ভোর চারটে বাজতে না বাজতেই পুরনো রেডিওতে টিউনিং করা শুরু! আর এখন? ছবি: রাজীব বসু
পৌরাণিক কাহিনি, ধর্মীয় রীতি, আর শৈশবের ভোররাতের রেডিও শোনার স্মৃতি মিলেমিশে একাকার। লিখলেন ধীমান ব্রহ্মচারী
আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির,/ধরনীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা/
প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগতমাতার আগমন বার্তা, আনন্দময়ী…
রামায়ণে বলা হয় মহালয়ার দিন স্বয়ং রামচন্দ্র তর্পণ করেছিলেন। রাবণ ছিলেন দেবী দুর্গার আশীর্বাদ ধন্য, সেই কারণে রাবনকে বধ করতে গেলে দেবী দুর্গার আশীর্বাদ সবার আগে প্রয়োজন ছিল। তাই বসন্তকালীন দুর্গাপুজোকে শরৎকালে অনুষ্ঠিত করেছিলেন রামচন্দ্র, করেছিলেন দেবীর অকালবোধন। এই অকালবোধন করবার আগে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে অঞ্জলি প্রদান করতে হতো, কারণ সনাতন ধর্মের রীতি যেকোন শুভ কাজের আগে তর্পণ করতে হয়। তাই রামচন্দ্র মহালয়ার দিন তর্পণ করেছিলেন।
আবার মহাভারতে তর্পণ সম্পর্কে লেখা আছে, মহাভারতের যুদ্ধে কর্ণ যখন নিহত হলেন তারপর তার আত্মা স্বর্গে গমন করল। কিন্তু স্বর্গে গিয়ে কর্ণ অবাক হয়ে দেখলেন অন্যান্য আত্মাদের খাবার দেওয়া হচ্ছে কিন্তু তাকে খাবার হিসেবে স্বর্ণ ও রত্ন দান করা হচ্ছে। এর কারণ তিনি দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে জানতে চাইলে দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর উত্তরে বলেন, কর্ণ সারাজীবন স্বর্ণরত্ন দান করে গেছে, কখনো পিতৃ পুরুষদের উদ্দেশ্যে খাদ্য জল প্রদান করেননি। তাই দেহান্তের পর তার সাথেও এমনটা হচ্ছে। কর্ণ এরপর দেবরাজ কে জানান, এতে তার কোন দোষ নেই। কারণ কুমারী অবস্থায় কুন্তি তাকে জন্ম দিয়ে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর রাধা আর অধিরথ তকে কুড়িয়ে পান এবং মানুষ করেন। তিনি তার নিজের জন্ম বৃত্তান্ত জানতে পেরেছিলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে অর্থাৎ তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে। তাই তিনি তর্পন করতে পারেন নি। পৌরাণিক নানা কাহিনি দিয়েই এই মহালয়ার বর্ণনা স্বাভাবিকভাবেই আছে। কিন্তু আমাদের মহালয়া এখন অন্য ভাবনায়, অন্য ভাবে যেন চলে এসেছে। মিশে গেছে আমাদের ঘরের মেয়ে-বউদের সারা বছর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। কিন্তু কীভাবে এই মহালয়া শব্দটার সঙ্গে ছোটবেলার স্মৃতি যেভাবে জড়িয়ে থাকে শুধু আমার কেন সারা বাংলা ও বাঙালি জাতির শারদ উৎসবের একেবারেই প্রাক পর্বের দিন বলেই দিন ঠিক হয়ে আসছে। অর্থাৎ এই দিনটা যেমন একদিকে শারদ উৎসব বা দুর্গাপুজোর একেবারে দিন নির্ধারণের প্রথম দিন অর্থাৎ ওই দিন থেকেই যেন আমাদের পূজোর ছুটির ঘন্টা বেজে যায়। ছোটবেলায় স্কুল ছুটির এই দিন ছিল দারুণ আনন্দের। ভোর চারটে বাজতে না বাজতেই পুরনো রেডিওতে টিউনিং করা শুরু। প্রথমে কিছুটা জ্যা…জু হবার পর তারপরেই টিউনিংয়ে পড়ে যায় রেডিও স্টেশন। তাও আমাদের সময়ে কলকাতা দূরদর্শন থেকে সম্প্রচারিত হতো মহিষাসুরমর্দিনী অর্থাৎ মহালয়া।
