলোয় গ্রামীণ অন্ধকার থাকে না। অথচ সবার হাতে পয়সা।
গ্রামের শেষ প্রান্ত ছিল বিহারীর বাড়ি। আট কন্যার জনক। তার বাইচের নৌকাটা আমাদের বাড়ি থেকে দেখা যেত। বিহারী নেই। তার বাড়ি ঘরদোর সব চলে গেছে, দেবেন দা দুর্গাপুজোর সময় দোকান দিত। সে এখন শহরে থাকে। তিলক কেটে, পা টেনে হাঁটে, জিজ্ঞেস করলে বলে মাধুকরী করে খাই। অমিও। শৈশবের বন্দুকের টোটা কবেই হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে আমার বাড়ি, সেখানে কলকাসুন্ধে অন্ধকার।
এই অন্ধকারে আলো জ্বালিয়ে আবার এসো মা।