Home / প্রবন্ধ / ছাইজন্ম, আয়না পৃথিবী: যে আলো অন্তর্ভুক্ত জন্মের

ছাইজন্ম, আয়না পৃথিবী: যে আলো অন্তর্ভুক্ত জন্মের

chhai

কাব্যগ্রন্থ: ছাইজন্ম, আয়না পৃথিবী
কবি: দেবার্ঘ সেন
পাঠানুভব: দেশিক হাজরা

ছাইজন্ম, আয়না পৃথিবী — এই শব্দবন্ধ দুটি একসাথে উচ্চারিত হলে এক গভীর দর্শন তত্ত্বের অনুভব জাগায়। “ছাইজন্ম” আত্মজিজ্ঞাসা ও বিকল্প বাস্তবতার ইঙ্গি, ছাই’ যেকোনো বস্তু পুড়িয়ে ফেলার পরে অবশিষ্ট যা-কিছু, খুবই তুচ্ছ এবং তার ভেতর জীবিত বা প্রয়োজনীয় কিছু আর বেঁচে থাকে না আগুনের দ্বারা কৃতকর্ম। আর জন্ম: সৃষ্টি, কাব্যিক রুপের: জীবন চক্রের এক অভিনব সূত্রপাত। তবে এই দুটি শব্দের একত্রে প্রতিচ্ছবির মতো, নকল প্রতিধ্বনি। অন্যদিকে “আয়না পৃথিবী” এক বিপরীত দুনিয়ার প্রতীক যেখানে সব কিছু উল্টো, প্রতিবিম্ব হয়ে দাঁড়ায়। এই দুই শব্দে মিলে সৃষ্টি হয় এক অস্তিত্ব-জিজ্ঞাসার রূঢ় কাব্য। “ছাইজন্ম” যেন প্রশ্ন তোলে, এ জন্ম কি আসলেই? আর “আয়না পৃথিবী” তার উত্তর দেয় সবই তো প্রতিবিম্ব, সবই তো সম্ভাব্য ছায়া। এই কাব্যগ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন কবি স্বয়ং, দেবার্ঘ সেন। প্রচ্ছদ ঘিরে প্রতিফলনের বিমূর্ত সুররিয়াল দৃষ্টিভঙ্গি প্রবাহের অস্থিরতা বন্দী দশার ছাপ র্দশিত। এই প্রচ্ছদে রহস্য, মৃত্যু ও অস্তিত্বজিজ্ঞাসার গভীর কাব্যিক ছাপ স্পষ্ট।

কাব্যগ্রন্থটির শুরুতেই লক্ষ্য করা যায় প্রাবন্ধিক দীপঙ্কর বাগচী’র লেখা ‘প্রাককথন’ এই কাব্যগ্রন্থের উদ্দেশ্যে। কবি ও প্রাবন্ধিক দীপঙ্কর বাগচী এক প্রকারে জোর দিয়ে কবির চর্চার সময়কাল টিকে নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করেছেন। প্রাবন্ধিক লিখেছেন: “শিল্প দেবী তাঁর কাছেই ধরা দেন যিনি অন্তত বেশ কয়েক বছর ধরে লিখছেন বা চর্চা করছেন। ফলে তাঁর লেখার ভিতর তাৎক্ষণিক চমকের অবকাশ নেই। আর যিনি সদ্য লিখতে এসেই আকস্মিকভাবে একটি বা দুটি ভালো কবিতা লিখে ফেলেছেন তাঁকে গুরুত্ব দেওয়ার কোন কারণই অবশিষ্ট থাকে না, যিনি আদ্যন্ত শিল্প বা কাব্যে নিবেদিত প্রাণ কবি বা শিল্পী। অর্থাৎ কোন কিছুই শ্রম ও প্রতিভাযুক্ত না হলে সঠিক মাত্রায় বেজে ওঠে না নির্দিষ্ট শিল্প-বস্তুটি।” এই উক্তিটির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এও বলা চলে, আকস্মিক সাফল্য বা হঠাৎ লেখা একটি ভালো কবিতা স্থায়ী শিল্পচেতনার প্রতিফলন নয়। এই বক্তব্যে কেবল শিল্পে পরিশ্রমের গুরুত্বই নয়, বরং দীর্ঘ সাধনা, প্রতিভা ও নিষ্ঠার সমন্বয়ে গভীর আত্মনিবেদনের প্রয়োজনীয়তাও স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যা একজন সত্যিকারের কবি বা শিল্পীর চিহ্ন।

