সালানপুর ব্লকের দেন্দুয়া অঞ্চলে ফের দুর্ঘটনার কবলে একটি ইস্পাত কারখানা। এলোকুইন্ট ইস্পাত কারখানায় আজ দুপুরের দিকে ঘটে যাওয়া এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় চারজন শ্রমিক গুরুতর ভাবে আহত হয়েছেন।
এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করে দিচ্ছে, শিল্পাঞ্চলের কারখানাগুলিতে শ্রমিক নিরাপত্তার প্রতি কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতা। উত্তপ্ত গলিত লোহার ছিটে এবং ফার্নেসের ভয়ঙ্কর পরিবেশে শ্রমিকদের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ছে, অথচ কর্তৃপক্ষের তরফে কোনো দায়িত্বশীল পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। এই ঘটনা শুধুমাত্র একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং শ্রমিকদের প্রতি কারখানা কর্তৃপক্ষের অবহেলার এক জ্বলন্ত উদাহরণ।
আজ দুপুরে এলোকুইন্ট ইস্পাত কারখানায় ফার্নেস থেকে গলিত লোহা উছলে পড়ায় চার শ্রমিক মারাত্মক ভাবে দগ্ধ হন। আহতদের মধ্যে অভিষেক রজকের অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক। বরাকরের বাসিন্দা অভিষেককে জরুরি ভিত্তিতে দুর্গাপুরের বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
অন্য তিন শ্রমিক, যারা কুলটি এলাকার বাসিন্দা, তাদের চিকিৎসার জন্য কুলটির একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। জানা গেছে, দুর্ঘটনার সময় এক শ্রমিক প্রাণ বাঁচাতে প্রায় দোতলা উঁচু ফার্নেস থেকে লাফিয়ে পড়েন, কিন্তু তাতেও তিনি দগ্ধ হওয়া থেকে রক্ষা পাননি। এই ঘটনা কারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভঙ্গুর অবস্থার উপর আলোকপাত করছে। দুর্ঘটনার পর কারখানা কর্তৃপক্ষ দুটি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে আহতদের হাসপাতালে পাঠায় এবং তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু এই তৎপরতা কি যথেষ্ট? শ্রমিকদের জীবন রক্ষার জন্য কারখানায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলে এই দুর্ঘটনা এড়ানো যেত না কি? সালানপুর ব্লকের আইএনটিটিইউসি সভাপতি মনোজ তেওয়ারি জানিয়েছেন, “যথেষ্ট সতর্কতা সত্ত্বেও এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছি।”
কিন্তু এই বক্তব্য কি শ্রমিকদের প্রতি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতাকে ঢাকতে পারে? এই ঘটনা দেন্দুয়া অঞ্চলের প্রথম দুর্ঘটনা নয়। কিছুদিন আগেই একই এলাকার এমএসপিএল কারখানায় ছাউনি ভেঙে পড়ে একাধিক শ্রমিক আহত হন, এবং গয়ার এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। সেই ঘটনায় তৃণমূল শ্রমিক সংগঠনের হস্তক্ষেপে মৃতের পরিবার ক্ষতিপূরণ পেলেও, এই ধরনের ঘটনা বারবার ঘটে চলেছে। এটি স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে কারখানাগুলি শ্রমিক নিরাপত্তার প্রতি কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না। তৃণমূল শ্রমিক নেতৃত্ব এই দুর্ঘটনার পরেও আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা ও অন্যান্য সুবিধার বিষয়ে নজর রাখছে বলে জানিয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের জীবনের মূল্য কি শুধু ক্ষতিপূরণ দিয়ে মাপা যায়?
এই ঘটনার তদন্তের জন্য ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টর দেবব্রত চক্রবর্তীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, তার কাছে ঘটনার কোনো খবর এখনো আসেনি। তবে তিনি খোঁজ খবর নিয়ে দেখবেন।
এই উদাসীনতা শ্রমিকদের প্রতি কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীন মনোভাবের আরেকটি প্রমাণ। বারবার দুর্ঘটনা ঘটলেও কারখানাগুলির নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনো উন্নতি হচ্ছে না। ফার্নেসের মতো বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করা শ্রমিকদের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা সরঞ্জাম, এবং জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার ব্যবস্থা থাকা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু এই কারখানাগুলি শুধু উৎপাদনের লক্ষ্য পূরণে ব্যস্ত, শ্রমিকদের নিরাপত্তা তাদের কাছে গৌণ। শ্রমিক নিরাপত্তার প্রতি এই অবহেলা শুধু দেন্দুয়ার সমস্যা নয়, এটি সমগ্র শিল্পাঞ্চলের একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। এই ঘটনাগুলি শুধু শ্রমিকদের জীবনকে বিপন্ন করছে না বরং তাদের পরিবারের উপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। একজন শ্রমিকের আহত বা মৃত্যু হলে তার পরিবারের আর্থিক ও মানসিক ক্ষতি অপূরণীয়। তবুও কারখানা কর্তৃপক্ষের তরফে শুধু ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, কিন্তু দুর্ঘটনা রোধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। এই অবস্থা চলতে থাকলে শ্রমিকদের জীবন আরও বিপন্ন হবে। সরকার, শ্রমিক সংগঠন এবং কারখানা কর্তৃপক্ষের উচিত এই ঘটনাগুলিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা। নিয়মিত পরিদর্শন, শ্রমিকদের জন্য প্রশিক্ষণ, এবং আধুনিক নিরাপত্তা সরঞ্জামের ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। শ্রমিকরা কারখানার মেরুদণ্ড, তাদের নিরাপত্তা উপেক্ষা করে শিল্পের উন্নতি সম্ভব নয়।
দেন্দুয়ার এই দুর্ঘটনা শুধু একটি সতর্ক বার্তা নয়,এটি একটি জাগরণের ডাক। শ্রমিকদের জীবনের মূল্য দেওয়া হবে, নাকি কারখানার লাভই সবকিছুর উপরে থাকবে—এই প্রশ্নের উত্তর এখন সময়ের হাতে।