ছোটবেলা আর শৈশব অথবা স্কুলে পড়াশোনা এসব কিছুই আমাদের সময় ছিল একটা বাঙালিয়ানার জেরক্স কপি। তবুও আমাদের সময়ে মহালয়ার জন্য অন্তত ভোররাতে বাড়ির ছাদে গিয়ে এন্টেনা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে, ছাদ থেকেই নিচে হাঁক হাত দিতাম, আর বলতাম “এবার ছবি পরিষ্কার এসছে?” এভাবেই কেমন যেন কেটে গেছে আমাদের ছোটবেলার মহালয়ার ভোরবেলা। তাও পাছে যদি কেউ জানতে পারে তার জন্য আগে থেকেই আমাদের কালিফটকা অথবা দোদোমা রাখা থাকতো। এমন এক একদিন গেছে একটা ধূপকাঠি জ্বালিয়ে ছাদে চলে গেছি ভোররাতে। সদ্য বর্ষা পেরিয়ে শরতের ভোর। রাত প্রায় সাড়ে তিনটে পার। আমরা তখন মৃদু শীত থেকে বাঁচতে গায়ে হালকা চাদর জুড়িয়ে ছাদে চলে আসতাম। আর কালিফটকা সলতে ছাড়িয়ে ধুপকাঠি দিয়ে জ্বালিয়ে দিতাম। সলতেপুড়তেই ফটকা ফেটে উঠতো। প্রচন্ড আওয়াজ যখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তো তখনই এ বাড়ি ও বাড়ি পাড়ার সে বাড়ি থেকে সবাই বকাবকি করত এত ভোরে কেউ বাজি পোড়ায়। অসভ্য ছেলেপিলের দল সব। এত হুড়োহুড়ি ও দস্যিপনা করে আমাদের এক এক সময় মহালয়ার বছর কাটতো। এভাবেই মহালয়ার সূর্যোদয় তখন আমাদের শৈশব মনকে আনন্দিত করে তুলত। মনের মধ্যে একটাই সুর যেন বাজে অসুরনাশিনী। ঘরের টিভি চলা শুরু করে দিত এই মহালয়ার। বাণিজ্য থেকে পণ্য, কোথায় না নেই, এই মহালয়ার শুরু থেকে।
কিন্তু আজকের মহালয়ার মহামায়ারা তেমনভাবে বিশেষ কিছু বলে বিবেচিত হয় না। এখন সারাদিনের কাজ সেরে রাতে শুতে শুতে যখন প্রায় তিনটে বেজে যায়, তখন কোনভাবেই আর মহালয়ার প্রভাতী শোনা হয়ে ওঠে না। এখন কাজই কেমন যেন প্রতিদিনের মহালয়া। এখনো কত ভোর আছে, যে সমন্ত গ্রামের মেয়েরা সকালের ট্রেনে বেরিয়ে পরে, শহরের দিকে। কারোর কাছে হেলেঞ্ছে শাক তো কারোর কাছে পাকা তাল থেকে গুগলি। এভাবেই দিনের পর দিন কেমন গোপনে চলে মায়েদের সারা বছরের জীবিকা। অসুর নাশিনী নিছকই আমাদের সমাজ জীবনের মধ্যেই থাকা কোনো নারী প্রতিমূর্তি।
আসলে আমরা যে সবকিছু নিয়ম করে মেনে নেব বা অন্যের মতো কাজ করব, তেমন কিছু নয়। আজকের মোবাইল যুগে কতটা, কীভাবে নিউক্লিয়ার হয়ে যাচ্ছি আমরা। খুব ছোট বেলায় ঘুম ভাঙত তো। তখন ঘড়ির এলার্ম বলে তেমন কিছু নেই। অথচ আমাদের ভোর ৪টে তে মহালয় শোনার ঝোঁক ছিল বিরাট। তাই আমাদের পাশের বাড়ির এক দাদুর বাড়ি থেকে বড় রেডিও ঠিক ৪.১০ এ চালিয়ে দিত। অসাধারণ এক সুরের আওয়াজে চরিদিকের মানুষজন যেন অনাড়ম্বরেই এই মহালয়া শুনে নিতেন, নিজের ঘরে বসেই। কিন্তু আজ এসব কোথায়। আমরা এখন নিজেদের মতো করে দূরদর্শন খ্যাত হেমামালিনীর দেবী দুর্গার রূপ আমাদের কেমন যেন ভাবিয়ে তুলতো কেমন! বিস্ময় আর আবেগ কোথাও যেন এখনো আমাদের কাছে ঘোরাঘুরি করছে। এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকছে নিজেদের অজান্তে। তবুও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সেই উচ্চাঙ্গের মার্গ অনেক সময় আমাদের শারদ উৎসব জানান দিত।