আমি যখন এই বই হাতে তুলে নিই তখন দেশের মধ্যে এক বর্বরতা ঘেরা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, আসলে আমার মননের সাথে কাব্যগ্রন্থটি একত্রিত হতে গেলে যে সময়টির দরকার ছিলো তা যেন এখনই আমার সম্মুখে, একদমই ঠিক সময়। যদিও এ বড় হাস্যকর বিষয়। যেমন; বসন্তকালে বসন্তের কবিতা, বর্ষায় বৃষ্টির কবিতা আমাদের মনকে আকৃষ্ট করে পারে আরো বেশি। ঠিক তেমনি এই বর্বরতার আমাকে এই বইয়ের কবিতার কাছে নিবিড় ঠাঁই দিতে পেরেছে। পৃথিবীর বুকে এই পাশবিকতা বারবার ফিরে আসে ইঙ্গিত দেয় পতনের, চিরপ্রবাহিত কালেও এই সময় হয়তো আবার আসবে ফিরে, এই শক্তিশালী কলমের আশ্রয়ে আমারই মতো আবার পাঠক জন্ম নেবে। এই বইয়ের উৎসর্গ পত্রের পরিবর্তে পাংশুটে কাগজে অস্পষ্ট অক্ষরে লেখা আছে কয়েকটি পুঙক্তি আমাদের জন্ম কে উৎসর্গ করে আমাদের জন্মান্তরকে উৎসর্গ করে।
“ডানা নেই/পাখনা নেই। উড়ে যাচ্ছে ছাই,/উড়ে যাচ্ছে জন্ম—
এই তো পৃথিবী/দাও আগুন।/টুকরো অভিসারে,/ দাও আয়না চৈতন্য।” প্রথম চার লাইনে বিস্ময়কর বিপর্যয়ের দৃশ্য, ছাই সম্ভবত হীন মানবিক সম্ভাবনার প্রতীক এবং জন্মের পুড়ে যাওয়া সংকটের সংকেত। অস্তিত্বের ঝুলন্ত অনির্দিষ্ট এক পুংক্তি ছায়ের সাথে উড়ে যায় জন্ম। অর্থাৎ জীবন একটি ভস্মীভূত গতিমাত্র তবে! এতো সংঘর্ষের কারণ!

শেষ চার লাইনে একটি জিজ্ঞাসা মূলক হতাশার কাছে এসে দাঁড়ানো যায়। ” এই তো পৃথিবী” রুঢ় স্বীকারোক্তি, সমস্ত সংঘর্ষের পরে এই পৃথিবী আসলে ছাইয়ের দাহ্য। এই পংক্তি গুলিতে বিপর্যয় জীবনের অভিসার নিরুদ্বেগ আয়না চৈতন্য হীন। কবি চাইছেন সত্যের দর্শন ( আয়না চৈতন্য) এর দ্বারা সত্যকে গ্রহণ করতে পারা। মানব সভ্যতায় কবিতা শুধু শিল্প নয়, তা এক ঐতিহাসিক চালিকা শক্তি, যা মানব মনের আলো-অন্ধকারকে যুগে যুগে ভাষা দিয়েছে।

সেই আদিম গুহাচিত্র থেকে শুরু করে বেদ, উপনিষদ, হোমারের মহাকাব্য কিংবা চণ্ডীদাসের প্রেমগীতি সর্বত্র কবিতা মানুষের আত্মা, ইতিহাস, দর্শন ও অনুভবের ধারক হয়েছে। তবে যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন আন্দোলন বা মেধা মন্ডলীর দ্বারা ভাষাগত পরিবর্তনের মাধ্যমে কবিতার নতুন রূপ/গঠন পেয়েছি।

