আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অবসানে মহালয়া জানিয়ে দেয় দেবীপক্ষের সূচনা। ভোরের চণ্ডীপাঠ, পিতৃপুরুষের উদ্দেশে তর্পণ আর উৎসবের আমেজ—সব মিলিয়েই মহালয়া বাঙালি জীবনে এক অনন্য আবেগ। যা ভারতীয় বাঙালির পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশেরও প্রতিটি সনাতনী ঘরে। লিখলেন কৌশিক মোহন্ত (বাংলাদেশ)
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সেই গম্ভীর কণ্ঠের ভেসে আসা ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে, বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর; ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা; প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা’। তাঁর জলদ গম্ভীর কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ সেই যে বাঙালি মনে আস্তানা গেড়েছে, আজও তা একটুও নড়চড় হয়নি। এই পরিচিত সুরগুলো শুনতে ভারতীয় বাঙালির পাশাপাশি অধীর অপেক্ষায় বসে থাকে বাংলাদেশি সনাতন ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী। মহালয়ার দিন আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষ অর্থাৎ পিতৃপক্ষের অবসান হয় এবং পরের দিন মাতৃপক্ষ বা দেবীপক্ষের সূচনা হয়। সুচনা হয় শারদীয় দুর্গাপুজোর। দুর্গাপুজো মূলত পাঁচদিন ব্যাপ্তির পুজো হলেও মহালয়া থেকেই প্রকৃত উৎসবের সূচনা ও কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় তার সমাপ্তি হয়।
দুর্গাপুজোর সূচনা মহালয়া দিয়ে হলেও মহালয়ার সঙ্গে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণের বিষয়টিও প্রাসঙ্গিক। তর্পণ শব্দটি এসেছে মুলত ‘ত্রুপ’ থেকে যার অর্থ হল তৃপ্তি। পিতৃপক্ষের অবসানে দেবীপক্ষের সূচনালগ্ন ঘোষিত হয় মহালয়ার পর পরেই। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের একপক্ষকাল ধরে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করা হয়। মহালয়ার দিনে করা হয় মহাতর্পণ। মহালয়া অমাবস্যার অপর নাম সর্ব পিতৃ অমাবস্যা। কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ থেকে চন্দ্রের মহান লয় বা ক্ষয় হয় এই অমাবস্যায় , আবার শুক্লপক্ষের সূচনা থেকে চন্দ্রকলার বৃদ্ধি হতে শুরু করে । বলা হয়ে থাকে মহালয়া তিথিটি পিতৃ পুরুষের আত্মার শান্তির জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এ দিন ভোরে পিতৃ তর্পণ করা হয় অর্থাৎ পিতৃ পুরুষের আত্মার শান্তি কামনায় জল ও তিল উৎসর্গ করা হয় । সনাতন ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী এই দিনটিকে পিতৃপক্ষের সমাপ্তি এবং দেবীপক্ষের সূচনা হিসেবে উল্লেখ করা হলেও এই দিনটিকে কেন ‘মহালয়া’ বলা হয়ে থাকে, তা নিয়ে রয়েছে নানান মতভেদ ।

মহালয়ার দিনে করা হয় মহাতর্পণ।
তবে পিতৃপক্ষে বা মহালয়ায় পিতৃ পুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণের বিষয়টি উঠে এসেছে মহাভারতের একটি কাহিনি থেকে…