তবে কবি’র কাছে আসলেই কবিতা কেমন? এর উত্তর বহুরূপে জানা গেছে বিভিন্ন মিথ ও কথোপকথনে, কখনো শব্দে প্রকাশ না করে সামান্য হাঁসিতেও এক অদ্ভুত উত্তরের প্রকাশ ঘটেছে। কিন্তু কবি যখন তাঁর পান্ডুলিপি তৈরি করেন, তাঁর এতকালের চর্চার মধ্যে হয়তো খুব জোর ৫০ টি কবিতা বেছে নিতে হয় ! অতএব এই বইয়ের প্রথম কবিতা “মন্ডপ” মূলত এই শিরোনামটির সাথে পরিচিত কোন পূজার মূর্তি বা ঘট প্রতিষ্ঠার স্থান। কবি এখানে তাঁর প্রতিটি কবিতাকে ওই সম্মান ও ভক্তি দিয়ে উদার করেছেন। যেমন : যেকোনো ধর্মেই নতুন কোন কাজ শুরু করার আগেই একটি স্বীকারোক্তি একটি প্রার্থনা, কবি নিজের কবিধর্ম শুরু করার আগে তাই করতে চেয়েছেন। নিজের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেছেন তাঁর ভয় ও দুর্বলতার এই সারা জীবনের চর্চার ফসল গুলিকে আজ যখন পান্ডুলিপির অংশ হিসাবে দেখছেন, মনে হতে থাকে তাঁর সব “ছাইজন্ম”—

“বুঝতে পারি এ জীবন আসলেই ছাইজন্ম, ঘাট পেরোতে হবে বুকের/ ওপর ভেঙে যাওয়া আয়নার সবকটি টুকরো আপাত সাজিয়ে নিয়ে। আর তখন/ না থাকার কক্ষপথ জুড়ে অন্ধকার, নিরলংকার অভ্র মাখা, যারপরনাই মণ্ডপে/ মণ্ডপে ঘুরবে পৃথিবী।”

কবিতায় পৃথিবীর রূপরেখা শুধু চিত্র নয়, এক মানসিক টপোগ্রাফি যেখানে নদী মানে বিস্মৃতি, পাহাড় মানে প্রতিবন্ধকতা, আর সমুদ্র মানে অনন্ত একাকিত্ব। কবিতা সেই মানচিত্রেই আঁকেন তাঁর ভিতরের দেশ, কবির কাব্যিক ভাবনা দিয়ে।
শ্রদ্ধেয় শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় কিংবা নির্মলেন্দু গুণের লেখায় দেখা যায় পৃথিবী একটি রাজনৈতিক প্রতীক হয়ে উঠছে। সীমান্ত, যুদ্ধ, শরণার্থী, মহাদেশান্তর ভ্রমণ সবই পৃথিবীর মানচিত্রকে কবিতার ভিতরে এনে দিয়েছে এক ব্যঞ্জনা। আর‌ও উদাহরণস্বরূপ, জীবনানন্দ দাশের “পৃথিবী যেমন ছিল, তেমনি আছে”—এই পঙক্তিতে যে পৃথিবীর অবিনাশের কথায় আমরা শান্ত হতে পারি, পরক্ষণেই তাঁর কবিতার শহর, অরণ্য, নদী—সব যেন এক ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়। এই দোলাচলে কবির পৃথিবী আমাদের চেনা ভূপ্রকৃতির বাইরেও এক অতল মানসজগতের অংশ। আবহমান কাব্যে পৃথিবী যেন এক তীর্যক প্রশ্নের ছায়া: “এই পৃথিবীর ভিতরেই কি লুকোনো থাকে অন্য এক পৃথিবী?” ( এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে/ জীবনানন্দ দাশ) যেখানে ভূগোল কেবল স্থান নয়, স্মৃতি, দুঃস্বপ্ন, নিঃসঙ্গতা, প্রেম, প্রতিরোধ—সবকিছুর আধার।
“প্রতিরাতে কাচভাঙার আওয়াজ শুনতে পাই/ চোখের জলে এসে চাঁদ ডুব দ্যায়” কাব্যগ্রন্থের এই চরণে কবি চাঁদ উল্লেখ করেছেন আসলে চাঁদ শুধুমাত্র পৃথিবী কেন্দ্রিক উপগ্রহ, এখানে চাঁদ অনিদ্রা হতে পারে এখানে চাঁদ বিঘ্নতা হতে পারে অথবা দুঃস্বপ্ন। আবার ২৯ পাতার এই পুঙক্তি গুলি পড়লে বোঝা যায় আসলেই আমরা এই পৃথিবীর মধ্যে শুধুমাত্র তুচ্ছ অপেক্ষাকৃত জীবনের অধিকারী।