মহাভারতে অনুযায়ী কর্ণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মৃত্যু মৃত্যুবরণ করে পরলোক গমন করেন। কিন্তু সেখানে তাঁকে খাদ্য হিসাবে দেওয়া হয়েছিল সোনাদানা । কর্ণ তখন দেবরাজ ইন্দ্রকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে দেবরাজ বলেন ‘ দাতাকর্ণ, তুমি জীবদ্দশায় অনেক দানধ্যান করেছ কিন্তু কোনো দিন তোমার পিতৃপুরুষকে কোনও খাদ্যদ্রব্য উৎসর্গ করনি । সেজন্য তোমার প্রতি এই বিধান’ কর্ণ তখন বলেন – ‘দেবরাজ‚ পূর্বপুরুষদের বিষয়ে আমি অবগত ছিলাম না । জন্মের পরেই আমার মা আমাকে ত্যাগ করেছিলেন, তাই আমার প্রার্থনা আমাকে পুনরায় মর্ত্যে ফিরে গিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করে সেই পিতৃকার্য করার সুযোগ দিন’ । ইন্দ্র সেই প্রার্থনা পূরণ করলে কর্ণ এক পক্ষকাল সময়ের জন্য মর্ত্যে আসেন ও প্রতিপদ তিথি থেকে মহালয়া পর্যন্ত সময়ে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করেন । তাঁদের জল এবং খাদ্য দান করে তৃপ্ত করেন।
তাই মূলত মহালয়াতে তাঁকে অনুসরণ করে পিতৃ পুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করা হয় ।
পাঁচ থেকে ছয় বছর আগেও মহালয়ার ভোরে বাংলাদেশিদের ভারতীয় বাংলা টিভি চ্যানেলগুলো থেকে দেবী দুর্গার আগমন উপলক্ষে প্রচারিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপভোগ করার চল ছিল । তবে বাংলাদেশের তরুণ সমাজ ইদানীং ফেসবুক ইউটিউবের প্রতি বেশি ঝুকে পড়ায় এই চল দিন দিন ক্রমশ কমে গেলেও এখনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাংলাদেশি, মহালয়ার ভোর শুরু করেন টিভিতে সম্প্রচারিত এই ধরনের অনুষ্ঠান দেখেই। আর এই তরুণ নেটিজেনরা শুরু করেন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে শুভেচ্ছা বিনিময় এবং নিজেদের প্রফাইল থেকে শেয়ার করেন মহালয়া বা দেবী দুর্গার আগমনী উপলক্ষ্যে বিভিন্ন কন্টেন্ট । ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে দেবী দুর্গার আগমন বার্তা ।
দেশের রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের মন্দির ও পুজোমণ্ডপগুলোয় মহালয়ার দিন সকালে ভক্তবৃন্দের জন্য পিতৃ পুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পন করার ব্যবস্থা করা হয় । এর পাশাপাশি চণ্ডীপাঠের মাধ্যমে দেবী আবাহন করা হয়। রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনে কেন্দ্রীয় পুজোমণ্ডপে চণ্ডীপাঠ করে দেবীকে আহ্বান জানানো হয়। মূল আচার-অনুষ্ঠান হিসেবে ঘট স্থাপন করে ফুল, বেলপাতা দিয়ে পুজো করা হয়। সঙ্গে থাকে নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন। শুধু ঢাকেশ্বরী মন্দির নয়, সিদ্ধেশ্বরী মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন-সহ দেশের বিভিন্ন মন্দিরে থাকে এ ধরনের আয়োজন । প্রতি বছরই প্রায় ৩০ হাজার পুজোমণ্ডপে উদযাপিত হয়ে আসছে মহালয়া ও শারদীয় দুর্গোৎসব।
নদীর ঘাটগুলোতে বসে তর্পণের পসরা,কোথাও কোথাও আবার ছোট খাটো মেলাও দেখতে পাওয়া যায়। পুজোমণ্ডপগুলো সহ কুমার পাড়াগুলোতে শিল্পীদের কাটে কর্ম ব্যস্ত দিন। বাংলাদেশে মহালয়ায় সাধারণত স্কুল কলেজ ছুটি থাকে। ফলে মণ্ডপে মণ্ডপে চলে শিশু , কিশোর, তরুণ ও বৃদ্ধদের জম্পেশ আড্ডা । প্রতিমা ও মণ্ডপ সাজানোর কাজে শশব্যস্ত হয়ে পড়ে কারিগর ও বারোয়ারি পুজোমণ্ডপগুলো। বলা যায়, সেদিন থেকেই শুরু হয় দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সারা দেশ জুড়েই দেখা যায় মণ্ডপগুলোর আটচালার কাজ প্রায় শেষ হয়েছে, কাঠামে তোলা হয়েছে প্রতিমাও। এ দিন অবশ্য দেবী প্রতিমার চক্ষু আঁকার বিশেষ রীতি রয়েছে।
উৎসবের আমেজ মূলত ছড়িয়ে পড়ে মহালয়ার সাথে সাথেই। জমজমাট হয়ে উঠে শপিং সেন্টারগুলোর দোকানগুলো। দোকান মালিক, কর্মচারী ও ক্রেতাদের নিয়ে ভিড়ে জমজমাট কেনাবেচা। শুরু হয় তাদের ব্যস্ত দিন । কাপড়ের দোকানগুলোতে আসে পুজো উপলক্ষ্যে নতুন নতুন কাপড়, সাধারণ শার্ট , প্যান্ট, গেঞ্জির পাশাপাশি বিশেষ চাহিদা তৈরি হয় ধুতি , পাঞ্জাবি , শাড়ির। শপিং সেন্টারগুলোতে পুজা উপলক্ষ্যে পাওয়া যায় বিশেষ ছাড়।
এই কেনাকাটার ধুম থেমে থাকে না শুধু শপিং সেন্টারগুলোতে , ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ বাজারগুলোতে, কাঁচা বাজার থেকে শুরু করে মশলার বাজার পর্যন্ত। পরিবারগুলোর কেনাকাটা করা হয় পরবর্তী দশ দিনের জন্য। বিভিন্ন ধরনের চিড়া, মুড়ি, গুড় চিনি, নারকেলের চাহিদা বেড়ে যায় বাজারগুলিতে। বিশেষ করে নারকেলের ক্ষেত্রে অর্থনীতির সূত্রগুলোকে কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জোগান, চাহিদা এবং দাম সবই থাকে তুঙ্গে। বাড়িতে বাড়িতে শুরু হয়ে যায় চিড়া, মুড়ির মোয়া এবং তিল, নারকেলের নাড়ু বানানোর উৎসব। আর মুসলিম প্রতিবেশী ও বন্ধুদের থেকে শুরু হয় জিজ্ঞাসা ‘নাড়ু কবে খাওয়াচ্ছো ?” বাংলাদেশে যেমন রমজান মাসের ইফতার এবং আশ্বিন মাসের নাড়ুর আদান প্রদানের ব্যাপারটি একটি অলিখিত চুক্তি হিসেবে বহু বছর পালিত হয়ে আসছে ।
এই দিনটিতে সনাতন ধর্মের মানুষ প্রায় সবাই রোমন্থন করে তাদের পুরাতন স্মৃতিগুলিকে। খুঁজতে থাকে সেই শৈশব, কৈশোর, যৌবনের পুজোর দিনগুলো। আর তার সাথে পরিকল্পনা চলে আগামী দশ দিনের, পরিকল্পনা চলে পঞ্চমী থেকে দশমীর রান্না নিয়ে , পরিকল্পনা হয় পরিবার এবং বন্ধুবর্গ নিয়ে ঘুরতে যাওয়াকে কেন্দ্র করে । সব মিলিয়েই দিন পালিত হয় আনন্দ মুখর পরিবেশে ।
মহালয়ার এই মহান লগ্ন জানান দেয় সেই জগজ্জননীর আগমন বার্তা আবার একই সাথে জানান দেয় ইতোমধ্যেই ইহলোক ত্যাগ করা প্রিয় পিতৃ পুরুষদের কথা।

এ দিন অবশ্য দেবী প্রতিমার চক্ষু আঁকার বিশেষ রীতি রয়েছে।
আজকের মানব সভ্যতার পিছনে রয়েছে হাজার বছরের পূর্ব পুরুষদের অক্লান্ত পরিশ্রম, অগণিত চেষ্টা, অগণিত আবিষ্কার ,অগণিত যুদ্ধ , অগণিত প্রেম, অগণিত শোষণ, অগণিত কর্মের ইতিহাস। তাঁদের থেকে উপহার হিসেবে আজকের পৃথিবী ও এই ব্যবস্থা পাওয়া । বর্তমান মানব সভ্যতা তাঁদের কাছে ঋণী ও কৃতজ্ঞ এবং এই মহালয়ার উৎসবটি ঠিক সেটিরই বহিঃপ্রকাশ ।
তবে একটি প্রশ্ন থেকেই যায় মৃত পিতৃ পুরুষদের স্মরণ করার দিনটি শোকাবহ ভাবে পালন করার পরিবর্তে এত উৎসব মুখর ভাবে উদযাপন করা হয় কী করে ?
হয়তো তাঁরা জানেন, একটি বিরহের যায়গা কে কি ভাবে উৎসবে পরিণত করা যায়, সেই বিদ্যাকে ।
তাঁরা হয়তো জানেন, জন্ম-মৃত্যুর সেই গূঢ় রহস্য “জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ ।“
ছবি: রাজীব বসু