“এই বিখ্যাত পৃথিবীতে, মানুষ আজ আছে কাল নেই। গতকাল আর আজ এর/ ব্যবধানে কয়েকটা মাত্র ঘন্টা হয়ে যেতে পারে মরুঝড়- আটকানোর সকল/ মাধ্যমই হয়তো বা অথর্ব- অপেক্ষাদের সমষ্টি থেকে বিয়োগ করার অপশন/ কেবলমাত্র দুটি, একে অপেক্ষা দুইয়ে জীবন।” – যেন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে মৃত্যু।

‘রাত্রি’ শব্দটি কবিতায় এক গূঢ় অলংকার, তিমিরের আঁচলে মোড়ানো এক অন্তর্লোক নিঃশব্দে বাজে অভিমানের সুর বেদনাবিধুর প্রেমের স্বরলিপি কখনো সে ভালোবাসার এক মায়াবী পর্দা কখনো হারিয়ে যাওয়া কথার নির্জন রাত্রিকাল চাঁদের কিরণে ঢেউ তোলে স্বপ্ন আর নক্ষত্রেরা যেন নিরুদ্দেশ চিঠির অনুচ্চারিত বাক্য। কবি রাত্রিকে দেখেন অবচেতনের দরজা খুলে যেখানে আলো আসে অন্তর্মুখী দীপ্তি হয়ে। সে কখনো নিঃসঙ্গ নদীর মতো অন্ধকারে গাইছে দীর্ঘশ্বাসের গান, আবার কখনো বিষণ্ন আকাশে ছড়িয়ে দেয় নীরব আকুতি। রাত্রি, শুধুই কাল নয় সে এক অনন্ত কাব্য— “রাত্রিশব্দ থেকে তোমার ভ্রূপল্লব ধরে ভোর নেমে আসে।” – এ চরণ যেন নিবিড় প্রেমের সিংগার। অথবা “পূর্ণ আলোকিত চাঁদ, পুঞ্জীভূত মেঘ। আকাশ বুঝি, ফাঁদ পাতছে গোপনে।/ মাথা ঢাকো। এ রাত তর্কের নয়, তর্কে তর্কে আড়াল হয়েছে সত্য।” – এখানে চাঁদ ও মেঘ এক প্রতীকী দ্বৈততা বহন করে রাত হয়ে উঠেছে আত্মসংশয়ের সময় আর আহ্বানে আছে সাবধানতা, আত্মরক্ষা। সব আলোই সত্য নয়, আর সব তর্কই মুক্তি দেয় না।

‘মৃত্যু’ এক বিষাদ-সুষমা চরণের অন্তরালে এক অনিবার্য ছায়া যা কখনো উচ্চারণহীন কখনো উচ্ছ্বাসহীন অথচ তার অভিঘাত চিরস্থায়ী। এই দ্বৈততা থেকেই জন্ম নেয় চরণের স্পন্দন। মৃত্যু সেখানে ‘শেষ’ নয় বরং এক মহৎ ট্রান্সফরমেশন জীবন থেকে অনস্তিত্বে এক বিস্ময়কর অস্তিত্বে উত্তরণ। যেন অনির্ধারিত এক দারওয়াজা যার পেছনে হয়ত অনন্ত আলো হয়ত নিঃশেষ অন্ধকার। অভিধানহীন ব্যাকরণ, যেখানে প্রত্যেক কবি নিজের রক্তে লিখে রাখেন সেই নিরুত্তর প্রশ্ন; “সামলে ওঠো জীবন, জীবন কই, জীবন কই-/ পায়ে পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে অসমাপ্ত নির্ঘোষ…”

এই কাব্যগ্রন্থের পুঙক্তি গুলি নিজের ছায়া নিজেই ভাঙে, নিজেকে জন্ম দেয় পাঠকের হাতে ধরা দেয় না কোনো নিশ্চয়তা, শুধু রেখে যায় কিছু প্রতিবিম্ব, কিছু ছায়া, কিছু অনুচ্চারিত আলো। ছাই হয়ে, আয়না হয়ে, জন্ম হয়ে। এ কোনো শৈল্পিক অনুশীলন নয়, অস্তিত্বের শুদ্ধ আত্মঘাত। এখানে কবিতা জীবনের সান্ত্বনা নয়, তার উলঙ্গ প্রতিবাদ। ছাই আর আয়নার ভেতর কবি খোঁজেন এমন এক সত্য, যা আলো নয় অথচ চৈতন্য কে জ্বালিয়ে দেয়। অস্ত্র, আশ্রয় এবং অনিবার্য অনশন “ছাইজন্ম, আয়না পৃথিবী”

Tagged:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *